আজো আমি চাই কষ্ট পেয়ে কেউ কেউ নষ্ট হয়ে যাক ছোট একটা ঘর্, এক পাশটা ভেজা স্যাতস্যাতে, ফ্যান টা চলছে ঘটাং ঘটাং শব্দ করে, ঘরে জিনিস বলতে একটা টেবিল যার উপর একটা ঘড়ি আর একটা বেড্।
ক্রিং ক্রিং করে বিশ্রী ভাবে বেজে চলেছে এলার্ম ঘড়িটা। চোখ বন্ধ করেই নাইম ভাবছে এলার্ম ঘড়ি না যেন কোন এক বিরাটাকায় কুত্সিত দর্শন মহিলা তার কানের কাছে চিল্লাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটা আছাড় দিয়ে ঘড়িটার নাড়ি ভুড়ি বের করে দিতে।
৭টা বাজে, উঠতে হবে, ৮টায় বের হতে হবে ৯টায় অফিস।
পৃথিবীর সব বিরক্তি নিয়ে উঠে পরলো নাইম। এলার্ম টা বন্ধ করে সোজা চলে গেল টয়্লেটের দিকে, ব্রাশ করে গোসল করে রেডি হলো আর অনুভুতিহীন ভাবে খেয়ে নিল পাশের দোকান থেকে দিয়ে যাওয়া তেল চুপচুপে পরোটা আর রাতের বাসি ভাজি। দোকানের মালিক মানিক মিয়া ইচ্ছে করেই এমনটা করে তাও কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না নাইমের , কি হবে বলে!
নিত্তদিনের মতো দীর্ঘ লাইন তারপর ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠা অফিসে যাওয়া কিংবা ঘামে গোসল করে নিজের এক রুমের আস্তানায় ফেরা কোনকিছুতেই যেন কিছু মনে হয় না নাইমের্, ভালো লাগা নেই, নেই কোন খারাপ লাগাও। অফিসেও মাথা নিচু করে কাজ করে যায় শুধু, কলিগদের সাথে নেই সম্পর্ক ও এমনকি হাই হ্যালো ও না, কারন সে এমন ই, অসামাজিক।
প্রতিদিনের মতোই দীর্ঘ লাইন তারপর বাসের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থেকে আজকেও অফিসে যাচ্ছে নাইম্, আশেপাশের মানুষজন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছে।
নাইম অবাক হয়ে ভাবে এতো কি নিয়ে কথা বলে, কথা বলার টপিকস ই বা পায় কথায়্, এতো আগ্রহ পায় কোথায় সবাই!
অফিসে পৌঁছেই প্রতিদিনের মত নিজের জায়্গায় বসে মাথা নিচু করে কাজ শুরু করলো নাইম্। অনেকগুল অডিটের রিপোর্ট কম্প্লিট করতে হবে, বস বলে দিয়েছে আজকেই তার চাই! 'ভটকা ঁহোদল কুতকুত' বসকে গালি টা দিয়ে কাজে মন দিলো নাইম্। হঠাত কই থেকে যে আলো এসে পরলো মুখের উপর আবার চলে গেল। আধুনিক অফিস কাঁচের বিল্ডিং, আলো আসতেই পারে কোথাও থেকে এই ভেবে আবার কাজ করতে লাগলো কিন্তু একটু পরেই বারবার মুখে পরতে লাগলো আলোটা। এমনিতেই ভালো লাগেনা কিছু তারউপর এই রকম ঝামেলা, বেশ বিরক্ত মুখেই দেখার জন্য সামনে উকি দেয় নাইম, দেখে তার ঠিক বিপরীত বিল্ডিংএর যে অফিস তাতে জানালার পাশে বসে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইল দেখছে একটি মেয়ে, আর সেই ফাইলের কভার থেকেই আলো রিফ্লেক্ট হয়ে তার মুখে পরছে! 'সুন্দর তো মেয়েটা!' ভাবলো নাইম্, এক্টু তাকায় আবার চারিদিক্টা দেখে নেয় কেউ তাকে দেখছে নাকি! মেয়ে টার সাথে চোখাচোখি হলো একবার দুবার এবং বেশ কবার্, প্রতিবার ই নাইম সাথে সাথেই অন্য কিছু এক্টা করার ভান ধরল কিন্তু মেয়েটা তো আর ফিডার খায় না! একটা সময় মেয়েটা একটা কাগজে সাইন পেন দিয়ে লিখে দেখাল 'আপনি কি আমাকে হাই বলতে চাচ্ছেন?' 'এ কেমন আজব মেয়েরে বাবা!' ভাবতে ভাবতে বিব্রত হয়ে লিখে জানায় 'কই নাতো!' মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে, নাইম আরও বিব্রত হয়ে যায় আর এক সময় খেয়াল করে সে বোকার মতো হা করে মেয়েটার হাসি দেখছে।
তারপর?
তারপর, একদিন দুইদিন এভাবে কাগজ আর সাইনপেন দিয়ে চলতে থাকে কথা, সাথে যোগ হয় নানা রকম দুষ্টুমি আর ছেলেমানুষি!
