সমস্যা কার?
আমার স্ত্রীর।
তিনি কোথায়?
তাকে বাসায় রেখে এসেছি।
মনো চিকিৎসকদের আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। আজ নিতান্ত ঠেকায় পড়ে এখানে আসতে হয়েছে।
সমস্যা যেহেতু আপনার স্ত্রীর, তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত।
আপনি যেহেতু এসেছেন, সব কিছু ডিটেইলস বর্ণনা করবেন। কোন খুঁটিনাটি বাদ দেবেন না। অনেক সময় দেখা যায় অনেক অপ্রোয়জনীয় বর্ণনাও অনেক কাজে আসে।
টুকন ছিল আমাদের একমাত্র মেয়ে, বয়স মাত্র তিন বছর।
ছিল মানে?
দুই মাস আগে মারা গেছে।
আমাদের বাড়ির পেছনে ছোট একটা ডোবা আছে, তাতে ডুবে মরেছে। সমস্যার শুরু মূলত তার পর থেকেই। আমার স্ত্রীর ধারনা, তার মেয়ে মরেনি, যে কোন সময় ফিরে আসবে।
হয়ত রাতে ঘুমিয়ে আছি, আমার স্ত্রী হঠাৎ করে মাঝরাতে ডেকে তুলে বলবে, অ্যাই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, টুকন বাইরে বৃষ্টিতে ভিজছে। মেয়েটা ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারে না।
চলো এক্ষুণি গিয়ে তাকে নিয়ে আসি।
টুকনকে আমাদের বাড়ীর পেছনেই কবর দেয়া হয়ে ছিল। সারা রাত আমাকে আর ঘুমুতে দেবে না, এ যন্ত্রনা চলতেই থাকবে।
প্রথম প্রথম মনে করে ছিলাম এ সমস্যা সাময়িক, সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সমস্যা আরও বাড়ছে।
আমার সামনে বসা ডাক্তার এতণ খুব মন দিয়ে আমার প্রতিটা কথা শুনছিলেন।
এবার মুখ খোলেন-আচ্ছা, আপনি বলছেন আপনার স্ত্রীর ধারণা, তার মেয়ে মরেনি। মেয়েটা যেহেতু আপনাদের দুজনের, তাই আমাদের মেয়ে না বলে আমার স্ত্রীর মেয়ে কেন বলছেন?
আপনাকে আসলে বলা হয়নি- এক রোড এক্সিডেন্টে টুকনরে বাবা মারা গেলে তার মার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে।
আই সি, আপনি আপনার বর্ণনায় বলেছেন, টুকন পানিতে ডুবে মরেছে- এমন ভাবে কেন বলছেন।
এতটুকু একটা বাচ্চা মাত্র দু মাস আগে যার মৃত্যু হয়েছে, এত বড় একটা ঘটনার বর্ণনা আপনি খুব সহজ ভাবে দিচ্ছেন । আপনাকে সামান্যতম আবেগপ্রবণও মনে হয়নি। কেন? আমার ধারণা, অবশ্য ঠিক না-ও হতে পারে।
আমি কিছুণ চুপ করে থাকি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেই সত্য কথাটাই বলব।
এ ছাড়া এখন কোন উপায়ও নেই।
টুকনের মার সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন টুকন ছিল তার গর্ভে। সবকিছু জেনেই আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম। কারণ, আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। তখন আমি তাকে পৃথিবীর যে কোন কিছুর বিনিময়ে পেতে রাজী আছি।
সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল। ঝামেলা শুরু হয় মূলত টুকনের জন্মের পর থেকে।
আমার স্ত্রী হঠাৎ করে বদলে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তার সবটুকু অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই টুকন।
প্রতিটি মুহূর্তে সে টুকনকে নিয়েই ব্যস্ত। তার চারপাশে যেন আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমার স্ত্রীর প্রতি আমার এত দিনের জমানো ভালোবাসা এক সময় আমার কাছে অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে। আমি টুকনের প্রতি এক ধরণের ঈর্ষা অনুভব করতে থাকি। এই ঈর্ষার উৎস কোথায় আমি জানি না।
যে দিন টুকন মারা যায়, সেদিন আমি আমাদের বাসার ছাদে দাঁড়ানো ছিলাম। ছোট্র বাচ্চা খেলতে খেলতে এক সময় ডোবার কাছে চলে যায়। তারপর পা পিছলে ডোবায় পড়ে যায়। আমি ইচ্ছে করলে তুনি দৌঁড়ে গিয়ে হয়তো তাকে বাঁচাতে পারতাম, কিন্তু তখন মাথায় ভূত চেপে গেছে। আমার তখন শুধুই মনে হচ্ছিল যত নষ্টের গোঁড়া হচ্ছে এই বাচ্চাটা।
আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে। আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার উপর।
আমার চোখের সামনেই টুকন ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। ডাক্তার, আপনি হয়ত এর জন্যে আমাকেই দায়ী করবেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন এর জন্যে আমি দায়ী নই, আমার অন্ধ ভালোবাসাই দায়ী।
আপনার স্ত্রীর সমস্যা কি তার পর থেকেই শুরু হয়?- ডাক্তার গম্ভীর গলায় একেকটা শব্দ উচ্চারণ করেন।
উত্তর দিতে আমি এক মুহূর্ত চিন্তা করি। তারপর ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করি এতদিন আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে আসলে আমার নিজেকে নিয়ে। আমার স্ত্রীর মতো এখন আমিও টুকনকে দেখতে শুরু করেছি। হয়ত রাতে আমি আমার বেডরুমে শুয়ে আছি, হঠাৎ করে আমার মনে হবে টুকন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি সারা রাত ঘুমাতে পারি না। রাতের পর রাত জেগে বসে থাকি।
এখন অবস্থা এমন হয়েছে, আমার স্ত্রী ধীরে ধীরে টুকনকে ভুলতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্যেও টুকনকে ভুলতে পারছি না। প্রতিটি মুহূর্ত টুকনের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফেরে।
প্লিজ ডাক্তার আপনি আমাকে এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বাঁচান।
(কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী (আমি নাম বলতে চাচ্ছি না) আছেন যারা প্রায় সময়ই দৈহিক ভালোবাসার কথা বলে থাকেন, এ ছাড়া নাকি ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। এটাকে আমার কাছে একটা নোংরা ব্যাপার বলে মনে হয়। মাফ করবেন, কারো ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ভালোবাসায় দৈহিক আকর্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু এটা না থাকলে ভালোবাসাও থাকবে না, এ কেমন কথা।
দাম্পত্য জীবনে একসময় বার্ধক্য আসবে, কমে যাবে দৈহিক আকর্ষণ, তাহলে কি তখন আর ভালোবাসা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না।
দেহ এক সময় নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ভালোবাসা কি কখনও নষ্ট হয়। এ জন্যেই হয়ত বলা হয় মানুষ মরে যায় কিন্তু বেঁচে থাকে তার ভালোবাসা।
সত্যিকারের ভালোবাসা হওয়া উচিত এমন যার জন্যে অেপক্ষা করা যায় অনন্তকাল ধরে।
ভালোবাসা সম্ভবত একেক জনের কাছে একেক রকম।
একজন দেশ প্রেমিক বলবে আমার ভালোবাসা হচ্ছে আমার মাতৃভূমি। মার কাছে ভালোবাসা তার সন্তান। শিক্ষকের কাছে তার ছাত্র। এটাইতো সত্যিকারের ভালোবাসা। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।