যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ বিশ্রামাগার গঠনের ইতিবৃত্ত
দীর্ঘ ন’মাস অনেক লড়াইয়ের ফসল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী ঘরে উত্তোলন করে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম ও কয়েকশ’ দামাল সন্তানের অঙ্গহানীর বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা লাভের পরপরই বিভিন্ন জেলা থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকাতে এসে উপস্থিত হতে থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, মহাখালী বক্ষব্যধি হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল অর্থাৎ সবখানেই আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অথবা পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে আহত বাঙালী রোগী। সবাই চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে ঢাকায় উপস্থিত। ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও নিজ মাতৃভূমিতে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার জন্য ভারতের হাসপাতালের উন্নত চিকিৎসা ত্যাগ করে মাতৃভূমিতে এসে রাজধানীতে ভীড় জমায়।
ফলে, প্রতিটি হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়ে। হাসপাতালে সাধারণ রোগী চিকিৎসার সাথে সাথে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও চিকিৎসায় আসলে প্রতিটি হাসপাতালে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মগবাজারের একটি বাড়িকে ‘শুশ্রুষা’ নাম দিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
‘শুশ্রুষা’র মত শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে ১/৬ ও ১/৩ গজনবী রোডের ২টি বাড়িতে ৪০/৫০ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মেঝেতে শুয়ে (ফ্লোরিং) দিন কাটাতেন আর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা (ড্রেসিং) করাতেন। ১/৬ ও ১/৩ গজনবী রোড।
মোহাম্মদপুরের এই বাড়ি দু’টো বিহারীদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। যা পরবর্তী সময়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১/৬ ও ১/৩ নং বাড়ির লাইনে আরও একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। যেখানে বরিশালের তদানীন্তন এম,পি, এনায়েতুল্লাহ খান বসবাস করতেন। হাসপাতালে সাধারণ রোগীর সাথে উপুর্যুপরি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করতে বিছানা-পত্র সহ স্থানের অভাব হলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অবস্থানরত ও ১/৬ এবং ১/৩ বাড়িতে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে এম, পি, এনায়েতুল্লাহ খানকে অনুরোধ করেন।
বলেন, ‘স্যার, আপনার ত’ ঢাকায় আরো বাড়ি আছে। তাই বিহারীদের ফেলে যাওয়া এই বাড়িটি আমাদের বসবাসের জন্য দিয়ে দিলে আমাদের উপকার হত। সেই সাথে হাসপাতালে সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসার সুবিধা হতো। ’
এনায়েতুল্লাহ খানকে বাড়ি ছাড়ার অনুরোধ জানালে এনায়েতুল্লাহ খান রাগান্বিত হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গালিগালাজ দেওয়া শুরু করেন। তার গালাগালি ও চিৎকারে রাস্তার সাধারণ মানুষ থেকে হাসপাতালের ভিতর হতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এসে হাজির হন কলেজ গেটের ১/১ গজনবী রোড এর বাড়ির সম্মুখে।
ততক্ষণে রাগান্বিত এম, পি, এনায়েতুল্লা খান ঘর থেকে তার দু’নলা বন্দুক বের করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুলি চালায়। তার বন্দুকের গুলিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওলি আহাদ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। ওলি আহাদকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে এনায়েতুল্লা খান পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে প্রথম এসে হাজির হন কাদের সিদ্দিকী।
তিনি গোটা ঘটনা শুনে আর ওলি আহাদের লাশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায় রাজাকারের বাচ্চা?’ বলে সদর ঘাটের দিকে তাঁর জিপ নিয়ে তড়িৎগতিতে চলে যান। যাবার পূর্বে বলে গেলেন, ‘কোথাও পালাতে পারবেনা হারামীর বাচ্চা। আমি তাকে বের করে ছাড়ব। তোমরা ওর বাড়ির মাল-পত্র বের করে সামনে এক স্থানে গাদা করো।
আমি আসছি!’
