১
বুকের ডানপাশ হিমেলের পিঠে মিশিয়ে বসেছে লুবনা। বয়ফ্রেন্ডের কাঁধের ওপর তার মাথাটা এলানো। ডান হাতে শক্ত করে বেল্টের বকলেস ধরা। দমকা হাওয়ায় আরোহিণীর এলোচুল উড়ে এসে পড়ছে চালকের নাকে-মুখে-ঠোঁটে। একগুচ্ছ চুল কামড়ে ধরে হিমেল ছুটে চলছে হাই স্পীডে।
গার্লফ্রেন্ডের চুলের উগ্র ঘ্রাণে, শরীরের উত্তপ্ত স্পর্শে শিহরিত সে। চারুকলা ইনষ্টিটিউট পেরিয়ে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অতর্কিতে ব্রেক চাপে হিমেল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে মোটরবাইকটি ফুচকার দোকানের পাশে থেমে যায়।
ফুচকাঅলা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনী হাসি হেসে বলে, মামা বসেন।
দোকান ঘিরে আসনের ডিম্বাকার বিন্যাস এলামেলো করে দুটি চেয়ারে তারা মুখোমুখি বসে।
দোকানি ফুচকার পেটে আলুভর্তা ঢুকিয়ে প্লেট সাজাতে ব্যস্ত। হিমেল পিচ্ছিল দৃষ্টি ফেলছে জিন্সপরা লুবনার ওপর।
হিমেল দর্শনে মাস্টার্স দেবে। সিলেবাসের বাইরেও তার বিচরণ রয়েছে অল্পস্বল্প। সে বেশ ফিটফাটও বটে।
ঝকঝকে হাসি। ঝরঝরে বাচন। চালচলনে আভিজাত্য প্রকাশমান। বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র সন্তান সে। গুলশানে নিজের বাড়িতে থাকে।
ড্রাইভারসহ প্রাইভেটকার আছে তার। তবে মোটরসাইকেলই প্রিয় বাহন। এতে চড়ে লুবনা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।
মফস্বলের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে লুবনা। ছিপছিপে গড়ন।
উচ্চতা চলনসই। তার ত্বকের ধবধবে ফরসা রং সৌন্দর্যের গ্যারান্টি দেয় না। তবু নিজেকে সে অনিন্দ্যসুন্দরী ভাবে। ফ্যাশনেও স্টাইলিশ হতে চেষ্টা করে। আকর্ষণীয়া হয়ে উঠতে চায় বয়ফ্রেন্ডদের কাছে।
প্রেম করে বিয়ে করার ভীষণ শখ তার। সে পড়ে ইংরেজি সাহিত্যে। প্রথম বর্ষে। রোকেয়া হলে ডাবলিং সীটে ঘুমায়। টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়।
হিমেলের কাছে এটা স্বস্তিকর নয়।
ফুচকা মুখে নিয়ে মুড়মুড় করে খেতে খেতে হিমেল লুবনাকে বলে, তোমার খরচাপাতি যা লাগে আমার কাছ থেকে নাও, টিউশনির সময়টা আমাকে দাও।
লুবনা এমনভাবে তাকায় যেন প্রথমবার দেখছে হিমেলকে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে ভাবতে থাকে সে। অতি আন্তরিক এ প্রস্তাবে রাজি হওয়া উচিত হবে না।
অল্প সময়ের জানাশোনায় এতটা অধিকার কাটানো যায় না। নিচের ঠোঁট বাঁ দিকে বাঁকিয়ে নিচুস্বরে লুবনা বলে, থ্যাঙ্কস ফর ইয়োর সিমপ্যাথি।
সরি, কোনো কিছু মিন করে আমি কথাটা বলিনি। চলো উঠি। আজিজ মার্কেটে যাই।
