মন্দটাই মনে রাখে মানুষ। ভালোটা হাড়গোড়ের সঙ্গে মাটিতে মিশে যায়
শূন্য রানে ফিরতে চান না কোনো ব্যাটসম্যানই। কিন্তু মজার ব্যাপার, ক্রিকেট ইতিহাসে ব্যাটসম্যানরা সবচেয়ে বেশিবার যে রানে ফিরেছেন সেটি হচ্ছে শূন্য! ওয়ালশ-মুরালিধরনরা বোলিং দিয়েই ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু এই শূন্যের কারণে তাঁদের জন্য আলাদা জায়গা আছে ব্যাটিংয়ের রেকর্ডবুকেও! ‘০’ সংখ্যাটির সঙ্গে যাঁদের ‘ঘনিষ্ঠতা’ কিংবা দূরত্ব, তাঁদের কথা জানাচ্ছেন আরিফুল ইসলাম
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শূন্যের ‘জনক’ নেড গ্রেগরি। ইতিহাসের প্রথম টেস্টে প্রথম শূন্য করেছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান।
বোলার ছিলেন জেমস লিলিহোয়াইট। ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডেতে কেউ ০ রানে আউট হননি। প্রথম শূন্য এসেছে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে, জিওফ আরনল্ডের বলে ০ রানে আউট হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার গ্রায়েম ওয়াটসন।
টেস্টে সবচেয়ে বেশি শূন্য কোর্টনি ওয়ালশের—৪৩। ৩৫ শূন্য নিয়ে দুইয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা।
ওয়ালশের রেকর্ডকে যথেষ্টই হুমকিতে (নাকি আশায়!) রেখেছেন ক্রিস মার্টিন। কিউই পেসারের শূন্য এখন ৩৩টি। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি শূন্য সনাৎ জয়াসুরিয়ার ৩৪। (২৬) ও মাহেলা জয়াবর্ধনের (২৫)।
টেস্টে ০ রানে সবচেয়ে বেশিবার নটআউট থেকে গেছেন ক্রিস মার্টিন, ২৬ বার।
ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১৮ বার গ্লেন ম্যাকগ্রা। জেমস অ্যান্ডারসনের সুযোগ আছে ম্যাকগ্রাকে টপকানোর, ১৩ বার শূন্য রানে অপরাজিত থেকেছেন তিনি।
টেস্টে সবচেয়ে বেশি বল খেলে ০ রানে আউট হওয়ার কীর্তি কিউই পেসার জিওফ অ্যালটের—৭৭ বলে ০। ‘সেঞ্চুরিয়ান’ অ্যালট, ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওই ইনিংসেই ১০১ মিনিট উইকেটে থেকে রান না করে ফিরেছেন। ওয়ানডেতে রেকর্ডর্িট সদ্যপ্রয়াত ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান রুনাকো মর্টনের।
২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ০ করেছিলেন ৩১ বলে।
টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার প্রথম বলে আউট বা ‘গোল্ডেন ডাক’ মুত্তিয়া মুরালিধরনের—১৪টি।
টেস্ট ওপেনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ০ ইংল্যান্ডের মাইক আথারটনের—১৭টি। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন মারভান আতাপাত্তু (১৬), তবে গেইল-শেবাগরা (১৪) ঠিকই শঙ্কায় আছেন। ওয়ানডে ওপেনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার রিক্ত হাতে ফিরেছেন সনাৎ জয়াসুরিয়া—২৯ বার।
এখানেও জয়াসুরিয়াকে ধাওয়া করছেন গেইল (১৯)।
৩টি টেস্ট খেলেও কখনো ব্যাটিং করার সুযোগ পাননি ইংল্যান্ডের ফ্রেড রুট, রান করবেন কীভাবে? স্বদেশি আর্থার মোল্ড আবার ৩ টেস্টে ৩ ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়েও কোনো রান করতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি টেস্ট ইনিংসে ব্যাট করেও রান করতে না পারার রেকর্ড এটিই।
রান আউট হলে ব্যাটসম্যানদের মেজাজ সব সময়ই বিগড়ে যায়, ০ রানে রান আউট হলে নিশ্চয় আরও বেশি। টেস্টে এমন মেজাজ সবচেয়ে বেশিবার বিগড়েছে দুজনের—অস্ট্রেলিয়ার রডনি হগ ও পাকিস্তানি লেগ স্পিনার দানিশ কানেরিয়ার, চারবার করে।
ওয়ানতে রেকর্ডটি আরেক পাকিস্তানি লেগ স্পিনার আবদুল কাদিরের, তিনবার।
টেস্ট অভিষেকেই পেয়ার পেয়েছেন এখন পর্যন্ত ৩৭ জন। তাঁদের বেশির ভাগই বোলার, তবে আছে বিস্ময়কর কিছু নামও—ডব্লু জি গ্রেস, গ্রাহাম গুচ, সাঈদ আনোয়ার, কেন রাদারফোর্ড, মারভান আতাপাত্তু!