নাইমের ও কেন জানি ইদানিং সবকিছু একটু অন্যরকম লাগা শুরু হয়েছে, সবকিছু আর আগের মতো বিরক্ত লাগে না এখন, সকাল বেলার ক্রিং ক্রিং আওয়াজটা যেন মনে করিয়ে দেয় কারো কথা, হোটেলের খাবার গুলো আগের মতো আর বিস্বাদ নেই এমনকি বাসের জন্য লম্বা লাইন কিংবা বাসে মানুষ জনের অনর্থক কথা গুলো ও শুনতে ভালো লাগে কেন জানি! আর অফিসেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এখন ভালো ই আড্ডা জমায় নাইম! অনেকেই অবাক নাইমের এই হঠাত চেইঞ্জ দেখে, নাইম নিজেও অবাক তবে সে জানে কারন টা।
নাইম বুঝতে পারছে একটা মানুষ তার জীবনকে অন্যরকম করে দিয়েছে। একটি মেয়ে যার সম্বন্ধে বলতে গেলে সে কিছুই জানেনা! শুধু প্রতিদিন ছোটো ছোটো কিছু চিরকুটে অনেক ছেলেমানুষি করা হয়, দুষ্টুমি হয়, ভালোলাগার কথা হয়। কিন্তু নাইমের মাঝে তো মেয়েটা আরেকটু বেশি জায়গা করে নিয়েছে! কোথায় যেন মেয়েটাকে একটু বেশিই অনুভব করে নাইম, কিন্তু কিভাবে জানাবে তাকে এখন ও যে সাহস করে নাম টাই জানা হয় নি তার!
অবশেষে ঠিক করে নাইম এভাবে আর না, সামনা সামনি কথা বলবে মেয়ে টার। যা হবার হবে তাই বলে নিজের ভালো লাগাকে এভাবে নষ্ট হতে দিবে না সে।
অনেক কিছু ভেবে সারাটা রাত পার করলো নাইম, ঠিক কি বলবে মেয়েটাকে? নাম? নাহ এতদিন পরে এসে এখন নাম জিজ্ঞাসা করা যায় না। তাহলে? উমমম হুম! পাশের ব্ল্যাক চিলি কফি শপে আসতে বলা যায়!সামনা সামনি অনেক কথাই নিজের মতো করে বলা যাবে তাহলে।
পরদিন সকালে নাইমের অফিসে। অনেকক্ষণ থেকেই মেয়েটা নেই, তাহলে কি আজকে আসেনি? নাকি নাইম ই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে? আরেকটু দেখা যাক। নাহ নেই তো! আরে! ওর জায়গাটাতে একটা বদখত দেখতে লোক বসলো! মানে কি!
একদিন যায় দুই দিন যায় কিন্তু নাহ নাইমের ভালোলাগার মানুষটাকে আর দেখতে পায় না নাইম।
কি হল কোথায় গেলো নাইম কিছুর ই হিসেব মিলাতে পারেনা, তার জীবন টা যেন আবার আটকে গেছে আবার যেন পুরানো সেই নাইম ভর করছে!
আবার ঘড়িটা বাজছে নাইমের বুকটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে উঠে কি অদ্ভুত একটা শূন্যতা ভর করে তার মাঝে, নিতান্তই অনিচ্ছায় রেডি হয়ে নাস্তার কিছুটা মুখে দিয়ে বেরিয়ে পরে অফিসে, অফিসে যাওয়া আসা এবং এর মাঝের সময়টা শুধু মেয়েটার কথাই মনে হয়, কেন চলে গেলো এভাবে না বলে?
আবার পুরানো সব অনুভুতি পুরানো সব কিছু আর পুরানো সেই নাইম, এভাবেই চলতে থাকে।
হঠাত একদিন অফিসে কাজ করছিলো নাইম এই সময়ে তার মুখে আলো এসে পড়লো, বুকটা কেঁপে উঠলো নাইমের, তাহলে কি? আর ভাবতে পারে না নাইম, নিজের বুকের ভিতরের ধুকধুকানি শব্দ টা যেন মাথায় গিয়ে আঘাত করছে। কই নাতো কেউ তো নেই ওই জায়গাটাতে ওই লোকটাই তো, তাহলে? ভাবতে ভাবতেই আবার আলো এসে পড়লো মুখে। এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর বুঝল আলো টা আসছে উপর থেকে। আরে! ওই তো মেয়েটা!নাইমকে ডাকার জন্যই ইচ্ছে করে আলো মারছিল মুখে! নাইম কে দেখে সুন্দর করে হাসল! হুম কি যেন লিখছে মেয়েটা, নাইম ও কাঁপা কাঁপা হাতে তাড়াতাড়ি করে লিখল “কোথায় ছিলে? :” মেয়েটাও লিখেছে “ আমার প্রমোশন হয়েছে, তাই এখানে আর অফিসের কাজে হঠাত করে বাইরে যেতে হয়েছিলো ”
উফ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নাইম, যেন প্রান ফিরে পেল নুতন করে! আর দেরি করলো না নাইম লিখল “ বিকাল টাতে চা খেতে পারি একসাথে ব্ল্যাক চিলি তে!’
পুরোপুরি অফিস পাড়া এটা তাই বিকালের এই সময় টাতে রাস্তায় ভিড় থাকেই, নাইম সেই ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে তার খুব পরিচিত এক অপরিচিতার কাছে।
ভিড়ের মাঝেই দেখতে পায় মেয়েটি আসছে, বিকালের ওই পড়ন্ত রোদের আলোয় কি সুন্দরই না লাগছে ওকে!
রাস্তার ঠিক মাঝখানে দুজন দুজনের সামনে দাঁড়ালো, নাইম কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই ওকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি একটা কাগজ বের করলো যাতে লিখা “হাই! আমি এঞ্জেলিকা!” খুব মিষ্টি করে হাসল এঞ্জেলিকা, অদ্ভুত মায়াভরা সে হাসি! নাইম এঞ্জেলিকার হাতটা শক্ত করে ধরল যাতে ভিড়ে হারিয়ে না যায়।
বিকেলর আলোটা মিইয়ে যাচ্ছে, তবে কিভাবে যেন একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ঘিরে থাকলো সব খানে।
(গল্পটি একটি বিদেশী শর্ট ফিল্ম 'সাইন' এর ভাবানুবাদ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।