তাঁর নির্দেশ পেয়ে শতাধিক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মিলিতভাবে জনসাধারণকে অনুরোধ করে সরিয়ে দিয়ে কলেজ গেটে যেখানে আজ যাত্রী ছাউনি আর সোনালী ব্যাংক, সেখানে খাট, চেয়ার, টেবিল, ওয়াড্রোব, আলমারী, দামী ও সুদৃশ্য সোফা ও শোকেসসহ বিছানা-পত্র সব এক স্থানে স্তূপ করেন। ১৯৭৩ইং সালে এম, পি, এনায়েতুল্লাহ খানের মেয়ের ড্রেসিং টেবিলে তখনকার মূল্যমানের অন্ততঃ দু’লক্ষ টাকার বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্য পাওয়া যায়। কাদের সিদ্দিকি ফিরে এসে নির্দেশ দেন, ‘জ্বালিয়ে দাও রাজাকারের বাচ্চার বাড়ির মালপত্র!’
তড়িৎ গতিতে বিহারী কলোনী থেকে পাঁচ সের কেরোসিন তেল এনে ঢেলে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সবকিছু। ১/১ নম্বর গজনবী রোডের বাড়িটি পরিষ্কার করে সেই বাড়িতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়েন। সিদ্ধান্ত হয় যে যুদ্ধে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের এই বাড়িতে চিকিৎসাধীন রাখা হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সদস্য ডা. জোয়ারদার অতীব আগ্রহান্বিত হয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সার্জিক্যাল খাট সহ বিছানা পত্র চেয়ে একটি আবেদন রাখেন জাতিসংঘ প্রেরিত হাড় বিশেষজ্ঞ (Bone Specialist) ড. রোনাল্ড জেমস্ গার্ষ্ট এম, ডি, কে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী ড. রোনাল্ড জেমস গার্ষ্ট এম, ডি, পেশায় একজন ডাক্তার হলেও ছিলেন মাটির মানুষ। ভারি উদার মনের মানুষ ছিলেন সেই বিদেশী। ১৯৭২ সালে শুধুমাত্র যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে তিনি ঢাকায় আসেন। প্রতিটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতেন নিজ সন্তানের মত।
আদর করতেন, ব্যবহার করতেন বন্ধুর মত। ড. গার্ষ্ট সহধর্মিনী মেরী গার্ষ্টকেও বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। মেরী গার্ষ্টও মা, বোন ও সেবিকার দায়িত্ব পালন করেছেন প্রতিটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সাথে। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করে ড. গার্ষ্ট বাংলাদেশ থেকে চলে যান। তবে, বাংলাদেশ সরকারসহ তাঁর ছাত্র ও বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকদের অনুরোধে প্রতি বছর একবার করে আসার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তিনি সেই মাফিক আসতেন।
তিনি এখনও নিজ খরচে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অনেক কঠিন অপারেশন করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নেন। মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে সপত্নীক দেখা করেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ও জননী ড. রোনাল্ড জেমস গার্ষ্ট ও মেরী গার্ষ্ট যত দিন বাংলাদেশে থেকেছেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্কে থেকেছেন।
তাঁদের অমূল্য অবদানের প্রতি স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিরক্ষা সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান এম.পি. সাহেবের উপস্থিতিতে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক তাঁর বক্তৃতার মাধ্যম ড. গার্ষ্টকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায়। জনাব আসাদুজ্জামান এম, পি, ড. গার্ষ্টকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ড. গার্ষ্ট বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “যত দিন বাঁচব, আমার ছেলেদের দেখাশুনা করতে পারব। ’
ফিরে আসি আগের কথায়। সেই ১৯৭২ সালে উদারমনস্ক আর এক বাঙালী চিকিৎসক ডা. জোয়ার্দারের অনুরোধে ২৩০টি সার্জিক্যাল খাট ও বিছানা পত্রসহ অনেক কিছুই ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’কে প্রদান করা হয়।
একটি সার্জিক্যাল খাটের মূল্য প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ১/১ গজনবী রোড এর বাড়িটিতে ক্লিনিক সিস্টেমে খাট বসিয়ে প্রথমে ১। মোদাস্বার হোসেন মধু ২। মো. নুরুল আমিন, ৩। মো. আনোয়ার হোসেন, ৪।
মো. নজরুল ইসলাম, ৫। মো. জাফর আলী, ৬। শ্রী মানিক গোপাল দাস, ৭। শুকুর মাহমুদ, ৮। মো. নূরুজ্জামান, ৯।
গোলাম মোস্তফা ১০। মোজ্জামেল হোসেন, ১১। মো. আ: রাজ্জাক, ১২। মো. ইউসুফ আলী, ১৩। মোসলেম উদ্দীন, ১৪।
মো. আ: সোবহান, ১৫। শ্রী মানিক চন্দ্র ভৌমিক, ১৬। আ. হান্নানসহ মো ১৮ জন গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাকে স্থান করে দেওয়া হল। আরও ছয় জন কয়েকদিন পরে ভর্তি হয়। মোট ২৪ জন পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে সর্ব প্রথম স্থান দেওয়া হলো।
