আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবর্তন

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারই সমান রাঙা

‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি......’’ এক শান্ত বিকেলে গান শুনতে শুনতে বারান্দায় বসে গুনগুন করছিল অনু। তার হাতে নতুন কেনা গল্পের বই যা পড়ার আগে ঘ্রাণ নিয়েই খুশির আমেজে ভরে যাচ্ছে দোতলার এই একচিলতে স্বর্গ। হঠাৎ বিকট স্বরে ডাক শুনতে পাওয়া গেল- ‘পিচ্চি, পিচ্চি, এই পিচ্চি…’’ অনু রেলিঙের কাছে এসে উঁকি দিল যদিও তার কোন দরকার ছিলো না। তার সতেরো বছরের জীবনে এই একজনই তাকে আজীবন পিচ্চি বলে ডেকে এসেছে। অথচ যে ডেকেছে সে নিজে কিন্তু অনুর চেয়ে মাত্র ছয় বছরের বড়।

এই আগন্তুক হচ্ছে পাশের ফ্ল্যাটের তনয় ভাই। এই মূহুর্তে সে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং বোঝাই যাচ্ছে তার কাছে গেটের চাবি নেই। যতটাসম্ভব বিরক্তমুখে তনয় ভাই দেখলো অনুকে এবং আবার বিকটস্বরে চিৎকার দিলো- কতক্ষণ ধরে ডাকছি জবাব দিসনা কেন? অনুও মুখ বেঁকিয়ে বললো- রাস্তা থেকে চিৎকার করছো কেন? কি চাই? -কি চাই মানে? গেটের চাবি দে। ঝননন করে রাস্তায় চাবিটা ফেললো অনু এবং প্রতিবারের মত ভাবলো, একদিন চাবি মেরে এই ব্যাটার মাথা ফুটো করে দিতে হবে। সিঁড়িতে তুমুল শব্দ করে তনয় ভাই উঠে এসে অনুদের বাসার কলিংবেল চাপলো।

অনুর আম্মা দরজা খুলে দিতেই শুরু করে দিলো আলাপ। ‘স্লামালিকুম আন্টি। এই নিন আপনাদের চাবি। পিচ্চি কোথায়? সারাদিন বারান্দায় বসে থাকে কেন মেয়েটা বলেন তো? বারান্দার ওপাশে কেউ আছে নাকি? হাহাহাহা’’ অসহ্য! যত দিন যাচ্ছে ছেলেটা ততই অসহ্য হচ্ছে। অনু বারান্দায় বসে এই একতরফা কথোপকথন শুনে যারপরনাই বিরক্ত হলো এবং গানটান বন্ধ করে দিয়ে থম ধরে বারান্দায় বসে থাকলো।

ঠিক এই সময় বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে কয়েকটা পাঁপড়ি ঝরে পড়েছে যেখানে বাচ্চাদের বিকেলকালীন দুষ্টুমি চলছে। তনয় তখন নিজের ঘরে গিয়ে কবিতার খাতা খুলে বসেছে। সে মনে মনে একজন কবি। শুধু কবি না বলে সিরিয়াস কবি বলাই ভালো। এতই সিরিয়াস যে কবিতা লেখা শেখার আগে সে নিজে একটা কবিতাও লিখবে না বলে ঠিক করেছে।

এখন তার শিক্ষা পর্ব চলছে। এই পর্বের অংশ হিসেবে প্রতিদিন তার একটা করে কবিতা অনুবাদ করার কথা। আজ করছে পাবলো নেরুদার ‘Leaning into afternoons’’ ‘দূরের মানবী, তুমি কেবল অন্ধকারই রাখো কখনো তোমার কাছ থেকে দুঃখের ছায়া ভেসে আসে’’- এইটুকু লিখে থামলো তনয়। অচেনা সেই দূরের মানবীর কথা মনে করে হয়তো দীর্ঘশ্বাসও ফেললো একটা। তারপর দিন কাটলো প্রতিদিনের মত করে।