তোমার বইগুলো কিনি।
আজ কিনবো না। হলে চলে যাবো।
ঠিক আছে। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
লাগবে না। তোমার পথ তুমি চলো।
মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে হিমেল অপেক্ষমান। লুবনা কপাল থেকে একগাছি চুল পেছন দিকে সরিয়ে ডান হাতটা মাথার ওপর স্থির রাখে ক্ষণকাল। লাল রঙে পালিশ করা লম্বা নখগুলোর ওপর বিষণœ বিকেলের রোদ চকমক করে ওঠে।
রমণীমোহন হাসি ছড়িয়ে হিমেল চোখের ইশারায় তাকে কাছে ডাকে। লুবনার মনের কোণে জমে ওঠা অভিমানের মিহি দানা নিমেষেই সরে যায়। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হিমেলের পেছনে চুপচাপ বসে।
কাঁটাবন মার্কেটে পাখির দোকানগুলো পেরুবার সময় কিচিরমিচির শুনে লুবনা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খাঁচার পাখিদের আকাশে উড়িয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে হয় তার।
হিমেলের সঙ্গে না থাকলে অন্তত একটি পাখিকে মুক্ত করে ইচ্ছেটার আংশিক বাস্তবায়ন করত সে।
নীলক্ষেত মোড়ে জ্যাম পড়ে। একটা রিকশা থামে মোটরসাইকেলের পাশে। রিকশায় কবি কবি চেহারার এক যুবক বসা। উদাসী যুবকের কাছে ময়লা জামা পরা এক কিশোরী দৌড়ে আসে।
হাতে বেলিফুলের মালা। মেয়েটিকে হয়তো এর আগেও এদিকে দেখেছে সে। যুবকটিকেও কোথায় যেন দেখেছে। বোধ হয় স্বরচিত কোনো কবিতাপাঠের আসরে। কবির দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে লুবনা দেখে নেয় হিমেলকে।
হিমেল তাকিয়ে রয়েছে রেড সিগনালের দিকে।
গ্রীন সিগনাল জ্বলামাত্রই থমকে দাঁড়ানো যানবাহনগুলো গতি পেয়ে যায়।
হিমেল ঢোকে নিউ মার্কেটে। হেয়ার ড্রেসার ও পারফিউম কিনে। পীড়াপীড়িতেও গিফ্ট নিতে চাচ্ছে না লুবনা।
আজ এমন করছ কেন ডার্লিং?
ফ্রেন্ড অনলি। আর কখনও ডার্লিং বলো না।
ওকে, তাই হবে। ওগুলো নাও না প্লিজ!
সিন ক্রিয়েট করো না। লেট মি গৌ।
বন্ধুর মনে কষ্ট দিতে নেই বালিকা।
লুবনা এবার ব্যাগের জিপার খোলে। জিনিস দুটো দিতে পেরে হিমেল খুশি। আনন্দের আতিশয্যে হঠাৎ আনমনা হয়ে ওঠে সে। মনের অতল গহিন থেকে উঠে আসে বিশেষ এক প্রশ্ন।
আমাকে তুমি ভালোবাস?
ভালোও বাসি না, মন্দও বাসি না।
আমাকে বিশ্বাস করো তুমি?
তা করি। কিন্তু এ কথা আসছে কেন?
একটা রাত কাটাতে পারবে আমার সাথে?
বিশ্বাসের প্রমাণ দিতে!
বিশ্বাসের প্রমাণ পেতেও।
তা যাই হোক, কোথায় নিয়ে যেতে চাও, বলো।
বাসায় কেউ নেই।
দারোয়ান-মালি-বাবুর্চিকে ছুটিতে রেখেছি।
তোমার মা-বাবা তো হাওয়া বদল করতে সমুদ্রে গেছেন, তাই না?
