আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাওয়াই চপ্পল এবং পুনশ্চঃ

আমি যেই কালের কথা কহিতেছি সেই কালে চপ্পল ভদ্র সমাজে সাদরে গৃহীত হইত এবং লোকে চপ্পল পড়িয়া দ্বিগ্বিদিক গমনাগনম করিত। দামী চর্ম নির্মিত স্যান্ডেলের প্রাত্যহিক ব্যবহার তখনও ‘দিল্লী দূর অস্ত’। বাজারে শুধুমাত্র চপ্পলের পসরা সাজাইয়া দোকানীরা বসিত এবং তাহাদের বিকি কিনি খুব খারাপ ছিল তাহা বলা যাইবে না। বাজার ব্যতীত প্রত্যেক এলাকাতেও চপ্পলের দোকান ছিল; সেই সব দোকানের সমস্ত দেয়াল জুড়ে নানান সাইজের নানান মার্কার (ব্রান্ড শব্দটি তখন অবধি সাধারণ্যে ভূমিষ্ট হয় নাই; কাজেই লোকজন মার্কা দেখিয়া পণ্যদ্রব্যাদি খরিদ করিত) চপ্পল শোভা পাইত। চপ্পল সমূহের মধ্যে দেখিতে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না।

নীল রঙের স্পঞ্জের উপর সাদা আস্তরণ, ফিতাটিও নীল রঙের হইত। এই যখন অবস্থা তখন দেশে একপদের চপ্পলের শুভাগমন ঘটিল। বলা যায় এই সময়ে Apple-এর iPhone এবং iPad ইত্যাদি যেরূপ ঝড় উত্তোলন না করিয়াছে, সেই নয়া চপ্পল শহরে-বন্দরে ঝড় তুলিল! চপ্পলের বিপনন ইতিহাস নতুন করিয়া সুলিখিত হইল এবং যদি স্মরণশক্তি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া থাকে, তবে সম্ভবত সেই সময়েই রেডিও কর্মাশিয়ালে চপ্পল পাকা-পোক্ত স্থান করিয়া নিল। আপনাদিগের আপেক্ষার প্রহর আর দীর্ঘায়িত না করিয়া ইহার সহিত পরিচয় করাইয়া দিতেছি। ইহা ছিল ঐতিহাসিক হাওয়াই চপ্পল! যে চপ্পল কিনা আজীবন নীল এবং সাদায় কলুর বলদের ন্যায় বাঁধা পড়িয়াছিল এবং যে ছিল একজোড়া চটি মাত্র, তাহা নজর কাড়া রঙ-বেরঙে বাজারে আসিল এবং ইহার পুরুত্ব দ্বিগুণ হইয়া নিদারুণ আরামদায়ক হইল।

চপলের উপরিতলে বিভিন্ন বেস কালারের সহিত চিত্র-বিচিত্র রঙের ছোপ যুক্ত হইল এবং পুরুত্বের মাঝেও বিভিন্ন রঙের লেয়ার আসিল। অমন পণ্য, চাহিদা তৈরী হইতে দেরী হইল না! পোলাপান পুরাতন চপ্পল বিসর্জন দিয়া নতুন হাওয়াই চপ্পল পায়ে গলাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। রেডিওতে সর্বিদাই বাজিতেছে ‘রূপসা রূপসা রূপসা/চমৎকার হাওয়াই চপ্পল রূপসা/রঙ-বেরঙে অদ্ভূত/টেকসই আর মজবুত/চমৎকার রূপসা চপ্পল পায়ে যে সবার’...টিং টিং... নানান দেন-দরবার করিয়া শেষাবধি আমিও একজোড়া বাগাইয়া লইলাম। হলুদ রঙের উপর কমলা, সবুজ, নীল কত রঙ-বেরঙের ছোপ। আর গন্ধ? এখনও নাকে লাগিয়া আছে; শুধু ইহা খাদ্য ছিল না বিধায় চিবাইয়া খাই নাই।

তো সেই হাওয়াই চপ্পল পায়ে বৈকালে ঘুরঘুর করিতে লাগিলাম এবং সময়ে দৌড়াদৌড়ি খেলিতে যাইতাম। কিন্তু আমি ভাবিয়াছিলাম এক, বিধাতা ভাবিয়াছিলেন আর এক। ৩-নম্বর রাস্তার যে স্থলে ৪-নম্বর রাস্তা শুরু হইয়াছে, ট্রাকের ব্যাপক আনাগোনায় সেই কোণায় একটি কর্দমাক্ত গর্ত তৈরী হইয়াছিল। একদিন হাওয়াই চপ্পল পড়িয়া দৌড়াদৌড়ি খেলিতে গিয়া পড়বি তো পড়, একেবারে সেই কর্দমাক্ত গর্তে পা চালাইয়া দিলাম! পদযুগল হাটু অবধি আঠাল কাদায় ডুবিয়া গেল। কি আর করা, দাড়াইয়া থাকিলে শিকড় গজাইয়া যাইবে, তাই পদদ্বয়কে কাদা হইতে অবমুক্ত করিতে প্রয়াস পাইলাম।

চেষ্টায় ফল লাভ হইল বটে, তবে এক খানা চপ্পল কাদার অতলে হারাইয়া গেল। মন খারাপ করিয়া এক খানা চপ্পল হাতে (সঙ্গত কারণেই পায়ে নয়) লইয়া বাড়ী ফিরিলাম। সকলেই হাওয়াই চপ্পল পায়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেও, আমার পায়ে পুনরায় পুরাতন চপ্পল গলাইতে হইল। সমস্তই শুকায়, আমারও শুকাইল। মাসাধিক কাল পরে পুনরায় একই স্থলে দৌড়াদৌড়ি খেলিতেছি।

কর্দমাক্ত গর্তটি তখনও সেইরূপই আছে, ইহা মোটেই শুকায় নাই! অকুস্থলে যথারীতি একটি ট্রাক আসিয়া হাজির হইল। বেটা পড়বি তো পড়, মালীর ঘাড়ে! ইহার এক খানা চাকা যাইয়া পড়িল সেই কর্দমাক্ত গর্তে। ট্রাকের ভারে চাকা কাদায় ডুবিয়া গেল। ইহা নতুন নহে। নতুন যাহা তাহা হইল ট্রাকের চাকা ডুবিয়া যাওয়ায় সমস্ত কাদা উঠিয়া আসিল, সাথে আসিল আমার হাওয়াই চপ্পল! তখন ‘ইউরেকা’ শব্দটির সহিত পরিচয় হয় নাই, নচেৎ আমার এক চিৎকারেই দেশবাসী উক্ত শব্দটি জানিয়া যাইত।

চপ্পলখানা তুলিয়া লইয়া চিৎকার করিতে করিতে লাফাইয়া লাফাইয়া বাড়ী ফিরিলাম। জোড় পুনরায় মিলিল। পুনশ্চ: দেশ কাদা-পাঁকে ডুবিয়া আছে এবং প্রতিনিয়ত গভীর হইতে গভীরতর স্তরে যাইতেছে। আরও গভীরে আঠাল কাদা-পাঁকে হারাইয়া যাওয়ার আগেই ১৬ কোটি জনগণ যদি কাঁদায় লাফাইয়া পড়ে, দেশ কি উঠিয়া আসিবে না? সিঙ্গাপুর ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।