আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অলিম্পিকের গল্পঃ হপ, স্টেপ এন্ড জাম্প!

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” জেমস বি কননোলী ১৮৯৫ সাল। আমেরিকার বিশ্বখ্যাত হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলো ২৬ বছরের এক যুবক। যুবকটি পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও খেলাধুলাতেও কম যায় না। এর আগে ফুটবল এবং সাইক্লিং- এ নিজেকে জড়িয়ে পড়াশোনার অনেক ক্ষতি করেছিলো। এমনিতেই আয়ারল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আসা তার দরিদ্র জেলে বাবার জন্য সে যখন বোঝা হয়ে উঠতে লাগলো, তখনই সে আবার পড়াশোনায় ফিরে এসে হাভার্ডে ভর্তি হয়ে গেলো।

কিন্তু কথায় আছে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে! সেই রকম অবস্থা হলো যুবকটির। আবার খেলাধুলায় নিজেকে উজাড় করে দিতে লাগলো। এবার আর ফুটবল আর সাইক্লিং নয়। খেলতে লাগলো হপ, স্টেপ এবং জাম্প। আরে বাবা! এটা আবার কি খেলা! হপ, স্টেপ এবং জাম্প! বোঝা গেলো – এটি ট্রিপল জাম্প।

এতো খেলা থাকতে হঠাৎ করে ট্রিপল জাম্প নিয়ে লিখতে বসলাম কেনো? আর যুবকটিই বা কে? বলছি, তার আগে অন্য কথা- ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন- এই লোকটিকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। এমনিতেই আর দুইদিন পর লন্ডন অলিম্পিকের শুরু, আর কেউ আধুনিক অলিম্পিকের জনকের নাম জানবে না, তা কি করে হয়! যা হোক, এই লোকটি যে অলিম্পিক কমিটি গঠন করলেন, সেটার সদস্যরা ঠিক করলেন আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর বসবে ১৮৯৬ সালে, প্রাচীন অলিম্পিক বন্ধ হবার প্রায় ১৫০০ বছর পর, অলিম্পিকের জন্ম স্থান গ্রীসের এথেন্সে। এবার আবার সেই যুবকটির কাছে ফিরে যাই। হপ, স্টেপ এবং জাম্প করতে করতে ১৮৯৬ সালে ট্রিপল জাম্পে সে আমেরিকার জাতীয় চ্যাম্পিয়ান হয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, সে জাতীয় রেকর্ডও করে ফেললো।

তাই যখন ঠিক হলো ১৮৯৬ সালের এথেন্স অলিম্পিকে অংশগ্রহন করতে আমেরিকা থেকে একটি দল যাবে, তখন সে ঠিক করলো, সে-ও এই দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু বাঁধ সাধল হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন। অলিম্পিকে যাওয়ার দুইমাস আগে কননোলী যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন করে, ডিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। ওহ হো, কনলোলী কে! কননোলী হলো সেই যুবকটি, যার পুরো নাম হলো, জেমস ব্রেন্ডেন বেন্নেট জেমি কননোলী, সংক্ষেপে জেমস বি. কননোলী। যাক, যা বলছিলাম, ডিন কননোলীর ছুটির আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন, এবং তাঁকে জানান যে, তাঁর একমাত্র উপায় হচ্ছে হাভার্ড থেকে পদত্যাগ করে, খেলা শেষ করে পুনরায় ভর্তির জন্য আবেদন করা।

কননোলীর জবাব কি ছিলো, সেটা তাঁর নিজের ভাষাতেই আমরা শুনি, "I am not resigning and I’m not making application to re-enter. I’m getting through with Harvard right now. Good day!" হাভার্ড তো ছেড়ে দিলো কননোলী, কিন্তু এবার দেখা দিলো আরেক সমস্যা। এথেন্সের প্রথম অলিম্পিকে অংশগ্রহন করার জন্য আমেরিকা থেকে যারা যাবে, তাদেরকে বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবের নামে যেতে হচ্ছিলো, কারণ তখনো আমেরিকান সরকার অফিসিয়ালি অলিম্পিকে কোন দল পাঠানোর কথা চিন্তা করেনি। কননোলীকে কে পাঠাবে? শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, সাফল্ক এথলেটিক্স ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করবে কননোলী, কিন্তু যাওয়া আসার খরচ সব দিতে হবে তাকেই। তাই সই! তাও তো যাওয়া হচ্ছে এথেন্সে! অবশেষে জার্মান ফ্রেইটার বারবারোসাতে করে আমেরিকার প্রথম অলিম্পিক দলের ১৪ জন সদস্যের একজন হয়ে নেপলসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন কননোলী। কিন্তু ইটালির নেপলসে আসার পর কননোলী ডাকাতের কবলে পরলেন, চুরি হয়ে গেলো নেপলস থেকে এথেন্সে যাওয়ার ট্রেনের টিকেট।