শুধু হাওয়া বদল করতে নয় সর্ম্পকের প্রাচীরে জমে ওঠা ধুূলাময়লা ঝাড়তেও।
তোমার ফিলসফি রাখো। চলো হলে যাই।
লুবনা হলে গিয়ে রাতে বাইরে থাকার ফর্মালিটিজ সেরে নেয়।
আগের চাইতেও ঘনিষ্ঠ হয়ে সে হিমেলের পেছনে বসে।
হিমেলের বাসায় যাওয়ার পথে হাওয়াই মিঠাই দেখে লুবনার ভীষণ ইচ্ছে হয় খেতে। হিমেলকে জানাতেই সে বলে, এটা একটা খাবার জিনিস হলো?
চোখে-মুখে বিরক্তি ও বিষণ্নতা ফুটিয়ে লুবনা যখন বয়ফ্রেন্ডের বাসায় পৌঁছয় তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে।
২
এসি লাগানো ড্রইংরুম। কারুকার্যময় মেরুন রঙের গালিচায় মোড়ানো, দৃষ্টিনন্দন আসবাবে সাজানো।
দেয়ালে ঝুলছে বিখ্যাত কোনো শিল্পীর পেইন্টিং।
নর্তকী ঘুঙুর পায়ে নাচের মুদ্রা তুলে নতমুখে করজোড়ে দাঁড়ানো। হাসিতে বিপন্নতা, দৃষ্টিতে বিষণœতা ছড়ানো।
লুবনার মগ্নতা ভেঙে হুইলঅলা টি-টেবিল ঠেলে হিমেল ড্রইংরুমে ফিরে আসে।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে লুবনা চুলা জ্বলার শব্দ শুনতে পায়।
সে হিমেলকে বলে, ওভেনটা অফ করে এসো।
নু নীড। খাবার গরম করছি। ফ্রেশ হয়ে নাও।
হিমেল ঢোকে কিচেনে।
লুবনা বাথরুমে।
বাথরুমে বিশাল লুকিং গ্লাস। বাথটাবে শুয়ে দেহের সৌন্দর্য দেখার কথা ভাবে সে। কাপড় ছেড়ে ভাবনাটাকে কার্যকর করে নেয়।
চুলে টাওয়াল জড়িয়ে লুবনা টিস্যু পেপারে শরীর মোছে।
সমস্ত শরীরে সুরভিত লোশন মাখে। ফরাসি পারফিউম ¯েপ্র করে। হিমেলের শর্ট-প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়।
হালকা মেকআপ নিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে যায় লুবনা।
শ্বেতপাথরে মোড়া ডাইনিং টেবিল।
ফাস্ট-ফুডে সাজানো। পাশাপাশি বসে লুবনা ও হিমেল খাবার তুলে দেয় পরস্পরের মুখে।
হার্ড ড্রিংক্স পান করতে করতে হিমেল লুবনাকে বেডরুমে নিয়ে বিছানায় বসায়। বুকপকেট থেকে বের করে একটা ঝকমকে আংটি। পরিয়ে দেয় লুবনার অনামিকায়।
আংটিতে বসানো নীলা আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।
হিমেলকে বিয়ে করলে আমাার জীবন থেকে ঐশ্বর্য এভাবেই ঠিকরে পড়বে, ভাবে লুবনা।
সুখস্বপ্নে বিভোর হয় সে। হিমেলকে প্রবলভাবে ভালো লেগে যায় তার। ভালোবেসে শরীর ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।
লুবনা ভাবে, শরীর ছোঁয়াছুঁয়ি কি ভালোবাসাবাসির প্রথম সোপান?
৩
পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে চোখাচোখি হয়ে শুয়েছে হিমেল ও লুবনা। বিছানার মাঝখানে খানিকটা জায়গা ফাঁকা। লুবনার কল্পনায় সেখানে একটা ফুটফুটে শিশু অস্তিমান। উঠে গিয়ে সে একটা পুতুল এনে কল্পিত শিশুর শূন্যতা পূরণ করে। স্পঞ্জের পুতুলকে ওরা আনমনে আদর করতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে।
এক চোখ আধবোজা করে লুবনা বলে, কী ভাবছ?