১/৩ ও ১/৬ নং ২টি বাড়িতেও গাদাগাদি করে ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। কারো হাত নেই। কারো পা নেই। কেউ একেবারে অক্ষম। কারো মুখ পোড়া।
এসব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান সুরু করে ১/১, ১/৩ ও ১/৬ নম্বর বাড়িতে। ডা. জোয়ার্দার তার একনিষ্ঠ উদ্যোগে তখনকার রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরী ও ড. গার্ষ্টের সাথে আলোচনা করে, রেডক্রস, ইউনিসেফ, আই, আর, সি, ইউ, এন, ডি, পি, ও ‘সেন্ট্রাল মেলোনাইটে’র মত সাহায্য সংস্থাগুলোকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ পুনর্বাসনকল্পে তাদের সাহায্য সহযোগিতা ও বিভিন্ন প্রকার ভকেশনাল প্রশিক্ষণ দেবার আহ্বান জানান। সাহায্য সংস্থাগুলো সরাসরি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কল্পে এগিয়ে আসার ঘোষণা ব্যক্ত করেন। ড. গার্ষ্ট খাট, বিছানা, ওষুধ পত্র দেওয়ার পরে ১/১ বাড়ির সম্মুখে একটি হল ঘরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁশ, বেত, টাইপ, ঘড়ি, ভিডিও, টেপ, টি,ভি, থেকে সেলাইয়ের কাজ পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। যুদ্ধাহত সৈনিকরাও আন্তরিকভাবে সকল শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন।
সেসময় সবাই মিলে আলোচনায় বসে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসস্থলটির একটি নাম রাখা হয়। প্রথম নামকরণ করা হয় ইংরেজীতে ‘Disabled Freedom Fighters’ Vocational Rehabilitation Training Centre’। এর বাংলা হলো ‘পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। ’ তিনটা বাড়িতে গাদাগাদি করে অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করে ভকেশনাল শিক্ষা নেন। ১/১ ও ১/৩ বাড়ির মাঝখানে ১/২ নম্বর বাড়িটি ছিল একজন ভদ্রমহিলার।
ভদ্রমহিলার ঢাকায় আর ৪/৫টা বাড়ি আছে। একদিন ভদ্রমহিলা দেখেন ১/২ গজনবীর বাড়িতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা গাদাগাদি করে অমানবিক ভাবে বসবাস করছেন। ভদ্রমহিলা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট দেখে সাথে সাথে লিডার জাফর চাচাকে বললেন, “এই বাড়িটি আমার। তোমরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এখন থেকে এখানেও বসবাস করবে। যতদিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের ছেলে মেয়েরা বসবাস করবেন, এই বাড়িতে আমার কোন দাবি নাই বা থাকবে না।
”
এভাবেই সেদিন থেকে ১/১, ১/২, ১/৩, ও ১/৬ ৪টি বাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার’। ভদ্রমহিলা বাড়িটি দান করে দেবার পর থেকেই ঈদ, পরব বা শবেবরাত সহ বিভিন্ন দিনে ভাল খাবার রান্না করে এনে হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ হাতে খাওয়াতেন। মায়ের মত আদর করতেন। কোরবানী ঈদে গরু ছাগল নিয়ে আসতেন। দিয়ে যেতেন বিশ্রামাগারে।
ভদ্রমহিলাকে আমরা এত শ্রদ্ধা করতাম যে কোন দিন ভদ্রমহিলার নামটি জিজ্ঞেস করতেও সৎসাহস হয়নি। তবে শুনেছিলাম তাঁর স্বামীর নাম জনাব আবুল কাশেম। গত ৭/৮ বছর তাঁকে দেখি না ঠিকই। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে স্মরণ হয় তাঁকে। জানি না সেই মা আজ আর ইহজগতে আছেন কিনা।
তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের মাঝে না এসে পারতেন না।
এলো ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫। সাহায্য সংস্থাগুলো তখন আমাদের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে চলে যায়। সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে আই, আর, সি, র পরিচালক (Director) মি. মার্শাল বিয়ার হুইল চেয়ারে চলাচলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতেন। চলে যাবার আগে তিনি হুইল চেয়ারে চলাচলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশের মানুষ ভাল না।
শেখ মুজিবের মত মানুষকে হত্যা করতে পারে?’ মি. মার্শাল বিয়ার অত্যন্ত মিশুক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অল্প অল্প বাংলা তিনি বলতে পারতেন। এখনও তিনি মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসেন। কিন্তু যাঁদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব বেশি ছিল, সেইসব হুইল চেয়ারধারীদের মধ্যে প্রায় সবাই ইহজগত ত্যাগ করেছেন। মাত্র একজন জীবিত আছেন।
তাঁর সাথে গল্প করে কিছু সময় বিশ্রামাগারে কাটিয়ে ফিরে যান মি. মার্শাল বিয়ার।
