গন্ত্যবের শেষ পরিণতি জানা নেই......... বিগত ২০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত সত্য, ‘মারাত্মক অপুষ্টির সফল বিকল্প, গৃহচিকিৎসা’। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, মারাত্মক অপুষ্টির চিকিৎসায় বাড়িতে রান্না করা খাবারই সফল। অপুষ্টির চিকিৎসার নামে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত খাবার অগ্রহণযোগ্য। আসুন আমরা একে ‘না’ বলি।
বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত রোগনিরাময়কারী ও পরিপূরক খাবার কৃত্রিম ও পুষ্টিগত দিক থেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
ঘরে তৈরি খাবারের সমশক্তিমানের এ সব খাবারের দামও ১০ গুণ বেশি। অথচ এগুলো পুষ্টিসমৃদ্ধ নয়, সংস্কৃতিগতভাবেও তা অগ্রহণযোগ্য।
এছাড়া বর্তমানে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যা দিয়ে গুঁড়া দুধ জীবণুমুক্ত খাবার হিসেবে তৈরি করা যায়। শিশুর অপুষ্টি ও মৃত্যুর কারণে বিশ্বে গুঁড়া দুধ ‘বেবি কিলার’ হিসেবেও পরিচিত।
গুঁড়া দুধ শিশুদের অপুষ্টি ও মৃত্যুর কারণ
তিন মাস বয়সী ৫ কেজি ওজনের শিশু মায়ের দুধ না খেয়ে যদি গুঁড়া দুধ খায়, তাহলে প্রতিমাসে খরচ হবে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা।
যা গরিব দেশে সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ধোঁকায় পড়ে টিনের চাকচিক্য দেখে ৫০০ টাকায় যদি ৪৫০ গ্রামের গুঁড়া দুধের টিন কিনে যদি পাঁচ কেজি ওজনের শিশুকে খাওয়ানো হয়, তাহলে মাত্র তিন দিনে তা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পাতলা করে এই গুঁড়া দুধ খাওয়ালে শিশুটির ওজন কমতে থাকবে। মারাত্মক অপুষ্টির শিকার হবে। দীর্ঘদিন এভাবে চালালে শিশুটির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়া গুঁড়া দুধে রোগ সংক্রমণ হয় সবচেয়ে বেশি। এতে ডায়রিয়ার জীবাণু সংক্রমণও হয় খুব তাড়াতাড়ি। ফলে গরিব পরিবারে, এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারেও শিশুর মৃত্যু ঘটে। মনে রাখতে হবে, গুঁড়া দুধ প্রস্তুত ও বাজারজাত হয় বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। এটি শিশুর জন্য নিরাপদ নয়।
গুঁড়া দুধ জীবাণুমুক্ত নয়
সরকারের প্রচারপত্রের সূত্র মতে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, গুঁড়া দুধ জীবাণুমুক্ত নয়। এটি জীবাণু বাড়ানোর সহজাত মাধ্যম।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও কৃষি সংস্থা ২০০৪ সালের তথ্যমতে, শিশু গুঁড়া দুধ (ইনফ্যান্ট ফরমুলা) কোনো জীবাণুমুক্ত খাবার নয়, এর মধ্যে জীবাণু থাকতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যা দিয়ে গুঁড়া দুধ একটি জীবণুমুক্ত খাবার হিসেবে তৈরি করতে পারে। যুক্তরাজ্যের একটি দুধের কোম্পানি তাদের গুঁড়া দুধের টিনের লেবেলে লিখে দিয়েছে শিশুদের গুঁড়া দুধ জীবাণুমুক্ত খাবার নয়।
অপরদিকে বাংলাদেশেও কনডেন্স মিল্কের কৌটায় লেখা রয়েছে, এটি শিশুদের জন্য নয়। তবে চায়ের স্টলে বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানির কনডেন্স মিল্ক তাদের ব্যবসা ধরে রেখেছে।
অপুষ্টিজনিত শিশু মৃত্যু
এদেশে প্রতিদিন পাঁচ বছরের নিচে ২৪০ জন শিশু অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে। এর মূল কারণ মায়ের দুধ ও ঘরের পরিপূরক খাবার সঠিকভাবে না দেওয়া। অপরদিকে কত শিশু যে গুঁড়া দুধ খেয়ে মারা যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই।
গুঁড়া দুধ বেবি কিলার
১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্যের নিউ ইন্টারনালি ম্যাগজিন এক সংখ্যায় প্রচ্ছদ কাহিনীতে শিশুদের গুঁড়া দুধকে ‘শিশু ঘাতক’ (বেবি কিলার) বলে অভিহিত করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ১৯৭৯ সালে সঠিকভাবে শিশুদের মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবার সংরক্ষণ, উন্নয়ন সহায়তার জন্য জেনেভায় ১৫০টি দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্মেলন করে। এই সম্মেলনে গুঁড়া দুধ বাজারজাত প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিষদে (এসেমব্লিতে) বাজারজাত প্রক্রিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী (কোড) গ্রহণ করে। বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে গুঁড়া দুধ বাজারজাত করার ওপর অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদে তা আইন হিসেবে পাস হয়। অথচ রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও বাজারজাত হচ্ছে গুঁড়া দুধ।