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে হিমেল লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর ভাবনায় ক্রিয়াশীল কথাগুলো সাজিয়ে নিয়ে জলগম্ভীর গলায় জবাব দেয়, আজ রাতে তুমি আমার পবিত্র আমানত। এ আমানত যেন খেয়ানত না করে ফেলি।
হিমেলের শান্তমূর্তি একটুও ভালো লাগছে না লুবনার। সে ভাবে, প্রিয়জনের ভাবনা পাঠ করতে না পারলে কি মনের মানুষ হওয়া যায়? পারবে কী করে! সে তো কোলবালিশ ও মেয়েমানুষের পার্থক্যই বুঝতে পারে না।
কণ্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে লুবনা ফস করে বলে ওঠে, আমানত-খেয়ানত শুনতে আমি আসিনি।
কেন এসেছ?
মনের কথাটা চোখে ফুটিয়ে লুবনা তাকায় হিমেলের দিকে। মাদকতাময় দৃষ্টিটাকে ভাষাবন্দি করতে পারলে এর মানেটা হতো― ভালোবাসা দিতে ও নিতে।
লুবনার মনোবাঞ্ছা অনেকটাই আঁচ করতে পারে হিমেল। সে মেয়েদের শরীর একেবারেই স্পর্শ করেনি― এমন কিন্তু নয়।
সুযোগ পেলে নারীদেহের উত্তাপ পেতে ইচ্ছে কার না করে! তবে গড়পড়তা মানের কোনো যুবক সে নয়। পবিত্র তার প্রেমাকাঙ্খা। উদগ্র কামুকতা দ্বারা তার প্রেম আচ্ছন্ন নয়। কামনাকে অবদমিত করতে সচেষ্ট হয় হিমেল। ভাবে, যেভাবেই হোক যৌনশুচিতা বজায় রাখতে হবে।
বিবাহপূর্ব মিলনে দা¤পত্য মধুরতা ব্যাহত হয়। সাবালক হবার পর থেকে এমন ধারণা তার মনে বদ্ধমূল।
দেহজ উত্তেজনা প্রশমনের জন্য হিমেল নেমে আসে বিছানা থেকে। ঢক ঢক করে দু-গ্লাস আপেলের জুস গিলে।
ওদিকে লুবনার কামাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।
সে চায় তাতিয়ে তাতিয়ে হিমেল তাকে আদরে আলিঙ্গনে মাতিয়ে রাখুক সারা রাত।
সিগারেট ধরাবার জন্য কিচেনে চলে যায় হিমেল। ধীরপায়ে লুবনাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিবুনিবু চুলাটা উসকিয়ে হিমেল বলে, ওই নীল প্রশান্ত শিখা হলো প্রেম; লোহিত গনগনে শিখা হলো কামনা।
হিমেলের দু-হাত চেপে ধরে লুবনা বলে, সব মিলিয়ে যে অগ্নি দেখা যায় তার কী নাম?
কিছুমাত্র না ভেবেই জবাব আসে, যৌনতা।
যার মাধ্যম হল শরীর।
মানে?
প্রেমের উন্মেষ ও বিকাশ শরীরকে কেন্দ্র করেই। প্রেম শরীরী আকর্ষণমুক্ত হতে পারে না।
কী বলতে চাও তুমি?
প্রেম পূর্ণতা পায় দৈহিক মিলনে।
এক অর্থে তোমার কথাটা ঠিক, মৃদু একটা ঝাঁকুনি মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হিমেল বলে।
কোন অর্থে লুবনার কথাটা ঠিক তা জানে না সে।
ব্যাক-ব্রাশ করা চুলে আঙুল বুলাতে বুলাতে হিমেল বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।
লুবনা ভাবে, কী বোকা আমি! এত সহজে নিজেকে উজাড় করে দিতে চাইছি কেন?
