“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক। জার্মানিতে তখন হিটলারের শাসনকাল। জার্মান রক্তকে বিশুদ্ধ আর্য রক্ত মনে করা হিটলার অলিম্পিককেই বেছে নিলেন জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জায়গা হিসেবে। গঠন করা হলো চারশ সদস্যের জার্মান অলিম্পিক দল। এই চারশ জনেরই একজন ছিলেন লুজ লং।
লম্বা, ব্লন্ড চুল আর নীল চোখের অধিকারী লুজ লং ছিলেন হিটলারের খুব প্রিয়পাত্র। পেশায় আইনজীবী, কিন্তু নেশায় লং জাম্পার, ২৫ বছর বয়স্ক লুজ লং তখন ইউরোপ সেরা। অপেক্ষা করে আছেন দীর্ঘ লাফে বিশ্বরেকর্ডধারী আফ্রিকান- আমেরিকান জেসি ওয়েন্সের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ের।
বার্লিন অলিম্পিকের প্রথম দিনে হিটলার শুধুমাত্র জার্মান পদক বিজয়ীদের সাথেই হ্যান্ডশেক করেন, অন্যদেরকে এড়িয়ে যান। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত কারো সাথেই হ্যান্ডশেক না করার সিদ্ধান্ত নেন হিটলার (তাকে বলা হয়েছিলো, হয় সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে হবে, নতুবা কারো সাথে নয়)।
তাই ১৯৩৬ সালের ৩রা আগস্ট (অলিম্পিকের দ্বিতীয় দিনে) জেসি ওয়েন্স যখন ১০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ন পদক জয় করেন, হিটলার তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক করেন নি। উপরন্তু জঙ্গল থেকে উঠে আসা কালো লোকদের উত্তরসূরি জেসি ওয়েন্সের ব্যাপারে স্পষ্টতই যুগপতভাবে বিস্ময় এবং বিরক্তভাব প্রকাশ করেন (আফ্রিকান – আমেরিকানদের ব্যাপারে হিটলারের এরকমই ধারনা ছিলো)। হিটলার আশা করলেন, পরের দিন ৪ঠা আগস্ট লং জাম্পের প্রতিযোগিতায় তার প্রিয়পাত্র লুজ লং জেসি ওয়েন্সকে হারাবেন।
৪ঠা আগস্ট। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত লং জাম্পের বাছাই পর্ব শুরু হলো।
জেসি ওয়েন্সের প্রথম লাফ বাতিল হলো, কারণ লাফ দিতে গিয়ে যে লাইন থেকে লাফ দিবে সেই লাইনে পা লেগে গিয়েছিলো। এরপর প্রাকটিসের ভঙ্গিতে একটি লাফ দিলেন ওয়েন্স। কিন্তু বিচারকরা এটাকে দ্বিতীয় লাফ হিসেবে বিবেচনা করে এটাকেও বাতিল ঘোষণা করলেন। আর মাত্র একটি লাফের সুযোগ পাবেন। এটি ঠিকমতো না হলে ফাইনাল পর্বেই উঠতে পারবেন না বিশ্বরেকর্ডধারী।
ঠিক এই সময়েই জেসি ওয়েন্সের দিকে এগিয়ে এলেন লুজ লং। পরিচিত হলেন জেসি ওয়েন্সের সাথে। শেষে বললেন, লাফ দেবার মার্কিংটা একটু পিছিয়ে নিয়ে সেখান থেকে লাফ দিতে; তাহলে লাইনে আর পা লাগবে না। পরামর্শটা মনে ধরলো ওয়েন্সের, সেই মতো লাফও দিলেন। এবার আর এটা বাতিল হলো না, উঠে গেলেন ফাইনাল পর্বে।
বার্লিন অলিম্পিকে জেসি ওয়েন্সের লাফ
ফাইনাল পর্ব শুরু হবার আগেই স্টেডিয়ামে সদলবলে আসলেন হিটলার। স্টেজে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন লং জাম্প এরিয়ার দিকে। প্রথমেই জেসি ওয়েন্স এগিয়ে গেলেন। তিনি লাফালেন ২৫ ফুট ১০ ইঞ্চি দূরত্ব। লুজ লং ব্যর্থ হচ্ছিলেন এই দূরত্ব অতিক্রম করতে, আর ওদিকে ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন হিটলারও।
অবশেষে পঞ্চম লাফে লুজ লং ওয়েন্সের সমান দূরত্ব স্পর্শ করলেন। হিটলারের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শেষ লাফে ওয়েন্স ২৬ ফুট সাড়ে ৫ ইঞ্চি লাফালেন। লুজ লং এবার আর এই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারলেন না।
জেসি ওয়েন্সের পালকে আরেকটি স্বর্ন পদক যোগ হলো। হিটলারের নীল রক্ত আবারো পরাজিত হলো জঙ্গল থেকে উঠে আসা কালো মানুষের কাছে!