গুঁড়া দুধ কোম্পানিগুলোর ধ্বংসাত্মক বাজারজাত পদ্ধতি
দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও গুঁড়া দুধের কোম্পানিগুলো আইনের মূল নীতির তোয়াক্কা না করে আক্রোশপূর্ণ পদ্ধতিতে বাজারজাত প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে, স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রে, ক্লিনিকে, চিকিৎসকের চেম্বারে, নার্সদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নানা ধরণের উপহার দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। গুঁড়া দুধের নাম ছাপিয়ে মায়েদের বণ্টনের জন্য লিফলেটও দেয় তারা।
অভিজাত হেটেলে চিকিৎসকদের জন্য সেমিনার করে উপঢৌকন দেয়, খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থাও করে। চিকিৎসাপত্রে লিখে নিয়ে বিক্রি বাড়ানোর জন্য এগুলো করে কোম্পানিগুলো। আর এতে সমর্থনও দেন চিকিৎসকসহ অনেকে পেশাজীবী।
চিকিৎসকসহ পেশাজীবীদের গুঁড়া দুধের কোম্পানিগুলোকে সমর্থন স্বার্থের জন্য
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে পেশাজীবীদের গুঁড়া দুধের কোম্পানিগুলোকে সমর্থন তাদের স্বার্থের জন্য। বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ ২০১২ স্মরণিকায় বলা হয়, কিছু সংস্থা, চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিদরা গুঁড়াদুধের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ফান্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা ও সেমিনারে অংশ নেয়।
দুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পেশাজীবীদের স্বার্থের জন্য শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সঠিকভাবে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হারে (%) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বহু চিকিৎসক তাদের প্যাডে দুধের প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। অথচ এটা বেআইনী।
মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবারই যথেষ্ট
মায়ের দুধ পরিপূরক একটি জৈবিক তরল দ্রব্য।
যার মধ্যে ২০০টির বেশি উপাদান রয়েছে। যা কোনো প্যাকেটজাত খাবারে বা গুঁড়া দুধে থাকতে পারে না। এছাড়া শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিপূরক খাবার হিসেবে মায়ের দুধের পাশপাশি বাড়িতে রান্না করা সাধারণ খাবার শিশুকে উপযুক্ত করে দিলে সঠিকভাবে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সম্ভব।
তাছাড়া প্যাকেটজাত খাবার ও গুঁড়া দুধ রোগ সংক্রমণ মুক্ত নয়। কৃত্রিম খাবারে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিসহ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।
কৃত্রিম খাবার পরিণত বয়সে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ, এবং ক্যান্সার ও অপটিওপোরোসিস হতে পারে। মায়ের দুধই কেবল এগুলো থেকে রক্ষা করতে পারে।
অন্যদিকে মায়ের সুস্থ থাকার জন্য শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে উদ্যোগী হতে হবে। এতে মা স্তন ক্যান্সার, ডিম্বকোষের ক্যান্সার থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবেন।
বেবি কিলার হিসেবে পরিচিত গুঁড়া দুধ ও বাণিজ্যিক শিশু খাবারে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ বছর দেশে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে।
গত ১ আগস্ট শুরু হয়েছে এ সপ্তাহ পালন। আসুন আমরা বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত শিশু খাদ্য ও গুঁড়া দুধকে সবাই ‘না’ বলি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।