আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অলিম্পিকের গল্পঃ বেবি হিরোশিমা আর মোহাম্মদ আলীর গল্প

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর। টোকিও জাতীয় স্টেডিয়াম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই টোকিও অলিম্পিকের মশাল প্রজ্জ্বলন করা হবে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মূল ক্যালড্রনে মশাল কে জ্বালাবেন। হঠাৎই দেখা গেলো ১৯ বছরের এক বালক মশাল হাতে ক্যালড্রনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

পুরো টোকিও স্টেডিয়াম আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো, দর্শকরা করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো। না, কোনো অলিম্পিয়ান মশাল হাতে ক্যালড্রনের দিকে এগিয়ে যাননি, এগিয়ে গিয়েছেন “বেবি হিরোশিমা! ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় দিন। ১৯৪৫ সালের এই দিনে মিত্রবাহিনী জাপানের হিরোশিমাতে প্রথম আণবিক বোমা ফেলে, এর তিনদিন পর ৯ই আগস্টে আবারো একই ধরনের বোমা ফেলা হয় নাগাসাকিতে। বোমা ফেলার প্রথম দুই থেকে চার মাসের মধ্যে ৯০,০০০ থেকে ১৬৬,০০০ লোক হিরোশিমাতে এবং ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ লোক নাগাসাকিতে মারা যান, তন্মধ্যে প্রায় অর্ধেক লোকই মারা যান প্রথম দিনে। হিরোশিমাতে প্রায় ৭০,০০০ লোক আহত হয় এবং প্রায় ৯০% ডাক্তার ও ৯৩% নার্স মারা যাওয়াতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়।

আরো ২০০,০০০ লোক ১৯৫০ সালের মধ্যে মারা যায় রেডিয়েশনের কারণে ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়ায়। যারা এই বোম্বিং থেকে বেঁচে যায়, তাদেরকে বলা হয় ‘হিবাকুশা’ (Hibakusha- a Japanese word that literally translates to ‘explosion-affected people’.) ২০১০ সালের ৩১ই মার্চ পর্যন্ত জাপান সরকার কর্তৃক স্বীকৃ্ত ২২৭,৫৬৫ জন হিবাকুশা জীবিত ছিলেন। বেবি হিরোশিমাকে হিবাকুশা বলা যায় কি না জানি না, কারণ তাঁর জন্মইতো সেই দিন! এবং সেই হিরোশিমাতেই! তাঁর আসল নাম ইয়োশহিনোরি সাকাই (Yoshinori Sakai)। ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট হিরোশিমাতে জন্ম নেওয়ায় তাঁর ডাক নামই হয়ে গেলো বেবি হিরোশিমা। এই বেবি হিরোশিমা কীভাবে সারভাইভ করলো, সে কাহিনী আরেকদিন।

১৯৬৪ সালে তিনি ছিলেন টোকিও- এর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের রানিং ক্লাবের সদস্য। ছিলেন এমেচার দৌড়বিদ। এই বছরই প্রথম সিদ্ধান্ত হয় অলিম্পিক টেলিভিশনে দেখানো হবে। এবং এই বছরেই অলিম্পিক প্রথম বারের মতো এশিয়াতে অনুষ্ঠিত হবে। তাই জাপান সরকার, যারা পৃথিবীতে আণবিক বোমার একমাত্র শিকার, ঠিক করলো- বোমা ফেলেও জাপানকে ধ্বংস করা যায় নি, তা বিশ্ববাসীকে যেভাবেই হোক দেখাতে হবে।

সিদ্ধান্ত হলো ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট হিরোশিমাতে জন্মগ্রহনকারী কাউকে দিয়ে অলিম্পিকের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের মশাল জ্বালানো হবে। এভাবেই ইয়োশহিনোরি সাকাইকে সর্বশেষ মশাল বাহক হিসেবে ঠিক করা হলো। কিভাবে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে হবে, কিভাবে দৌড়িয়ে ক্যালড্রনের দিকে যেতে হবে, কিভাবে মশাল জ্বালাতে হবে- এই সমস্ত ব্যাপারে ইয়োশহিনোরিকে শেখাতে লাগলেন ট্রিপল জাম্পের সাবেক বিশ্বরেকর্ডধারী তেরুজি কোগাকে। ১০ই অক্টোবর ইয়োশহিনোরি সাকাই যখন এক একটা স্টেপ অতিক্রম করে ক্যালড্রনের দিকে এগোচ্ছিলেন, সমগ্র জাপান, সমগ্র বিশ্ব যেনো তাঁর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের দিকে তাকিয়েছিলো। বেবি হিরোশিমা টোকিও অলিম্পিকে মশাল জ্বালাচ্ছেন তিনি যেনো সেই সময় প্রতীক হয়ে রইলেন জাপানের শান্তির দিকে পদচারণার, প্রতীক হয়ে রইলেন আণবিক বোমার ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুত্থানের, প্রতীক হয়ে রইলেন অলিম্পিকের মূলনীতির।