দীর্ঘ লাফের বিজয়ী স্তম্ভে পিছনে লুজ লং এবং মাঝে জেসি ওয়েন্স
প্রতিযোগিতা শেষে সবার আগে লুজ লং-ই এগিয়ে গেলেন ওয়েন্সের দিকে, অভিবাদন জানালেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরলেন। স্টেজ থেকে স্থির চোখে হিটলার সেটা দেখলেন। যেনো তার চোখের সামনেই তার প্রিয় খেলোয়াড় তার মিথ্যা আভিজাত্যের দেয়ালকে ভেঙ্গে দিলো। লুজ লং যেনো হিটলারকে বুঝিয়ে দিলেন, সাদা- কালো- নিগ্রো যেই হোক, পৃথিবীর সব মানুষের রক্ত লাল, পৃথিবীর সব মানুষ সমান।
মানবিকতা বিরোধী হিটলারের সামনে যেনো লুজ লং এক অসাধারণ মানবিক বোধেরই পরিচয় দিলেন। জয় হলো অসীম সাহসিকতার, জয় হলো মানবিকতার, জয় হলো মনুষ্যত্বের।
অনেক পরে এই সম্পর্কে জেসি ওয়েন্স বলেন, "It took a lot of courage for him to befriend me in front of Hitler. You can melt down all the medals and cups I have and they wouldn't be a plating on the 24-karat friendship I felt for Luz Long at that moment. Hitler must have gone crazy watching us embrace.”
শুধু লুজ লং-ই নয়, বার্লিনের মানুষেরাও জেসি ওয়েন্সে ভীষণভাবে সংবর্ধিত করলো। বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ১১০০০০ দর্শক দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। রাস্তায় বা যে কোনো জায়গায় ওয়েন্সকে দেখা গেলেই দর্শকরা ছুটে যেতেন অটোগ্রাফ নেবার জন্য।
৫ই আগস্ট ২০০ মিটার দৌড়েও ওয়েন্স জয়লাভ করেন। এবার করেন অলিম্পিক রেকর্ড। এখানেই ওয়েন্সের অলিম্পিক ইতিহাস শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হলো না সেই জার্মান আভিজাত্যবোধের কারণেই। আমেরিকার ৪X১০০মিটার রিলে দৌড়ে ইহুদী থাকায়, জার্মান উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা আমেরিকার অলিম্পিক দলের অফিসিয়ালদের অনুরোধ জানায়, ইহুদী খেলোয়াড়দের পরিবর্তন করতে।
ফলে দলে ঢুকে পড়েন ওয়েন্স এবং ৯ই আগষ্ট আরেকটি স্বর্ণ পদকপ্রাপ্তির মাধ্যমে অলিম্পিক অভিযান শেষ করেন।
অলিম্পিক শেষে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার পরও জেসি ওয়েন্সের সাথে লুজ লং- এর বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্রও আদান- প্রদান হতো। লুজ লং-কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে হয়। এই যুদ্ধেই আহত হয়ে ইংরেজ অধিকৃত হাসপাতালে ১৯৪৩ সালের ১০ই জুলাই লুজ লং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
দুই বন্ধুঃ লুজ লং এবং জেসি ওয়েন্স
১৯৬৪ সালে জেসি ওয়েন্স ১৯৩৬ সালের পর আবার বার্লিনে যান। দেখা করেন লুজ লং-এর ছেলের সাথে। ছেলেকে জানান তার বাবার সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা। বিশ্ববাসীকে বলেন, জেসি ওয়েন্সের কাছে লুজ লং-এর শেষ চিঠিতে লেখা সেই অমর উক্তি- "Someday find my son ... tell him about how things can be between men on this Earth."
(ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।