উইকেটকিপার ব্যাটস-ম্যানদের মধ্যে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ০ রানে ফিরেছেন ওয়াসিম বারি, ১৯ বার। বারিকে ছোঁয়ার খুব কাছে গিয়ে থেমে যান ইয়ান হিলি (১৮), তবে এখনো শঙ্কায় আছেন মার্ক বাউচার (১৭ বার)। ওয়ানডে রেকর্ডে রমেশ কালুভিতারানার (২৪) ধারেকাছে নেই আপাতত কেউ।
টেস্টে সবচেয়ে বেশি, ৫২ বছর ২৫৬ দিন বয়সে শূন্য রানে আউট হয়েছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার উইলফ্রেড রোডস। ১৯৩০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জর্জটাউন টেস্টে। মজার ব্যাপার, রেকর্ডে পরের চারটি জায়গাতেই আছেন একজন—অস্ট্রেলিয়ার বার্ট আয়রনমঙ্গার! ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি বয়সে ০ হল্যান্ডের নোলান ক্লার্কের, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ৪৭ বছর ২৫৩ দিনে। আট দিন আগে আরেকটি ০ করে রেকর্ডে দুইয়েও ক্লার্ক।
টেস্ট-ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক মুত্তিয়া মুরালিধরনের একটি লজ্জার রেকর্ডও আছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শূন্যের মালিক তিনিই, ৫৯টি! ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে শূন্যের ফিফটি আছে আর শুধু কোর্টনি ওয়ালশ (৫৪) ও সনাৎ জয়াসুরিয়ার (৫৩)।
টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সে ০ বাংলাদেশের তালহা জুবায়েরের—১৬ বছর ২৩১ দিনে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০২ সালে। ওয়ানডেতে পাকিস্তানের হাসান রাজার—১৫ বছর ১৯১ দিনে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৯৯৭ সালে।
টেস্ট ইনিংসে প্রথম বলেই আউট হওয়ার ঘটনা আছে ২৯টি। এর মধ্যে দুজন হয়েছেন সর্বোচ্চ তিনবার—সুনীল গাভাস্কার ও হান্নান সরকার।
জিমি কুক আবার প্রথম টেস্টেই আউট হয়েছেন প্রথম বলে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের লিওন গ্যারিক প্রথম ও একমাত্র টেস্টে! ওয়ানডেতে ম্যাচের প্রথম বলে আউটের ঘটনা ৫৯টি, দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলে ৪৩ বার।
টেস্ট-ওয়ানডে দুটোতেই অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশিবার ০ রানে ফিরেছেন স্টিভেন ফ্লেমিং। টেস্টে ১৩ বার, ওয়ানডেতে ১৪।
অধিনায়ক হিসেবে পেয়ার পেয়েছেন এখন পর্যন্ত ১৯ জন। তাঁদের মধ্যে তিনজন আবার পেয়েছেন অধিনায়কত্বের অভিষেকেই— অ্যালান বোর্ডার, মার্ক টেলর ও হাবিবুল বাশার।
সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার অ্যালান হার্স্ট টেস্ট ক্যারিয়ারে ২০টি ইনিংস খেলেছেন, ১০টিতেই আউট হয়েছেন শূন্য রানে। ১০ শূন্যের ছয়টি আবার ১৯৭৮-৭৯ অ্যাশেজেই! এটিই এক টেস্ট সিরিজে সবচেয়ে বেশি শূন্যের রেকর্ড।
টেস্টে সবচেয় বেশি ‘পেয়ার’ বা দুই ইনিংসেই সবচেয়ে বেশি শূন্য রানে আউট হয়েছেন ক্রিস মার্টিন—৬ বার।
গর্ব করার মতো এক ব্যাটিং-কীর্তি আছে অজিত আগারকারের। লর্ডসে সেঞ্চুরি, যা কিনা নেই শচীন টেন্ডুলকারেরও।
তবে আগারকারের ব্যাটিংয়ের কথা বললেই প্রথমে মনে পড়ে ১৯৯৯-২০০০ বোর্ডার গাভাস্কার ট্রফি। টানা পাঁচ ইনিংসে আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে, এর প্রথম চারটি আবার ছিল ‘গোল্ডেন ডাক!’ টানা সবচেয়ে বেশি টেস্ট ইনিংসে শূন্যের রেকর্ড এটিই। তবে আগারকারের সঙ্গী আছেন দুজন—সাবেক অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার বব হল্যান্ড ও নিষিদ্ধ পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ আসিফ। ওয়ানডেতে টানা সবচেয়ে বেশি শূন্য চার ইনিংসে, এবারও যৌথভাবে চারজন—ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান গাস লগি, শ্রীলঙ্কান পেসার প্রমোদ্য বিক্রমাসিংহে, জিম্বাবুয়ের পেসার হেনরি ওলোঙ্গা ও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ক্যামেরন হোয়াইট।
শূন্য নিয়ে গর্বের কীর্তি!
