আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান-তারুন্যের চলমান রাজনীতিবিমুখতার বিপরীতে একটি সুস্থ্য রাজনৈতিক সামাজিকায়নের জন্যই জরুরি

munirshamim@gmail.com শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ-’র ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবিতে গত ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনে নেমেছে। ইতোমধ্যে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই এ আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা আশা প্রকাশ করেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টির গুরুত্ব আন্তরিকভাবে উপলব্দী করবেন। ২৯ জুলাই এর আগেই ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু ২৯ তারখি গত হতে চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় র্কতৃপক্ষ এখনো সে ডাকে সাড়া দনেন। বিগত ২২ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। প্রত্যাশা অনুযায়ী সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ডাকসু নির্বাচনের দাবি তোলার কথা ক্যাম্পাসে সক্রিয় প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। বিশেষ করে বড় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু সে ভূমিকা পালনে তারা শতভাগ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

এমনকি সংগঠন দু’টির নিয়মিত কর্মসূচিতে সাধারণ ছাত্রদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত কোন বিষয় রয়েছে বলে নিকট ইতিহাসে তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বরং রাজনৈতিক কোন্দল, হল দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অরাজনৈতিক ও অপকর্মের জন্য সংগঠন দু’টি কুখ্যাতি অর্জন করেছে। জাতীয় রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি এবং দায়বোধের কারণে লাল-গোলাপি-সাদা ইত্যাদি রঙের ব্যানারে পরিচালিত শিক্ষক রাজনীতির নেতৃবৃন্দকেও নিকট অতীতে ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। স্বাভাবিক কারণেই শেষ পর্যন্ত প্রাণের তাগিদে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই ডাকসু নির্বাচনের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি তাঁদের এ যৌক্তিক দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন জানাই।

আন্দোলনের উদ্যোগকে অভিনন্দিত করি। একই সাথে চলমান আন্দোলনটি বিপুল সমর্থন নিয়ে একটি অহিংস প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তার উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা রেখে দু’একটি কথা বলতে চাই। ডাকসু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে নয়, সারা দেশের ছাত্র রাজনীতির জন্য ছিল একটি গভীর আগ্রহের জায়গা। জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব ছিল অসামান্য। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০- এ রকম আমাদের জাতীয় জীবনের ও রাজনীতির প্রতিটি মাইল ফলকে, প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি পট পরিবর্তনে ডাকসুর ইতিবাচক ভূমিকা ছিল অনুকরণীয়।

এ ডাকসুর কারণেই আমাদের জাতীয় রাজনীতি পেয়েছিল অনেক সক্রিয়, কর্মনিষ্ঠ এবং ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা। নাম উল্লেখ না করেই বলা যায় আজকের জাতীয় রাজনীতিতে এখনও যে ক’জন সক্রিয়ভাবে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং অনুকরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের বেশির ভাগই ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। সুতরাং আগামী দিনের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি এবং ভবিষ্যত রাজনীতিকে চলমান ব্যবসায়ী-সামরিক-বেসামরিক আমলা নির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখবার স্বার্থেই শুধু ডাকসু নির্বাচন নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি। যা তরুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ্য রাজনৈতিক সামাজিকায়নের পথ উন্মোচিত করবে বা করতে পারে। বিগত ২২ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মতো অনেকের মধ্যেই এ রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে না পারার জন্য ডাকসু নির্বাচনে ভোটার অথবা প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে না পারার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায় ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মত প্রকাশ করতে না পারার কারণে এখনও আফসোস কাজ করে। তার জন্য কাকে দায়ি করবো? অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে আমরা যে তিনজন সম্মানিত শিক্ষককে পেয়েছিলাম- অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমদ এবং অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ন্যুনতম উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। পাশাপাশি তখনকার ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দও এর জন্য কম দায়ী নয়। সে সময় ছাত্র দল ও ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল দখল ও নানা অরাজনৈতিক কর্মকান্ডে যতখানি সময় বিনিয়োগ করেছেন তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ সময় নিয়েও যদি ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হতেন আমরা শান্তনা খুঁজে পেতাম। অন্তত বলতে পারতাম ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতজানু আচরণের জন্য ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে নি।

বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ডাকসু নির্বাচনের দাবিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে, গণদাবিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছে-এমন উদাহরণ আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। আমাদের সে সৌভাগ্য হয়নি। আজকের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অনেককেই হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি ভয়াবহ রকম খারাপ জিনিস-এ রকম অনুসিদ্ধান্তে পৌছে ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিতও করতে চান। সবাইকে ছাত্র রাজনীতি থেকে দুরে থাকার ওকালতিও করেন।

কোন কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ মূলফটকে তাদের প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ ছাত্র রাজনীতিমুক্ত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বিজ্ঞাপনও দেন। বড় দলের লেজুড়বৃত্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির অপরাজনৈতিক সংস্কৃতিকে, বিশেষ করে শিবির-ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের অপকর্মকে সমস্ত ছাত্র রাজনীতির গায়ে মেখে দিয়ে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যান। ভুলে যান আজকের বাংলাদেশ যেটুকু ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার আলোকিত পথচলায় ছাত্র রাজনীতির রয়েছে একটি গৌরবমাখা অবদান। অনেকের মতো আমিও ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতে চাই যে, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ এবং কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশিত জবাবদিহিতা কেবল শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ্য রাজনৈতিক সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া ও ইতিবাচক বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমেই সম্ভব হবে। আর তার জন্য চাই নির্দিষ্ট মেয়াদে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বর্তমান ভিসি গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, এ আন্দোলন ভেতরের শিক্ষার্থীদের নয়, বাইরের কারও। ভিসির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে হাত উচু করে তাদের পরিচয়পত্র তুলে ধরে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। মাননীয় ভিসি, আপনি গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। শিক্ষার্থীরা আপনার সন্তানের মতো। আপন সন্তানদের পরিচয় অস্বিকার করা পৃথিবীর কোন সংস্কৃতিতেই শোভনীয় হিসেবে বিচেচিত হয় না বলেই আমরা জানি এবং মানি।

এর আগে আপনার একজন অগ্রজ ভিসি আন্দোলনরত ছাত্রীদের গার্মেন্স এর কর্মী বলে আখ্যায়িত করেছিল। মাননীয় ভিসি তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নিলাম এটি বহিরাগতদের আন্দোলন, কিন্তু আপনিই বলুন, ডাকসু নির্বাচনের দাবি যৌক্তিক কি না? যদি যৌক্তিক না হয় তার ব্যাখ্যা কি? আর যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে তবে আপনি কেন ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিচ্ছেন না? যখনই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রসঙ্গ উঠেছে আমরা মাননীয় ভিসিকে, আপনাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টিভি টকশোতে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে জোরালো মত দিতে দেখেছি। মাননীয় ভিসি যদি সত্যি সত্যি ছাত্র রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল থাকেন তবে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া কীভাবে সুস্থ্য রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করা যাবে সে প্রশ্নটিও খুব প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের সামনে আসে। আমরা খুব বিনয়ের সাথে বলতে চাই, কেন্দ্র ও হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ছাত্র রাজনীতিকদের প্রাথমিকভাবে ভোটের জন্য হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, শ্রদ্ধা ও জবাবদিহিতা তৈরির পথ উন্মোচিত হবে, তারা নিজেদের আচরণের গুণগত পরিবর্তনের প্রতি আন্তরিক হবেন, উদ্যোগী হবেন। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তাদের কাজের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবে।

আজকের তরুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির প্রতি যে অনাগ্রহ তার বিপরীতে একটি সুস্থ্য রাজনৈতিক সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া চালু হবে এবং তা বজায় থাকবে। যা রাজনীতির সামগ্রিক গুণগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তার আগে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মেরুদন্ড সম্পন্ন প্রশাসন। যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি নতজানু হয়ে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিকার অভিভাবক হয়েই মেরুদন্ডটা শক্ত করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াবেন। নির্বাচনের উদ্যোগ নিবেন।

নির্বাচন সহায়ক নিরপেক্ষ এবং ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় সকল সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। ডাকসু নির্বাচন হয়ে উঠবে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কাঙ্খিত অনুষ্ঠান। ডাকসু আবার হয়ে উঠবে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি বিকাশের ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। যেমনটি আগেও ছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.