পঁচাত্তরের ঘটনার পর সাহায্য সংস্থাগুলো চলে গেলে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’ হতে মাসিক পঁচাত্তর টাকা সম্মানী ভাতা ছাড়া আর কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না। ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত রেডক্রস, আই, আর, সি, বা ইউনিসেফ, ইউ, এন, ডি, পি, কি সেন্ট্রাল মেলোনাইটের মতো সাহায্য সংস্থাগুলো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় বা গুঁড়া দুধ প্রদান সহ নানা সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত দেশে কোন সরকার ছিল কি ছিল না, তা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই অবগত ছিলেন না। কারণ, ঐ সময়টায় সরকারী বেসরকারী কোন ভাবেই কেউ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করেননি।
মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ফাঁকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবরও নিতেন। জিয়াউর রহমান একদিকে মন্ত্রী পরিষদে কুখ্যাত রাজাকারদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে যেমন পুনর্বাসিত করলেন, আবার অদ্ভুতভাবে হঠাৎ করেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের পুনর্বাসনের কিছু পদক্ষেপ হাতে নিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সূত্র ধরে গঠন করলেন একটি কমিটি। জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে বিল উত্থাপন করেন যে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা প্রদান করা হবে রাষ্টীয় কোষাগার থেকে। মিরপুর চিড়িয়াখানার সম্মুখে ১৩ একর জমি কল্যাণ ট্রাষ্টকে লীজ প্রদান করেন। ঠিক হয় এই জমিতে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান সমস্যা দূরীকরণে নির্মাণ করা হবে ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’।
যার নামকরণও করেছিলেন তিনি। ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন’ নামকরণ করে একটি চারতলা ভবনও নির্মিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ভবনে ১৬জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও ৫টি শহীদ পরিবারকে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। মোট ২১টি পরিবার কমপ্লেক্স ভবনের ভিতরে স্থানলাভ করে। কমপ্লেক্স ভবনের পেছনে একটি সুদৃশ্য পুকুরও নির্মাণ করা হয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গঠন করা ‘কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি’র মাধ্যমে সকল প্রকার পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। ‘কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি’ অনেক পরে গঠন করা হয়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে মাঝে মধ্যেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসতেন। এই নামটিও তাঁরই দেওয়া।
একদিনের ঘটনা: জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি কল্যাণ ট্রাষ্টের কর্মকর্তাকে অবহিত করে দেখতে এসেছেন বিশ্রামাগারে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের।
এটা তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৭/৮ দিন পরের ঘটনা। বিশ্রামাগারে এসে সাইন বোর্ড দেখে বলে উঠলেন, ‘যেহেতু এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে আহত, হুইল চেয়ারে বসে বা ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটেও কাজকর্ম করতে পারে। সেহেতু সাইনবোডটি চেঞ্জ করতে হবে। ’ ইতোপূর্বে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র”। জিয়াউর রহমান ১/১ নম্বর বাড়িতে বসে বলতে লাগলেন, ‘যেহেতু এরা কেউ দুর্ঘটনায় পঙ্গু নয়, সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে পঙ্গু… সেহেতু সাইনবোর্ডটি চেঞ্জ করা দরকার।
আর সাইনবোর্ডে লিখতে হবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার। ’ যদিও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কারোরই রোগের মুক্তি ঘটেনি, তবুও সেদিন থেকেই সাইনবোর্ডের লেখা পরিবর্তন হয়ে “যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামাগার” লেখা হয়। এবং অদ্যাবধি এই নামেই মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারটি চলছে।
জিয়াউর রহমানের সাথে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা ভুলতে পারি না। ১৯৭৯ সালের জুন মাস।