পুরো ক্যারিয়ারে কখনো শূন্য রানে আউট না হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট ইনিংস (৪৪) খেলেছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার জিম বার্ক।
বর্তমানে খেলছেন এমন দুই ক্রিকেটার অবশ্য এখনো শূন্য রানে আউট হননি—দুই ক্যারিবিয়ান ড্যারেন ব্রাভো (২৮ ইনিংস) ও আড্রিয়ান বারাথ (২১)। পুরো ক্যারিয়ার শূন্যবিহীন থাকতে পারবেন কি না, কে জানে!
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১০০ ইনিংস খেলেও শূন্য রানে আউট না হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার কেপলার ওয়েসেলস (১০৫ ইনিংস)। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে জ্যাক রুডলফ (৩৯), নাথান হরিজ (৩২), ক্যালাম ফার্গুসন (২৫), তৌফিক উমর (২২) ও ফ্যাফ ডু প্লেসিস (২০) কখনো শূন্য রানে আউট হননি।
টানা সবচেয়ে বেশি টেস্ট ইনিংস শূন্যবিহীন কাটানোর কীর্তি ডেভিড গাওয়ারের—১১৯ ইনিংস। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে সর্বশেষ ইনিংস পর্যন্ত টানা ৭৩ ইনিংস শূন্যবিহীন আছেন শচীন টেন্ডুলকার, দেখা যাক গাওয়ারকে ছুঁতে পারেন কি না! ওয়ানডেতে রেকর্ডটি রাহুল দ্রাবিড়ের—১২০ ইনিংস।
টানা ৯২ ইনিংস শূন্যবিহীন আছেন মোহাম্মদ ইউসুফ, তবে তাঁর আবার ওয়ানডে খেলার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায়। দ্রাবিড়কে ধাওয়া করতে পারেন বরং এবি ডি ভিলিয়ার্স (৭৭*)। ১৭৩ ইনিংস। শচীন টেন্ডুলকার এখন নট আউট ১১৮-তে। দেখা যাক, দ্রাবিড়কে ছুঁতে পারেন কি না!
প্রথম শূন্যের দেখা পাওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি টেস্ট ইনিংস খেলেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স—৭৮ ইনিংস।
ওয়ানডেতে রেকর্ডটি যাঁর, জানলে একটু অবাকই হবেন। তাঁর মূল কাজ যে ছিল বোলিং! ৭২ ইনিংস পর প্রথম শূন্য করেছিলেন সাবেক শ্রীলঙ্কান অফ স্পিনার ও বর্তমানে আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা। ওয়ানডেতে এক সিরিজে বা টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ৪ শূন্য চারজনের—এবি ডি ভিলিয়ার্স, গ্রেগ চ্যাপেল, আইরিশ অফ স্পিনার কাইল ম্যাককালান, ইংলিশ অলরাউন্ডার ইয়ান ব্লাকওয়েল।
টেস্টে সবচেয়ে বেশি ব্যাটসম্যানকে ০ রানে আউট করেছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা (১৭৬), ওয়ানডেতে ওয়াসিম আকরাম (১১০)।
টেস্ট ইনিংসের প্রথম বলেই দুবার প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যাকে দুবার আউট করার কৃতিত্ব আছে কেবল চার বোলারের—জিওফ আরনল্ড, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি ও পেড্রো কলিন্স।
শূন্য কেন ডাক?
ডাক মানে তো হাঁস, শূন্যকে কেন তাহলে ডাক বলা হয়? নিশ্চিত করে বলা অবশ্য মুশকিল, তবে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটিকেই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। অনেকেরই জানা, তবু আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। টেস্ট ক্রিকেট শুরুরও বেশ আগে আসলে ‘ডাক’ শব্দটির উদ্ভব। কোনো এক ম্যাচে প্রিন্স অব ওয়েলস (পরবর্তীকালের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড) ০ রানে ফেরার পর ১৮৬৬ সালের ১৭ জুলাই একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘প্রিন্স রয়্যাল প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন হাঁসের ডিম নিয়ে!’ ধারণা করা হয়, ‘০’ দেখতে হাঁসের ডিমের মতো বলেই পত্রিকাটি এই তুলনা টেনেছিল। ব্যস, সেই শুরু।
‘ডাকস এগ’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত হয়ে চালু হয়ে গেল শুধু ডাক! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।