কদিন পর অনু গিয়েছে তনয় ভাইদের বাসায়। তার আম্মা নতুন একটা কি যেন রান্না করে পাঠিয়েছে ওদের জন্য। তনয় ভাইর আম্মাকে খাবারের বাটি ধরিয়ে দিয়ে সে ঢুকলো তনয় ভাইর ঘরে। অগোছালো বুকশেলফটাকে কোনমতে ভদ্রস্থ করে, দুটো বই নিয়ে, তনয় ভাইর কবিতার খাতা পড়ে মুচকি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে ফিরলো অনু। তনয় যে কোনদিনই নিজের একটা কবিতা লিখতে পারবেনা এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত।

এ নিয়ে তনয়কে খোঁচাতে কি যে মজা! এই একটা ব্যাপারেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। তার মত প্রতিভার সঠিক মূল্যায়নের অভাবেই যে দেশের ও এই অর্বাচীন বালিকার এই অধপতন তা নিয়ে বিরাট বক্তব্য দিতেও দ্বিধা করেনা। পরদিন সকালে আবার সেই কামান গর্জন! তনয় ভাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটাচ্ছে। ‘আমার বই চুরি করলো কে? পিচ্চি?’ ঘুম ঘুম অনু এসে বই দুটো হাতে দিয়ে বললো- নাও, তোমার বই খাও। জীবনেও যদি আর তোমার ঘরে ঢুকেছি! -ঘরে ঢুকবি না কেন? এখন তো তাই বলতে আসলাম।

আমার নীল পাঞ্জাবিটা খুঁজে দে না। আম্মা কি নিয়ে যেন ব্যস্ত। - পাঞ্জাবী খুঁজতে হবে তো বই বই করে চেঁচাচ্ছো কেন? - তুই যেই ঘুম দিয়েছিলি কোন কাজ করতে হবে শুনলে সেই ঘুম ভাঙ্গতো? - ঘুম ভাঙ্গলেই বা কি? পারবোনা আমি তোমার পাঞ্জাবী খুঁজতে। সকাল সকাল উনি কি এমন রাজকার্য করতে যাবেন! - দে না পিচ্চি। তুই কত্ত ভালো! আমার এপয়ন্টমেন্ট মিস হয়ে যাচ্ছে তো।

- কীসের এপয়ন্টমেন্ট? চারদিক দেখে নিয়ে তনয় ফিসফিস করে বললো- একটা মেয়ে আমাকে আজ ১০টায় নীল পাঞ্জাবী পরে বকুলতলায় থাকতে বলেছে। - কে মেয়ে? - আহা এত কথা বলছিস কেন? আছে একজন। যা যা পাঞ্জাবী খোঁজ। আমি আন্টির সাথে কথা বলে আসছি। অনু মাথা নিচু করে তনয়ের ঘরে এসে ঢুকলো।

হঠাৎ করেই কেন যেন ওর আকাশ পাতাল কান্না পাচ্ছে। অথচ এরকম হওয়ার কোনই কারণ নেই। একজন নীল পাঞ্জাবী পরা তনয় ভাইয়ের জন্য কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেই পারে। তাছাড়া নীল পাঞ্জাবী পরলে তনয় ভাইকে লাগে বিচ্ছিরি। জগতের সবকিছু পরলেই তাকে বিচ্ছিরি দেখায়।

আর যখন সে হাসে তখন তো মনে হয় বোয়াল মাছ হা করে আছে। অবশ্য তার হাসির শব্দটা সুন্দর। কিন্তু তাতে কি! এইজন্য তো কেঁদেকেটে অস্থির হওয়ার কোন মানে নেই তাইনা! ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করতে করতে তাই অনু নীল পাঞ্জাবী খুঁজলো। পেয়ে গিয়ে অবাক হয়ে ভাবলো, তার নীল চুড়ির সাথে এই রঙটা কতটা মানাচ্ছে! ভাবতে ভাবতেই তনয় ভাই ঘরে এসে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে পাঞ্জাবীটা নিলো এবং তারপর আবার ধমক- মূর্তির মত বসে আছিস কেন? যা ভাগ। অনু বাসায় এসে বারান্দায় বসে থাকলো অনেকক্ষণ।