রাষ্ট্রপতি আবারো এসেছেন মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারের ১/১ গজনবী রোডের বাড়িতে। এই বাড়িটিতে শুধু হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতেন। বরাবরই জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিশ্বস্ত এ.ডি. সি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মাহফুজুর রহমান (মাহফুজ ভাই) থাকতেন। সেদিন তাঁর সাথে ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী আতাউদ্দিন খান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী এ্যানি ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম, যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম। এসময় ৮/১০ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাদের সামনে হুইল চেয়ারে বসা।
পাশের বাড়ি থেকে অন্যান্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও ৫/১০ জন এসেছেন। হঠাৎ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলে উঠলেন, ‘এ্যাটেনশন প্লিজ!’ সকলের দৃষ্টি ও কান চলে যায় রাষ্ট্রপতির দিকে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনারা মন দিয়ে শুনুন। আমি শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করব। কমিটিতে পুঁজির দরকার।
পুঁজি সংগ্রহের স্বার্থে আমি আপনাদের কাছে প্রথমে চাঁদা দাবি করছি। আপনারা কে কত চাঁদা দিবেন বলেন?’
সেদিন হুইল চেয়ারে চলাচলকারী একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তখন সেখানে দু/তিন জন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী থাকা সত্বেও প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সর্বপ্রথম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে তাঁর এক মাসের বেতন দান করেন। রাজনীতির হারজিত শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ক্ষোভে-দুঃখে তখন শুধু পাশে বসা বন্ধু নূরুল আমিনের হাতটা চেপে ধরে শরীরের রাগ মেটালাম।
রাজাকারের প্রথম সাহায্যে গঠিত হল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি। কী ভণ্ডামি! উপস্থিত সকল মন্ত্রী এক মাসের করে বেতন কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে দান করলেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীকে সদস্য সচিব, প্রধানমন্ত্রী, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী, পুনর্বাসন মন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে সদস্য করে রাষ্ট্রপতি নিজে চেয়ারম্যান হয়ে গঠন করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি। এই কমিটি প্রতি মাসে একটি আলোচনা সভা করবেন এবং তাতে শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের দিক প্রাধান্য পাবে। কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি হল।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনে সদস্য সচিব, ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর সাক্ষরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সেই পরিচয়পত্র দেখিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা সরকারী যানবাহনে বিনা ভাড়ায় চলাচল করতে পারবেন। এ নিয়ম এখনো বলবৎ আছে। বর্তমানে উক্ত পরিচয়পত্রে সাক্ষর দান করেন প্রতিরক্ষা সচিব। রাষ্ট্রপতি তথা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান প্রতিটি সিনেমা হলের প্রতিটি টিকেটে ১০ পয়সা করে চাঁদাও ধরেন।
তদুপরি মিরপুরে চারতলা একটি ভবন নির্মাণ ছাড়া এই কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি হতে কোন শহীদ পরিবার বা যুদ্ধাহত কোন সৈনিককে একটি টাকাও দেওয়া হয় নি। যদিও এই কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য ৮৬ কোটি টাকা রক্ষিত ছিল এবং এই টাকা খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসার দিন পর্যন্ত ছিল, তবু কোন কোন কালো হাতের ছায়ার খপ্পরে পড়ে এর একটি টাকাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যয় হয় নি। সেই ১২ একর জমিতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারেরা আজ বস্তির মতো কিছু একটা তৈরি করে বসবাস করছে। রাজনীতি আর বক্তৃতায় ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’র ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে তা রূপ লাভ করছে না। তবে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গ নিরাশ নয়।
অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় অনিবার্য।
মূল লেখকঃ মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক।
সংগ্রহেঃ অদিতি ফাল্গুনী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।