আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবর্তন এর সরল পাঠঃ বিবর্তন কী এবং কিভাবে কাজ করে?


আমরা অনেকেই বিবর্তন সম্পর্কে জানি বা শুনি। অনেকে এর কথা শুনেই আঁতকে উঠি, ভালো করে না জেনে এর সম্পর্কে অনেক মন্তব্য করি। আসুন দেখি জিনিসটা আসলে কী। বিবর্তন বুঝতে হলে কয়েকটি জিনিস সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে আগে। এগুলো আগে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করছি।

কোষঃ কোষ হচ্ছে প্রাণী বা উদ্ভিদের শরীরের ক্ষুদ্রতম গাঠনিক অংশ। বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক অণু দিয়ে কোষ গঠিত। আমাদের জীবন ধারণের জন্যে যাবতীয় জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া এই কোষে ঘটে থাকে। আমরা মারা গেলে কোষে আর কোনো কিছু ঘটেনা এবং কোষে রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেমে গেলে আমরা মারা যাই। ডিএনএঃ ডিএনএ হচ্ছে কোষ এর মধ্যে থাকা একটা জৈব-রাসায়নিক অণু।

প্রাণীর জীবন-ধারণের জন্যে, বংশধারা রক্ষা এবং প্রজনন সক্ষমতার জন্যে এ অণুটির ভূমিকা অপরিসীম। একটা প্রাণীর সকল শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্য এই ডিএনএ নামক অণুতে সংরক্ষিত থাকে। যেমন ধরুণ কেউ লম্বা হবে না বেঁটে হবে সেটা এই ডিএনএ এর একটা অংশের উপর নির্ভর করে। ডিএনএ এর এই অংশকে বলে জিন। জিনঃ জিন হচ্ছে কোষে অবস্থিত ডিএনএ এর অংশবিশেষ যেটিতে দেহের জন্যে দরকারী প্রোটিন তৈরি করার কোড (তথ্য) থাকে।

এই কোড আসলে কিছু রাসায়নিক অণুর (ফসফেট, সুগার, এবং বেইস) ক্রমাণুমিক অবস্থান ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রাসায়নিক অণুগুলো কিভাবে সন্নিবেশিত আছে তার উপর নির্ভর করে কোষে প্রোটিন তৈরি হয়। সবচেয়ে দরকারী প্রোটিনটির নাম হচ্ছে এনজাইম। কোষে যতো ধরণের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া হয় তার সবকিছু সম্ভব হয় এনজাইম এর উপস্থিতির কারণে। শরীরে কী ধরণের প্রোটিন তৈরি হচ্ছে সেটির উপর ভিত্তি করে প্রাণীর শারীরিক বৈশিষ্ট নির্ধারিত হয়।

কোনো ডিএনএতে যদি শরীরকে লম্বা করার জন্যে দরকারী জিন না থাকে তাহলে লম্বা হওয়ার জন্যে যে প্রোটিন দরকার সেই প্রোটিনটি তৈরি হবেনা এবং ফলস্রুতিতে সেই শরীরটি লম্বা হবেনা। অর্গানিজম/মাইক্রোওর্গানিজমঃ যেকোনো ধরণের ক্ষুদ্রাকৃতির (অণু সদৃশ) প্রাণী/উদ্ভিদ কে মাইক্রোওর্গানিজম বলে। যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি। বিবর্তন এর সংজ্ঞাঃ বিবর্তন হচ্ছে বিভিন্ন প্রানী এবং উদ্ভিদের শারীরিক অবস্থায় ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যাকারী তত্ত্ব। বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর সকল প্রানী এবং উদ্ভিদ একটা এক-কোষীয় মাইক্রোঅর্গানিজম থেকে এসেছে।

সবচেয়ে প্রাচীন মাইক্রোঅর্গানিজম এর ফসিল যেটি পাওয়া গিয়েছে সেটি প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগের (এর মানে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার প্রায় এক বিলিয়ন বছর পর এটার সৃষ্টি হয়েছে)। এই মাইক্রোঅর্গানিজম থেকে বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদ এর উৎপত্তি বিবর্তন ব্যাখ্যা করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন এই এক-কোষীয় মাইক্রোওর্গানিজমটি কিভাবে এসেছে সেটা বিবর্তনের বিষয় নয়। কিন্তু সেটারও সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিয়েছে । এই প্রাচীনতম মাইক্রোঅর্গানিজম থেকে গতো কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে প্রাণী এবং উদ্ভিদের মধ্যে ঘটে যাওয়া শারীরিক পরিবর্তন বিবর্তন ব্যাখ্যা করে।

