মায়ের মাস্কটা হাত দিয়ে সরিয়ে মায়ের মুখে চুমু দিল। মা দুবার শ্বাস নিয়েই যেন নিজেকে শ্বাস নেয়ার প্রয়োজন থেকে ছুটি দিল!
২০০০!
নাতির বড় বড় চোখ পাতলা নাক গালে হালকা টোল দেখে নানার মন আর ভরেনা।
২০০৮!
মিসেস আব্বাস বা তাদের মেয়ে টিনা কেউই কিছু বললো না।
কারন ভালো মন্দ তারা এখন যাই বলুক এতে আব্বাস সাহেব ইতস্ত করবেন।
আব্বাস সাহেব কিছু না বলেই দরজা খুললেন এবং পিছনে একবারও না তাকিয়ে দরজা টেনে দিলেন।
আব্বাস সাহেব যতটা সম্ভব আওয়াজ না করে সিরি বেয়ে দ্রুত নেমে যেতে চেষ্টা করলেন।
টিনার যখন মনে হল যে তার বাবা এতক্ষনে নিচে নেমে গিয়েছেন, তখন সে এগিয়ে যেয়ে দরজার ছিটকানিটা লাগিয়ে দিল।
আব্বাস সাহেব নিচে নেমেই রিক্সা ডেকে জায়গার নাম বলেই দ্রুত রিক্সায় উঠে পরলেন।
রিক্সাটাওয়ালা একজন যাত্রী পাওয়াতে বেশ দ্রুত চালাতে লাগলো। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রিক্সাটা থামিয়েই রিক্সাওয়ালা বলল স্যার! আইয়া পরছি।
আব্বাস সাহেব যেন কোন এক ঘোর থেকে রিক্সাওয়ালার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন! আব্বাস সাহেব রিক্সা থেকে নেমে কমিউনিটি সেন্টারে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখা মাত্র জামাল সাহেব এগিয়ে গেলেন। তিনি এক রকম যেন মুখ ফসকে আব্বাস সাহেকে জিজ্ঞাসা করলেন 'কেমন আছেন'?
আব্বাস সাহেব আছতে করে বললেন 'ভালো'।
সোমার বিয়েতে সব কিছু স্বাভাবিক রাখার জন্যেই অনেক আত্মীয় স্বজনকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, কাছের সবায় মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে ওকে খুসি দেখতে চাইছে ও যেন কিছু বুজতে না পারে যে তার জীবনটা কত দুঃখজনক অতিতে ভেজা,আজ সোমার বিয়ে!
২০০৪!
আব্বাস সাহেব দাড়িয়ে আছেন,চোখের পানি হাত দিয়ে হালকা করে মুছলেন। জামাল সাহেব তার হাত ধরে বলছেন আল্লাহ খালাম্মাকে দীর্ঘায়ু করেছিলেন।
রোগ শোক শ্বাস কষ্টে আরও কষ্ট না দিয়ে আল্লাহ তাকে নিয়ে গেছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেন খালাম্মাকে তিনি জান্নাত নসিব করেন। আব্বাস সাহেব ধীরে মাথাতা নাড়ালেন।
২০০৬!
আজ জামাল সাহেব ও আব্বাস সাহেব দুজনই কাদছেন। তাদের আজ বড় অসহায়ের কান্না।
তাদেরকে কেউ এগিয়ে যেয়ে যে সান্তনা দিবে এই টুকু মানসিক সাহসও কারো মাঝে অবশিষ্ট নেই। এই কান্নার ভিড়ে ঘরের ভিতর একটি হাসির দমকা আওয়াজ ভাসছিল যেন কোন বাচ্চা মেয়ে সরল আনন্দে খিল খিল করে হাসছে। সবায় ভয়ার্ত চোখে সোমার দিকে চেয়ে আছে, আজ যে সে এই প্রথম হাসছে!
২০০৮!
