আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাকসু নির্বাচনঃ আত্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের পূর্বপুরুষের শিক্ষা

শব্দ খুঁজি, সৃষ্টির অদম্য নেশায় বেশ কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল। পুরনোদিনের কথা। বছর চারেক আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছিলাম একটি স্বপ্নের ঘোরে। যখন নামী ডিগ্রি হাতিয়ে মোটা মাইনের চাকুরির সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে অনাগত সুসময়ের কথা অলস রাখালের মতো ভেবে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম তখনকার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে অলংঘ রহস্যের মতো মনে হতো।

অনেকটা ইনকাদের কথিত এল ডোরাডোর মতো। এই স্বর্ণ শহরের একজন হওয়ার আশায় দিন রাত চোখ-মুখ গুঁজে থাকতাম বইয়ের পাতায়। আকাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হওয়ার পর ক্যাম্পাসের এগলি-ওগলি গ্রাম্য মেলার চরকির মতো পরিভ্রমণ শুরু করেছিলাম। আমার বড্ড ভালোবাসার জিনিস ইতিহাস। ডাকসুর হলুদ ভবনটার এক চিলতে একটা কক্ষ আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গৌরব-অগৌরবের চিত্রিত সংকলন ডাকসু সংগ্রহশালা। এর চৌকাঠ পেরিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম পূর্বসূরীদের কীর্তি। তাঁদের হেঁটে আসা পথের নিঃশব্দ অনুসরণে ভেতরে ভেতরে শিহরণের উত্তাপে প্রজ্জ্বলিত হতাম গৌরবের উত্তরাধিকারে। এই স্বপ্নযাত্রার ইতিহাস যাতে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মযন্ত্রণা তার অনেকটাই আসলে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে’র আশ্রিত অভয় উদ্দীপনায় সাধিত। ডাকসু শুধু একটি সংগঠনের নামই না, বরং একটি জাতির উদ্ভব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

স্বাধীনতার উপ্ত স্বপ্নের বিস্তার যখন প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে আসা মানব বিরোধী অনুঘটকগুলোর প্রাধান্যে পুরনো দুঃস্বপ্নের ছদ্মবেশে বিষণ্ণ নীলের বিস্তারে বাস্তবতা আস্বাদিত করাচ্ছিল তখনও ডাকসুকে কেন্দ্র করে দেশের সমগ্র শিক্ষাবৃত্তে জ্ব্লেছে আশার আশ্বস্তকারী প্রদীপ। সেই প্রদীপের তীক্ষ্ণ কিরণ শিখা চিরন্তনীর মতো ঝড় ঝাপটা এড়িয়ে পুরো দেশকে করেছে আলোকিত। ভূ-রাজনৈতিক অভিঘাতের অতলান্তিকতা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে গ্রাম্য কুলবধূর অনুচ্চারিত অসহায়ত্বে। ফলাফল বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, তারুণ্যের উত্থানের ষাটের দুঃসহ দশক, একাত্তরের রক্ত-বিজয়ের উপাখ্যান, স্বৈরাচারীর পতনসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসের অনেকটাই। ডাকসু নির্বাচন কী তবে শুধু দেশের রাজনীতির জন্য প্রয়োজন? রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরীর ইশকুল? মোটেই তা নয়।

ডাকসু নির্বাচন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার ত্রিশেক ছাত্রের আইনানুগ প্রতিনিধিত্বের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্যাম্পাসে দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র-ছাত্রীর সহাবস্থানের জন্য। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুগত ছাত্র সংগঠনগুলোর একচেটিয়া আধিপত্যে হলগুলোতে নিয়মমাফিক আবাসিক চরিত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। দরকার বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের জমাট কর্ণকুহরে প্রবেশ করাতে। ডাকসু নির্বাচন দরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি প্রতিহত করতে।

নাকউঁচু স্বেচ্ছাচারীতাকে বাই বাই বলে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলতে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠন প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে। দরকার আবাসিক হলের অপরিসর কক্ষের অমানবিক বসবাসের ইতি ঘটাতে। ডাকসু নির্বাচন চাই, কারণ বুদ্ধিবৃত্তির বিকলঙ্গতা আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠানটিকে পিছিয়ে দিচ্ছে দিন দিন। আগামী ১৯ জুলাই ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট।

এই ধর্মঘটের সমর্থনে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো ক্যাম্পাস। সে পোস্টারে বিপ্লবী লালের উপস্থিতি ধর্মঘট আহ্ববানকারী ‘শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’কে দিয়েছে বাম দলের তকমা। মাথার ভিতর পুঁজিবাদি শুঁয়োপোকার রোমশ উপস্থিতি অনেকের মনে জন্ম দিয়েছে অব্যক্ত অসোয়াস্তির। ভুলে গেলে চলবে না এই আন্দোলন আমাদের নিজেদের স্বার্থে। এই আন্দোলন ক্ষমতাবানের পরম্পরার অচলায়তন ভাঙ্গার আন্দোলন।

শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের এই ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলুপ্ত গৌরবের ঝান্ডা পুনঃস্থাপিত প্রয়োজন এই ধর্মঘট। অনাগত প্রজন্মান্তরে অধিকার সচেতনতার বালিশ পাচার করতে প্রয়োজন এর পক্ষে অবস্থান নেয়া। হয়তো এই আন্দোলনের প্রবলতা পোঁছে দেবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। অসচেতনতা-অসাম্য-স্বেচ্ছাচারীতার গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের কিছু করতে হবে।

হাত গুটিয়ে লক্ষ্ণীবাবুটি সেজে বসে থাকলে আর কিছু দিন পর গৌরবের ইতিহাসগুলো শীতের অলস সন্ধ্যায় শোনা ঠাকুরমা’র রূপকথার মতো শোনাবে। এই অশান্ত সময়ে প্রয়োজন কিছু দস্যি ছেলে-মেয়ের। তাদের বাম ছাত্র সংগঠনের সদস্য হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। আমিও নিজেও তাদের একজন নই! ছবি কৃতজ্ঞতাঃ নিউ এজ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.