কিভাবে এতো হাজার হাজার রকমের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর উদ্ভব হলো সেটি বিবর্তন ব্যাখ্যা করে। বিবর্তন যেভাবে কাজ করেঃ বিবর্তন কাজ করে দুইটি প্রধান উপায়ে। এর একটি হচ্ছে ডিএনএ পরিবর্তন(mutation), এবং আরেকটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection)। ডিএনএ পরিবর্তনঃ জীবকোষে অবস্থিত ডিএনএ মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়। ডিএনএ যেহেতু আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে, তাই এর পরিবর্তন হওয়া মানে আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হওয়া।

প্রধানত দুটি কারণে ডিএনএ এর মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারেঃ ১। কোষ বিভাজনের সময় সময় ডিএনএ এর প্রতিলিপি তৈরি করার সময়, এবং ২। তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ, অতিবেগুনি রশ্মি ইত্যাদি কারণে বাইরের পরিবেশের রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে ডিএনএতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এই পরিবর্তনগুলোর উপর যেহেতু আমাদের হাত নেই তাই ডিএনএ এর যেকোনো অংশে (জিনে) এই পরিবর্তন হতে পারে। আর জিন যেহেতু আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দেয়, তাই জিনের এই পরিবর্তন আমাদের শরীরকে প্রভাবিত করে।

ডিএনএ এর এমন পরিবর্তন আমাদের জন্যে উপকারী হতে পারে আবার অপকারীও হতে পারে। উদ্ভিদ এবং প্রানীর শরীরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই সেটার কারণ হচ্ছে এই ডিএনএ অর্থাৎ জিন এর পরিবর্তন। প্রাকৃতিক নির্বাচনঃ ডিএনএ পরিবর্তন একটি র‌্যান্ডম প্রক্রিয়া। আগে থেকে জানার উপায় নেই যে কোনো পরিবর্তন ভালো, খারাপ, নাকি নিরপেক্ষ হবে। পরিবর্তনটি যদি খারাপ হয় তাহলে সেই প্রানী/উদ্ভিদ এর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।

উদাহরণস্বরুপ, কোনো বন্য পোকার গায়ের রঙ নির্ধারণকারী জিন যদি এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় যে এর গায়ের রঙ বনের লতাপাতা বা গাছপালার রঙ এর চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে যায় যেটা সহজেই এর খাদক শিকারী প্রাণীর চোখে পড়ে, তাহলে শিকারীর পাল্লায় পড়ে সে পোকাটি আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। অন্যদিকে জিনটি যদি এমনভাবে পরিবর্তন হতো যে পোকাটির গায়ের রঙ বনের অন্যান্য গাছপালা লতাপাতার রঙের সাথে মিশে যেতো যাতে পোকাটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়তো, তাহলে পোকাটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেতো। আর এভাবেই নতুন জিনটি বংশ-পরম্পরায় প্রাবাহিত হয়ে যাবে। ডিএনএ এর মাঝে জিন এর র‌্যান্ডম পরিবর্তন থেকে বেঁচে থাকার জন্যে, পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে উপকারী জিনটিকে নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটিকে বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন। লক্ষ্য করে দেখবেন, ডিএনএ পরিবর্তন এর ব্যাপারটি র‌্যান্ডম হলেও অনেকগুলি র‌্যান্ডম পরিবর্তন থেকে দরকারী বা উপকারী জিনটিই খুব যত্ন করে নির্বাচন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন।

এর মানে হচ্ছে, কোন জিনটি জীব দেহে বংশানুক্রমিকভাবে প্রবাহিত হবে সেটি খুব জেনে, শুনে, বেছে ঠিক করা হয়। আর এভাবেই জীবের বিবর্তন ঘটে আরো অধিকতর শক্তির শরীর তৈরির দিকে, দুর্বল বা অপ্রয়োজনীয় অংগগুলি আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয় কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিবর্তন নিয়ে করা প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ ১। বিবর্তন কি শুধু একটা তত্ত্ব যেটি এখনো প্রমাণিত হয়নি? উত্তরঃ বিবর্তন প্রমাণিত কিনা সেটা জানার আগে প্রমাণ ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে নেওয়া ভালো। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমাণ সবসময় গাণিতিক নাও হতে পারে।