চক্রের পান্নার কথা মনে হচ্ছিলো ওর। গায়ে আগুন না গলায় দড়ি!! এত অল্প সমস্যায় গায়ে আগুন না গলায় দড়ি ভাবতে পারে বোধহয় এই বয়সীরাই। তবু ভাবনাটা মোটেও হালকা নয়। নিজের জন্য দুঃখে করুণায় মনটা এতটুকু হয়ে আসলো। কি করবে ভাবতে ভাবতে ফিরে গেলো তনয়ের ঘরেই।

কবিতার খাতা খুলে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা কাটাকুটিতে হাত বুলালো অনেকক্ষণ। তারপর এক পৃষ্ঠায় গুটি গুটি করে লিখলো- “চোর কি জানে, চোর কি জানত, আমি তোমায় মুখস্থ পাই আদ্যোপান্ত?” প্রতিদিনকার মত ঘরে এসে তনয় কবিতার খাতা খুললো এবং লেখাটা দেখলো। লেখা দেখে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকার পর এই প্রথম তনয়ের একটা কবিতা লিখতে ইচ্ছে হলো। তাই কবিতা শিক্ষার কঠিন নিয়ম বহির্ভূত একটা কাজ সে করলো আর খাতায় লিখলো। “সেদিন ভোরে একটা শুঁয়োপোকা হাঁটলো কেমন আমার পায়ে পায়ে।

পোকাটাকে বকুনি দিয়ে গেলাম, আমাদের সেই সকাল বেলার গাঁয়ে। ঘর পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, দূরে ঘুরতে গিয়ে ভেবে ফেললাম তাকে। ‘পোকা’, শুনতে মন্দ হলেও, কেমন আদর আদর গন্ধ মাখা থাকে! গ্রামটা যখন আবার শহর হলো, দুধওয়ালাদের সাইকেলে টিংটিং, ইস্কুলে যায় ঘুমচোখ ঝুঁটিগুলো, শুরু হয়ে যায় ব্যস্ত একটা দিন। তখন আমি হেলেদুলে ফিরি আধো আলোয় ঝাপসা আমার ঘরে। তাকিয়ে দেখি একটা গহীন কোণে কি যেন কি ঝিকচিকমিক করে! হাতের উপর নিলাম তাকে তুলে।

নেড়েচেড়ে কতভাবেই দেখি! দেখে, শুঁকে, গায়ের ওপর মেখে কিছুতেই বুজছিনা যে, এ কি!! হঠাৎ বুঝি আমার হাতের উপর সাতটি রাজার রত্ন আছে রাখা। সকাল বেলার সেই যে শুঁয়োপোকা! রেখে গেছে এক প্রজাপতির পাখা’’ পরদিন আবার শুরুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তবে এবার আর তনয় বাঁজখাঁই গলায় চাবি চাইলো না আর অনুও রাস্তায় চাবি ছুঁড়ে না দিয়ে নিজেই নিচে নেমে এলো গেট খুলে দিতে। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে অনু রাগী রাগী গলায় বললো- আমি কখনোই শুঁয়োপোকা ছিলাম না। - আচ্ছা তুই সবসময় প্রজাপতি ছিলি।

খুশি? - হুঁ। আর তুমি কক্ষণো ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে যাবেনা। - আচ্ছা যাবনা। এখন একটু হাস। তুমি হাসো বসে বসে আমি যাই।

- বলে ধড়াম করে তনয়ের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো অনু। বারান্দায় তার একটু পরেই একটুকরো নীল কাগজ এসে পড়লো। তাতে লেখা- ‘বুড়ি, এতদিন যত রাগ দেখিয়েছি আজকেই তার শোধ না নিলে হয়না? সারাজীবন তো পড়েই আছে। এখন একটু ছাদে আয় না সন্ধ্যা হওয়া দেখি। ’


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।