সুলভ হলে কদর যে কমে যায় তা আঁচ করতে পেরে সে হিমেলের পায়ের কাছে বসে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, তোমায় একটু বাজিয়ে দেখলাম আর কি!
হিমেলের কোনো সাড়া মিলেনি। কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে সে।
লুবনা পুনরায় বিছানায় শোয়। সে চায় ফুলের সুবাসে ভ্রমর যেভাবে ছুটে আসে হিমেলও সেভাবে তার দিকে ধাবিত হোক। অথচ হিমেল সংবেদনহীন। লুবনা একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করে। খাটে মৃদু কম্পন জাগে।
নিঝুম রাতে ছোট্ট শব্দকেও বড় মনে হয় হিমেলের। তন্দ্রাতুর চোখে চমকে ওঠে সে।
৪
একসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে লুবনাও। তার চোখে ভেসে ওঠে বোহেমিয়ান কবির বিষণœ চেহারা। ক্লান্ত পায়ে শান্ত হয়ে বেলিফুলের মালা হাতে কবি এগিয়ে আসছে লুবনার দিকে।
মালার প্রতি গলা বাড়িয়ে দিতেই লুবনা বাস্তবতায় ছিটকে পড়ে।
একটা বোধ তাকে বিশেষভাবে তাড়িত করে, কবিহৃদয় কিংবা কবিতাপ্রেমি একটা বন্ধুও জোটেনি আমার!
ঘুমন্ত হিমেলের মুখাবয়বে লুবনা কবির প্রতিরূপ খোঁজে। পায় না। বরং কবির মাঝে মূর্তমান হয়ে ওঠে অন্য এক তরুণের প্রচ্ছায়া যার রক্তের হরফে লেখা এক শব্দের প্রেমপত্র ‘ভালোবাসি’ আজও আগলে রেখেছে লুবনা।
নিরুদ্দিষ্ট সেই প্রেমিকের জন্য কষ্টবোধ, হিমেলের নির্লিপ্তি, রাতের নৈঃশব্দ্য লুবনাকে অস্থির করে ফেলে।
হিমেলের পাশ থেকে সে চলে যায় ড্রইংরুমে। মুগ্ধ হয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে দেয়ালের ছবিটার দিকে। ভাবে, এমন প্রাণবন্ত ছবি যে সৃষ্টি করতে পারে কেমন সে? ছবির স্রষ্টার একটা প্রতিমূর্তি কল্পনা করতে থাকে লুবনা।
দারুণ শূন্য শূন্য লাগছে নিজেকে। লুবনা পায়চারি শুরু করে।
পদচারণার গতি অলস ও অসমঞ্জস।
অ্যাকুরিয়ামের লাল নীল মাছগুলোর দিকে লুবনা তাকিয়ে থাকে ঘোরগ্রস্তের মতো। জিওলমাছের সাথে জীবনটা বদল করে নিতে ইচ্ছে হয় তার। এমন অবান্তর ইচ্ছে হবার কারণ বুঝতে পারে না সে। লুবনা জানে যে হিমেলকে বিয়ে করতে পারলে অন্তঃপুরের চারদেয়ালে আটকাপড়া জীবন তার হবে না।
লুবনা ভাবে, হিমেল আমাকে বিয়ে করতে যদি রাজি না হয়!
বিড় বিড় করে সে কথা বলতে থাকে নিজের সঙ্গে। ভেবেছিলাম, বড়লোকদের কাছে প্রেমের চেয়েও কাম অধিক কাঙ্খিত। তাই তো দেহটাকে সমর্পণ করতে চেয়েছিলাম হিমেলকে। ইস, সে যদি আমাকে সস্তা মেয়েমানুষ মনে করে থাকে!