উদাহরণস্বরুপ, বিশ্ব সৃষ্টি বিগ ব্যাং তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। বিগ ব্যাং ঘটেছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। একে কোনো গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিং ব্যাং এর পর থেকে মহাবিশ্ব কিভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, কিভাবে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ইত্যাদি কাজ করে এসবের বিভিন্ন গাণিতিক মডেল আছে। মহাবিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমূহ বিগ ব্যাং দিয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা বা বস্তু পাওয়া যায়নি মহাবিশ্বে যেটা বিগ ব্যাং দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবেনা। বিবর্তনের ব্যাপারটা তেমনি। জিনতও্ব, ফসিল রেকর্ড, বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর শারীরিক পরিবর্তন ইত্যাদি সবকিছু বিবর্তন দিয়ে খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ল্যাবরেটরিতে সীমিত পর্যায়ে বিবর্তনকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাওনি। বিজ্ঞানের কোনো সম্ভান্ত জার্নালে বিবর্তনের বিরুদ্ধে কোনো লেখা কখনো ছাপা হয়নি, বরং নেচার, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, এবং জীব বিজ্ঞানের প্রায় সব জার্নালে বিবর্তন এর পক্ষে অহরহই লেখা ছাপানো হয়।

২। বিবর্তন এর প্রমাণ কী? উত্তরঃ বিবর্তন নিয়ে করা সব ধরনের পর্যবেক্ষণ এবং এক্সপেরিমেন্ট বিবর্তনকেই সাপোর্ট করে। শত কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের সব ফসিলগুলোকে কালানুক্রমিকভাবে সাজালে পরিষ্কারভাবে বংশ থেকে বংশে ঘটে যাওয়া শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রানীর মধ্যে শারীরিক এবং জিনগত সাদৃশ্য এবং পার্থক্য থেকেও বিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ফসিল রেকর্ড দেখে যেসব প্রাণীকে অতীতে একই পুর্বপুরুষ থেকে আগত মনে করা হয়েছিলো পরবর্তীতে জিন বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে তাদের মধ্যে জিনগত মিল প্রচুর।

এর মানে ফসিল রেকর্ড সঠিকভাবে বিবর্তন এর প্রক্রিয়াকে সাপোর্ট করে। ৩। বিবর্তন কি প্রমাণ করে ঈশ্বর এর অস্তিত্ত্ব নেই? উত্তরঃ বিবর্তন আর দশটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতোই একটি তত্ত্ব। বিগ ব্যাং তত্ত্ব, মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব ইত্যাদির সাথে যেমন ঈশ্বর এর কোনো সম্পর্ক নেই বিবর্তন এর সাথেও ঈশ্বর এর কোনো সম্পর্ক নেই। ৪।

কিন্তু বানর থেকে মানুষ এসেছে এতে আমাদের মর্যাদা ছোট হয়ে যাচ্ছে না? উত্তরঃ প্রথমত, মানুষ বানর থেকে আসে নাই। মানুষ এবং বানর জাতীয় প্রাণী লক্ষ কোটি বছর আগে শিম্পাঞ্জীর মতো দেখতে একটি প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে। আর এতে আমাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা কমে যাওয়ার কিছু নেই। মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, মানুষের সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ, মানুষের চিন্তা-চেতনা অনেক উন্নত - এগুলোর কিছুই তো মিথ্যা হয়ে যাচ্ছেনা বিবর্তনের কারণে। ৫।

বিবর্তন কিভাবে সত্যি হতে পারে? প্রাণহীন নির্জীব বস্তু থেকে মানুষের মতো এতো জটিল প্রাণী কিভাবে তৈরি হতে পারে? এটা কি ঝড়ের কবলে পড়ে লোহা আর প্লাস্টিকের স্তুপ থেকে একটা বোয়িং প্লেন তৈরি হওয়ার মতো না? উত্তরঃ ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে। একটা জিনিস চিন্তা করে দেখুন, আমরা সবাই কিন্তু মায়ের পেটে একটা নির্জীব অণু থেকে মাত্র নয় মাসে একটা জটিল মানব শিশুতে পরিণত হই! সেখানে বিবর্তন ঘটেছে কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে। আর প্রাকৃতিক নির্বাচন সবসময় উপকারী পরিবর্তনটি গ্রহণ করার ফলে বিবর্তন আরো ত্বরাণ্বিত হয়। সব ধরণের পর্যবেক্ষণ যেখানে বিবর্তনকে সমর্থন করছে সেখানে শুধু "সত্যি ভাবতে কষ্ট হয়" ভেবে একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয়না। তথ্যসূত্রঃ ১।

Understanding Evolution (Click This Link) ২। How Evolution Works (Click This Link) ৩। The Greatest Show on Earth - Richard Dawkins ৪। Evolution - where we are from (http://www.pbs.org/wgbh/evolution/) ৫। Galileo's Finger - Ten great ideas of science , Peter Atkins
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।