ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণ ছাড়াই ঈদের আগে যুক্তরাজ্য সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গ্লোবাল হাঙ্গার সম্মেলনে শেখ হাসিনা যোগদান করেন বলে সরকারের তরফ থেকে প্রচার করা হয়। সম্মেলনের অফিসিয়াল ছবিতেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। আর কোনো দেশের সরকারপ্রধানও সম্মেলনে যোগ দেননি। প্রধানমন্ত্রীর অনাহূত লন্ডন সফর নিয়ে তথ্য-প্রমাণসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডনের একটি জনপ্রিয় বাংলা সাময়িকী।
এ নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে বিলেতের বাঙালি কমিউনিটিতে আলোচনার ঝড় উঠেছে।
বিলেতের জনপ্রিয় বাংলা সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ এক প্রতিবেদনে জানায়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের অনুষ্ঠানসূচিতে, ডাউনিং স্ট্রিটের প্রেস রিলিজে, পাঠানো ছবিতে, এমনকি সংশ্লিষ্ট কোথাও বাংলাদেশের নাম পাওয়া যায়নি। খোদ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস উইংয়ে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাননি।
অনেকটা অনাহূত হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্টের আহ্বানে আয়োজিত এ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দিয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। ৩৬ জন সফরসঙ্গী নিয়ে ১১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সফর শেষে ১৩ আগস্ট ঢাকায় ফিরে যান।
তবে ওয়াকিবহাল মহল জানিয়েছে, ব্রিটিশ সরকারই এবার কৌশলে শেখ হাসিনাকে মিডিয়া থেকে দূরে রেখেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, হাঙ্গার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর পর বিবিসির হার্ডটক ইন্টারভিউ প্রচারিত হয়—যেখানে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে র্যাবের ক্রসফায়ার, হত্যা-গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক, পদ্মা সেতুর নামে অর্থ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বে আলাচনার ঝড় ওঠে। এতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানালেও তার উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে পারেনি; বরং ব্রিটিশ মিডিয়া থেকে তাকে কৌশলে দূরে রাখা হয়। এমনকি বাংলাদেশ হাইকমিশনও প্রচারণার বিষয়টি এড়িয়ে যায়।
এর আগে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক সফরসঙ্গী নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সে সফর নিয়েও বিতর্ক ওঠে। ভারত-পাকিস্তানসহ অনেক দেশের সরকারপ্রধানই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি।
যোগদান শেষে দেশে ফেরার পরপরই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর আসে—১২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী আবারও লন্ডন যাচ্ছেন। তবে এবার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার আমন্ত্রণে নয়, খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের আমন্ত্রণে ‘আন্তর্জাতিক পুষ্টি সম্মেলনে’ যোগ দিতে আসছেন তিনি।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় দফা ওই লন্ডন সফর ছিল নিরুত্তাপ ও প্রচারণাবিহীন। ব্রিটিশ মিডিয়া তো দূরের কথা, লন্ডন কিংবা বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ায়ও বিষয়টি ছিল একেবারেই গৌণ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের লন্ডন সফরের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচারণা লক্ষ করা যায়নি। আর এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক চমকপ্রদ তথ্য। মূলত সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানসূচি জানতে চেয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
গত ৮ আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে ‘আন্তর্জাতিক পুষ্টি সম্মেলনে’র অনুষ্ঠানসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে ১০ আগস্ট শুক্রবার এ সংক্রান্ত একটি ই-মেইল পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল টিমারের সঙ্গে গ্লোবাল হাঙ্গার ইভেন্টে কো-হোস্ট করবেন। এতে অন্যান্য সম্ভাব্য অতিথি হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়, তারা হলেন আইরিশ টয়সিস এন্ডা কেনি, ভারতের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী কৃষ্ণা ট্রিথ, চিলড্রেন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ফাউন্ডেশনের ক্রিস কোপার হো, ইউনিলিভারের সিইও পল পলম্যান এবং ইউরোপিয়ান কমিশনার ফর ডেভেলপমেন্টের আদরিস পিবলাগস।
এ অনুষ্ঠানসূচির কোথাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ নেই। ১২ আগস্ট রোববার ৪টায় মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
আমন্ত্রিত হয়ে লন্ডনের সাপ্তাহিক নতুন দিন-এর নির্বাহী সম্পাদক তাইছির মাহমুদ অনুষ্ঠান কভার করতে ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছেন সোয়া ৩টায়। দেখতে পান ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ঠিক সামনে বিবিসিসহ দেশি-বিদেশি মিডিয়ার উপচেপড়া ভিড়। একে একে ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রবেশ করতে দেখেননি তিনি।
অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী সম্মেলন শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট আগে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে অনুষ্ঠিত হয় রেস অ্যাগেইনেস্ট হাঙ্গার নামে একটি দৌড় প্রতিযোগিতা।
এতে সাদা-কালো ও এশিয়ান পাঁচ কিশোর-কিশোরী অংশগ্রহণ করে। এ সময় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে রানারদের স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল টিমার, ফুটবলের রাজা পেলে, অলিম্পিক গোল্ড মেডেলিস্ট ব্রিটিশ মুসলিম মোহাম্মদ ফারাহসহ অন্যান্য অতিথি। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন না। এতে সম্মেলনে তার উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে অনুষ্ঠানসূচিতে শেখ হাসিনার নাম না থাকার কারণ জানতে চাইলে চিফ প্রেস অফিসার হেলেন বাওয়ার ইমেইলে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্থ ছিলেন না এবং তার যোগদানের বিষয় নিশ্চিত করা হয়নি।
তবে তিনি সম্মেলনে ছিলেন। তাকে সম্মেলনের ছবি ও প্রেস রিলিজ পাঠাতে অনুরোধ করলে তিনি ইমেইলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সিঙ্গেল ফটো ও প্রেস রিলিজ পাঠান। এতে দেখা যায়, মাইক্রোফোনের পেছনে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন। আর তার পেছনে বসে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। প্রেস অফিসারকে একটি প্যানেল বা গ্রুপ ছবি (যাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য অতিথি আছেন) ইমেইল করতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, তাদের কাছে শেখ হাসিনার এ একটি ছবিই আছে।
আর কোনো ছবি নেই।
সম্মেলন শেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়, তাতে কোথাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামটি একটিবারের জন্যও উল্লেখ করা হয়নি। তবে দু-একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীকে মিডিয়া থেকে এভাবে দূরে রাখার বিষয়টি বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিকরা ১৩ আগস্ট সোমবার বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অনুষ্ঠানসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর নাম না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রেস মিনিস্টার জানিয়েছেন, ডাউনিং স্ট্রিটের অনুষ্ঠানসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর নাম নেই, কারণ শুক্রবারের পর তার নাম ঢোকানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গ্লোবাল হাঙ্গার সম্মেলনে প্রবেশের ক্ষেত্রে খুব কড়াকড়ি ছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আসা বিটিভির ক্যামেরাম্যানকেও ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ অনুষ্ঠানে আর কে কে অংশগ্রহণ করেছেন—জানতে চাইলে মোজাফফর আহমদ বলেন, ছবিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে দেখতে পাচ্ছি। তিনিও বোধহয় ছিলেন। গ্লোবাল হাঙ্গার ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের একটি প্রেস রিলিজ পাঠাতে অনুরোধ করলে তিনি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের লিংক ইমেইল করেন।
তিনি জানান, এ ইভেন্টের কোনো আলাদা প্রেস রিলিজ হাইকমিশন থেকে ইস্যু করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে লন্ডনে আসছেন—এ খবর প্রকাশ হয় ঢাকা ও লন্ডনের একাধিক সংবাদপত্রে। এই একটিমাত্র অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে ১১ আগস্ট শনিবার ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলসহ হিথরো পৌঁছে সেন্ট্রাল লন্ডনের হোটেল সেন্ট প্যানক্রাস রেনেসাঁয় ওঠেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন যথারীতি ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সম্মেলনে যোগ দেন। কিন্তু অনুষ্ঠানসূচিতে তার নাম অন্তর্ভুক্ত না করা, বিটিভি ক্যামেরাম্যানকে সম্মেলনের ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়া, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ অন্য অতিথিদের সঙ্গে তোলা ছবি না পাঠিয়ে সিঙ্গেল ছবি মিডিয়ায় সরবরাহ করা এবং ইভেন্ট শেষে প্রেরিত প্রেস রিলিজে শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ না করার বিষয়টি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে লন্ডনের রাজনৈতিক মহলে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাধর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন আর বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। সংবাদপত্র অফিস থেকে বাববার ফোন করে, ইমেইল দিয়ে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি সম্পর্কে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা না করে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন। গুরুত্বহীন এই আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হেয় করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিরাট অংকের অর্থ অপব্যয় করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বিষয়টি আরও গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা কীভাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন, তা-ও বেরিয়ে আসবে।
এ নিয়ে বিলেতের বাঙালি কমিউনিটিতে আলোচনার শেষ নেই।
আমার দেশ
javascript:void(1);
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।