বিপর্যস্ত কননোলী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করলেন, ডাকাত ধরা পরলো, ট্রেনের টিকেট উদ্ধার হলো। এবার আবার যাত্রা শুরু করলেন, ট্রেনে করে, এথেন্সে দিকে। কিন্তু ততদিনে বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ দিন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে গেলো! অবশেষে এথেন্সে এসে পৌছালেন কননোলী। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়! কননোলীর হয়েছে ঠিক তাই। সেই সময়ের গ্রীক ক্যালেন্ডার যে আমেরিকান ক্যালেন্ডার থেকে অনেক এগিয়ে! তাই এথেন্সে পৌঁছেই কননোলী জানলেন, অলিম্পিক খেলা শুরু হয়ে গেছে, এবং প্রথম ফাইনাল খেলাই হচ্ছে ট্রিপল জাম্পের! কননোলী খেলার জন্য মাঠে গেলেন।

এবার আবার আরেক ঘটনা! কননোলী ট্রিপল জাম্পের হপ, স্টেপ এবং জাম্প- এই ভার্সনটা খেলতেন। অলিম্পিকে দেখা গেলো, খেলা হচ্ছে হপ, হপ এবং জাম্প! হপ, স্টেপ এন্ড জাম্প এবং হপ, হপ এন্ড জাম্পের মধ্যে পার্থক্য কি- আমি জানি না, শুধু এইটুকু জানি, এই অবস্থায় যে কোনো খেলোয়াড়ের মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরার কথা। কিন্তু কননোলী সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় (সেতো বোঝাই গেছে, যখন খেলার জন্য হাভার্ড ছেড়ে দিয়েছিলন)। হপ, হপ এবং জাম্প- এই ভার্সনে তিনি ছেলেবেলায় খেলতেন, সেও অনেকদিন হয়ে গেছে। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে প্রতিযোগিতার শেষ প্রতিযোগী হিসেবে জাম্পিং ল্যান্ড মার্কের দিকে এগিয়ে গেলন কননোলী।

তারপর তো ইতিহাস! ১৩.৭১ মিটার দূরত্ব লাফ দিয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ১ মিটার বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ণ পদক জয় করেন কননোলী। উহ! আল্লাহ কি শুরু করেছে! কননোলী তো স্বর্ণ পদক পান নি! পেয়েছেন রৌপ্য পদক। কারণ, আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরে কোনো স্বর্ণ পদক দেওয়া হয়নি, বিজয়ীদের দেওয়া হয়েছিলো রৌপ্য পদক। আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ন পদক বিজয়ী আমেরিকার জেমস বি কননোলী যা হোক, আসল কথা হলো, আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম বিজয়ী হিসেবে কননোলীর নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেলো। এবার কিছু সোজা ভাষার কথা- এথেন্স অলিম্পিকে কননোলী আরও দুটি পদক পান- হাইজাম্পে দ্বিতীয় এবং লংজাম্পে তৃতীয়।

সে বছর আমেরিকার ১৪ জন প্রতিযোগী মোট ১১ টি স্বর্ণ পদক পেয়ে পদক তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে। স্বাগতিক গ্রীস পেয়েছিলো ১০ টি স্বর্ন পদক। দেশে ফেরার পর তাঁর শহর বোষ্টনের অধিবাসীরা তাঁকে সোনার ঘড়ি উপহার দেয়। কননোলী পরবর্তী আসর ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকেও অংশগ্রহন করেছিলেন। সেবার তিনি ট্রিপল জাম্পে দ্বিতীয় হোন।

খেলাধুলা থেকে অবসর নিয়ে ১৯১২ সালে প্রগ্রেসিভ পার্টির হয়ে কংগ্রেসের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন কননোলী, কিন্তু পরাজিত হোন। পরবর্তীতে তিনি লেখক হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি প্রায় ২৫ টির মতো উপন্যাস এবং ২০০ টির মতো ছোট গল্প লিখেছিলেন। কননোলী আর কখনো হাভার্ডে ফিরে যাননি। কিন্তু ১৯৪৯ সালে হাভার্ড থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দেওয়া হলে তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

এই মহান ব্যাক্তি, আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম চ্যাম্পিয়ান, ১৯৫৭ সালের ২০ জানুয়ারি ব্রুকলিনে ৮৮ বছর বয়সে মারা যান। (ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.