আজ সোমার বিয়ে! আব্বাস সাহেবের দৃষ্টি বরের দিকে পরতেই তিনি আর সহ্য করতে পারলেননা। দ্রুত হেটে জামাল সাহেবের দিকে যেয়ে তার হাত আলতো টেনে বললেন মেয়েটাকে দোয়া করবো। জামাল সাহেব চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ধীরে হেটে সোমার কাছে নিয়ে গেলেন আব্বাস সাহেবকে।
আব্বাস সাহেব সোমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করতেই সোমা মৃদু কণ্ঠে বলে উথলো চাচা ভালো থাকবেন। এই কথায় চমকে যেয়ে আব্বাস সাহেব ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকলেন সোমার দিকে! তারপর সম্বিত ফিরে পেতেয় আব্বাস সাহেব জামাল সাহেবের হাতটি চাপরে দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।
আব্বাস সাহেব কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হয়ে বিভ্রান্তের মত হাটতে লাগলেন। যেই ব্যাপারটি তিনি ভাবতে চাননা বা ভাবতে আশ্চর্য রকম ভাবে ভয় পান আজ সেই ভাবনাটাই তার মাথায় চেপে বসেছে।
সেদিন,সেইদিন সময়টা ২০০৬! বৌমাকে খাইয়ে সজল কেন যে মধ্য দুপুরে ছাদে হাটতে গেল! পুলিশ বলছিল একতলা ছাদ থেকে পরেছে তাও বেশ দূরে পরেছিল যেন সজল দৌরে যেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল।
আব্বাস সাহেব মিলাতে পারেননা দৌরে লাফ দিবে কেন? তাও এক তলার ছাদ থেকে! সজল কি কাউকে ছাদ থেকে পরে যাওয়া রক্ষা করতে দৌর দিয়েছিল?
২০০৯!
সোমা হাসপাতালের ব্যাডে শুয়ে আছে। সবার মুখে আনন্দ।
যখন জামাল সাহেব নাতিকে কোলে নিলেন কিন্তু একটু খেয়াল করতেই চমকে উথলেন সদ্যজাত নাতির চেহারা দেখে। তিনি যেন একটি চেহারায় আরেকটি চেহারা দেখতে পেলেন। বড় বড় চোখ পাতলা নাক এমনকি গালে হালকা টোলের মত মনে হচ্ছে।
এটাকি বুড়ো বয়সের চোখের বিভ্রম! বিভ্রম হলেই মঙ্গল!
২০১৩!
সোমাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নেয়া হয়েছে। সোমার কি হয়েছে কোন ডাক্তার কিছুই বলতে পারছেনা। সোমাকে বেশ বয়স্ক মনে হচ্ছে! টিনা এতো দিন পরেও তার হারানো ভাবিকে মনে রেখেছে সে এসেছে তার অসুস্থ ভাবিকে দেখতে। সোমাদের ফ্লাটে ঢুকতেই সে চমকে উঠলো সোমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে দেখে। এতো দেখতে হুবহু তাদের বাবুর মত।
সেই বড় বড় চোখ পাতলা নাক এমকি গালে হালকা টোল! ঘরময় দৌড়চ্ছে এবং হাতে একটি প্লেন!
টিনার চমকে যাবার পালা তখনো শেষ হয়নি আরও চমকে গেল যখন সে তার ভাবিকে দেখলো। ভাবিকে এমন বুড়ো মনে হচ্ছে কেন? ভাবির মুখে মাস্ক। ভীষণ শ্বাস কষ্ট। টিনা সোমার বিসানার কাছে বসে তার হাতটা চেপে ধরে ঝিম ধরে রইলো। আর তখনি তার মনের ভিতর সেই ভয়ংকর সৃতিটা জেগে উঠলো।
সময়টা ২০০৫! তার সোমা ভাবি মাছ কাতছিল হথাত কোথা থেকে বাবু হাতে একটি খেলনা প্লেন নিয়ে দৌরে এসে হুমড়ি খেয়ে পরলো ঠিক মাছ কাটা বটিটার উপর। চোখের সামনে নিজের সন্তানের এই অবস্থা দেখে সোমা ভাবি ভারসাম্যহিন হয়ে পরলো। এরপর সে যাকেই দেখতও আতঙ্কে শিউরে উঠতো, সবার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। নিজে থেকে কিছু খেতে চাইতোনা। যতক্ষণ না সজল ভাইয়া জোর করে খাইয়ে দিতেন।
ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে সেই ভাবি বছর এক পরে স্বাভাবিক হয়ে গেল! কিন্তু সজল ভাইয়া, তাদের সন্তান বাবু বা আমাদের কারো কথাই তার সৃতিতে অবশিষ্ট রইলোনা। তার এই অবস্তা আমাদের জন্য ছিল অত্তন্ত হৃদয় বিদারক।
সিয়াম প্লেন হাতে দৌরে মায়ের ঘরে ঢুকলো তার মার মুখে মাস্ক। বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছে, অদ্ভুত। সিয়াম তার প্লেনটি মায়ের বিছানায় রেখে।
মায়ের মাস্কটা হাত দিয়ে সরিয়ে মায়ের মুখে চুমু দিল। মা দুবার শ্বাস নিয়েই যেন নিজেকে শ্বাস নেয়ার প্রয়োজন থেকে ছুটি দিল! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।