আর ভাবতে ভালো লাগছে না লুবনার। হিমেলের কাছে যেতে সংকোচ বোধ হচ্ছে তার।
অন্যমনস্কভাবে সে হিমেলের মা-বাবার ঘরে ঢোকে।
সে-ঘরে বিছানাসংলগ্ন ছোট্ট একটা টেবিলে হারমোনিয়াম রাখা। বাদ্যযন্ত্রটির কাছে সে বসে থাকে মিনিট কয়েক। একসময় আপন মনে আঙুল চালাতে শুরু করে হারমোনিয়ামের রীডে। বিষাদময় কণ্ঠে গেয়ে চলে, আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি/ তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি...।
অবাক বিস্ময়ে হিমেল ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। লুবনা যে গান গাইতে পারে তা জানা নেই তার। চোখ থেকে কাঁচা ঘুম সরিয়ে সে মধ্যরাতের গায়িকার পাশে গিয়ে বাবার বিছানায় বসে। পায়ের ওপর পা তুলে। গান থামিয়ে লুবনা বলে, ক’টা বাজে?
জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি হিমেল।
সে লুবনার কাঁধে হাত রাখতে চেয়েও ফিরিয়ে আনে।
৫
নিজের পোশাক পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে লুবনা অপেক্ষা করছে কখন অবসান হবে রাতের। তার প্রেম-ভালোবাসার স্বপ্নটা বারবার সুতাছেঁড়া ঘুড়ির মতো গোঁৎ খেতে থাকে।
হিমেলের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ছে। ধোঁয়ায় ঘন হচ্ছে ঘরের বাতাস।
আবদ্ধ বাতাসে তর্জনী ঘুরিয়ে হিমেল লিখে, ভা-লো-বা-সি। লুবনার মনে হচ্ছে হিমেলের চোখের ভেতর থেকে যেন একটা শাদা প্রজাপতি উড়ে এসে বসেছে রক্তিম শব্দটার পাশে। কবিতার একটা পঙ্ক্তি তার কণ্ঠ বেয়ে নেমে আসে― প্রেম আমার প্রজাপতির পিঠে চড়ে ছুটে চলে পারিজাতের বনে। পঙ্ক্তিটি কোথায় যে পড়েছে বা শুনেছে তা স্মরণ করতে পারছে না সে।
মনে চিনচিনে একটা যন্ত্রণা নিয়ে লুবনা হিমেলের পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়ায়।
বইগুলো ঠিকঠাক করার সময় হিমেলের দিনলিপি লেখার খাতাটা হাতে নেয়। পাতা উল্টাতে উল্টাতে শেষ লেখাটায় দৃষ্টি আটকা পড়ে। লুবনাকে নিয়ে হিজিবিজি হস্তাক্ষরে লেখা বাক্যগুলো সহজপাঠ্য নয়। আংশিক পাঠোদ্ধার কোনোমতে যদিও করা গেছে, মর্মোদ্ধার করা দূরূহ ঠেকছে। তবে অনুমান করা যাচ্ছে যে হিমেল হয়তো এখনও প্রাণের মানুষ ভাবতে পারেনি তাকে।
৬
হিমেলের নপুংসক ভাবসাব অসহ্য লাগছে লুবনার। এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না সেখানে। রাত পোহাবার কিছুটা বাকি। থাকুক। পালিয়ে আসার কথা ভাবে সে।
সে দরজার নবে হাত রাখামাত্রই হিমেল বিছানা থেকে লাফিয়ে নামে। নিবিড় আলিঙ্গনে আটকে ফেলে লুবনাকে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে।
নারীদেহের উত্তাপ পেতে পেতে তার মনে পড়ে যৌনশুচিতা বজায় রাখার কথা। আস্তে আস্তে সমস্ত উত্তেজনা উধাও।
সাথে সাথে লুবনাকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দেয় হিমেল।
শৃঙ্গারে আশ মেটেনি কামাতুর লুবনার। তার প্রতিটি মুহূর্ত টান টান উত্তেজনায় ভরপুর। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।