১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের মশাল প্রজ্জ্বলন যদি হয় আণবিক বোমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাহলে ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকের মশাল প্রজ্জ্বলন হবে প্রচন্ড আবেগের প্রতীক। মোহাম্মদ আলী। বক্সিংয়ের কিংবদন্তী। শুধু বক্সিংই নয়, যে কোন খেলাধুলার হিসেবে মোহাম্মদ আলী এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে এমেচার হিসেবে বক্সিং-এ স্বর্ন পদক জয়ের পর, ১৯৬৪ সালে বক্সিং – এ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হোন।

১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, "I ain't got no quarrel with them Viet Cong... No Viet Cong ever called me nigger”, যা পরবর্তীতে মার্টিং লুথার কিং জুনিয়রের সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যার ফলে ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে ব্ল্যাক ফিস্টের মতো ঘটনাও ঘটে। তিনি এই সময়ে আরো বলেন, “No, I am not going 10,000 miles to help murder, kill, and burn other people to simply help continue the domination of white slavemasters over dark people the world over. This is the day and age when such evil injustice must come to an end.” “Why should they ask me to put on a uniform and go ten thousand miles from home and drop bombs and bullets on brown people in Vietnam while so-called Negro people in Louisville are treated like dogs and denied simple human rights?” ১৯৬৪ সালে Nation of Islam এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৭৫ সালে সুন্নি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর একদিন এক রেস্টুরেন্টে কালো বলে খাবার দিতে না চাওয়ায় তিনি তাঁর অলিম্পিক পদককে ওহাইয়ো নদীতে ছুড়ে মারেন। যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য, যুদ্ধ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য মোহাম্মদ আলীর চ্যাম্পিয়ানশীপ টাইটেল কেড়ে নেওয়া হয়। তারপরও তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি তিনবারের বিশ্ব হেভীওয়েট চ্যাম্পিয়ান।

১৯৯৯ সালে Sports Illustrated দ্বারা Sportsman of the century এবং BBC দ্বারা Sports personality of the century নির্বাচিত হোন। মোহাম্মদ আলী পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকে তিনি যখন মশাল প্রজ্জ্বলন করেন, তাঁর হাত ভীষণভাবে কাঁপছিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে এক সময়ের বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ান, যুদ্ধ বিরোধী, Civil Rights- এর তীব্র সমর্থক এবং প্রেরণাকারী খুব কষ্ট করে অলিম্পিকের মশাল জ্বালাচ্ছেন- অলিম্পিকের ইতিহাসে এরকম আবেগময় দৃশ্য খুব কমই দেখা গেছে। চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা।

মোহাম্মদ আলী আটলান্টা অলিম্পিকে মশাল জ্বালাচ্ছেন আজ এই হিরোশিমা দিবসে (লেখাটা পোস্ট করার সময় অবশ্য ৭ তারিখ হয়ে গেছে) শ্রদ্ধা জানাই সেই ফিনিক্স পাখি ইয়োশহিনোরি সাকাইকে, প্রার্থনা করি পৃথিবী যেনো আণবিক/পারমাণবিক/রাসায়নিক নামক বোমা/অস্ত্রের জঞ্জাল মুক্ত হয়, পৃথিবী যেনো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য হয়ে উঠে। আজ এই হিরোশিমা দিবসে শ্রদ্ধা জানাই সেই যুদ্ধ বিরোধী মহান ব্যক্তি মোহাম্মদ আলীকে আর প্রার্থনা করি পৃথিবী থেকে সমস্ত যুদ্ধ যেনো শেষ হয়, পৃথিবীর ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেনো আর যুদ্ধের বিভীষিকা দেখতে না হয়। (ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.