আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক সময়ে মাঠের পারফরম্যান্সকে ঘিরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিকেটপ্রেমিকরা রীতিমতো চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। সবার এক কথা_ হঠাৎ করে ক্রিকেটে এটা কি হলো! ক্রিকেট সত্যি সবাইকে এক ধরনের মনোকষ্টের বলয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে! এক-দেড় বছর ধরে ক্রিকেটাররা মাঠে ভালো খেলেছেন, তাদের মধ্যে মানসিক বল, দৃঢ়তা, আত্দবিশ্বাস এবং উদ্যম লক্ষ করেছি। তারা সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছেন ভালো খেলার, বিজয় অভ্যাস গড়ে তোলার। বুঝতে পেরেছেন দেশের জন্য খেলার ক্ষেত্রে বিজয়ের মূল্য কতটুকু! আমরা লক্ষ করেছি ক্রিকেটারদের মধ্যে নিজস্ব আত্দোপলব্ধি। ক্রিকেটাররা বুঝতে পেরেছেন ইতিবাচক মনোভাব, জ্বলন্ত অঙ্গীকার, আকাঙ্ক্ষা, নির্দেশনা ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে লক্ষ্যে পেঁৗছানো যাবে না।
সফলতার স্বাদ পেতে হলে নির্দিষ্ট ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য চিন্তা ও কাজ করতে হবে।
আমরা জানি, ক্রিকেটের পূর্ণতার মানদণ্ডে পেঁৗছতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রতিটি ফরম্যাটের খেলায় কম-বেশি ভালো খেলার জিদ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের মনের আশাকে গাঢ় করেছে। আমরা ভেবেছি ধারাবাহিকতার বৃত্তে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। পুরো বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছি।
ভেবেছি বাংলাদেশ অবশ্যই ক্রিকেটে ধাপে ধাপে উন্নতির রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবে।
সাধারণ ক্রীড়ানুরাগী মহল বিশ্বাস করেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রেক্ষাপটে একমাত্র জীবনধর্মী দলীয় খেলা ক্রিকেট পারবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে উঁচুতে উড়াতে। ক্রিকেট পরিণত হয়েছে বাঙালিদের সমাজ জীবনে একটা সংস্কৃতি হিসেবে। ক্রিকেটই একমাত্র দলীয় খেলা যা পুরো দেশকে মুখর করে রাখে।
হঠাৎ করে ক্রিকেটে বড় ধরনের ছন্দপতন! নেতিবাচক কার্যকলাপ ও চিন্তাভাবনা! মানসিক শক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রদর্শন! আত্দবিশ্বাসে চির আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
একটা দলের জন্য প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর মধ্যে থাকতে পারে ইনজুরি এবং অন্যান্য সমস্যা। তাই বলে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। যতটুকু সামর্থ্য আছে সেটা নিয়ে উজ্জীবিত হয়ে দলীয় খেলা খেলতে হবে। আইডিয়েলের প্রয়োজন আছে।
তবে এটাও ঠিক, দলের জন্য কেউ কখনো অপরিহার্য নন। দেশের জন্য খেলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে একত্রিত করেই তো খেলতে হবে।
ক্রিকেট দলীয় খেলা। শতভাগ টিম গেম। একটা দলের ঐক্য সুদৃঢ় হয় তখনই, যখন সবাই পরস্পরের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ায়। সবাই ঐক্যজোট হয়ে সর্বাত্দক চেষ্টা করে ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ে। সর্বোপরি নিজের খেলাটা উপভোগ করে সবাই। কোনো নেতিবাচক ধারণাকে মনের ধারে-কাছেও আসতে দেয় না। মানসিক ও ইচ্ছাশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রত্যাশার সঙ্গে প্রয়োজন প্রতিজ্ঞা। স্বপ্নশক্তির সঙ্গে গঠনশক্তি। খেলায় হার-জিত আছে, এটা থাকবে। জয়-পরাজয় ক্রিকেটীয় অসম্পূর্ণতা ও অপক্বতা, মাঠে অসময়ে আত্দসমর্পণ, ভেঙেপড়া, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারা, দায়িত্বহীন আচরণ, স্বার্থপরতা এবং গেমপ্ল্যান অনুযায়ী না খেলে বিশৃঙ্খলভাবে খেলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা_ এসব বিষয়ে আত্দবিশ্লেষণ এবং আত্দোপলব্ধির প্রয়োজন আছে। খেলার সঙ্গে শুধু তো ক্রিকেটাররা জড়িত নন।
জড়িয়ে আছে পুরো দেশ। দেশের আত্দগরিমা এবং ভাবমূর্তি। মানুষ তখনই আনন্দ এবং গর্বে জ্বলে ওঠেন যখন খেলোয়াড়দের মধ্যে নিজ দেশকে দেখতে পান।
ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা_ আমরা জানি। এই প্রাণধর্মী খেলায় আগাম কিছুই বলা যায় না।
অবশ্যই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাগ্যও। তবে এটাও ঠিক যারা উদ্যোগী পুরুষ সিংহ, সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করে, যারা আত্দবিশ্বাসী, নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন এবং আস্থা রাখে যা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কার্যক্ষেত্রে সেটাকেই প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে, ভাগ্য কিন্তু তাদের দিকে ঝুঁকে থাকে। বার বার একই ভুল করা, নিজকে সংশোধন না করা, অন্যদের ভালো কিছু দেখেও শিক্ষা না নেওয়া, সব সময় মুখে একরকম আর বাস্তবতায় অন্যরকম। পরে ভুলের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার পাশাপাশি ভাগ্যের দোহাই দিয়ে তো লাভ নেই।
ক্রিকেট বাঙালি জাতির কাছে শুধু একটা নিছক খেলা নয়, এর চেয়েও বেশি আরও কিছু।
রাজনৈতিক কারণে দ্বিধাবিভক্ত জাতির কাছে ক্রিকেট জাতীয় সংহতির সবচেয়ে আবেদনময়ী বিজ্ঞাপন। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে জাতির আশা এবং স্বপ্ন। দেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমিক মানুষ সব সময় ক্রিকেটারদের পেছনে ভালো এবং খারাপ সময়ে উচ্ছ্বাস, আবেগ, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা দেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের জন্য অনেক বড় শক্তি এবং অনুপ্রেরণা। টেস্ট প্লেইং কান্ট্রিগুলোর মধ্যে ভারতের পর জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ জাতীয়তাবাদের চিন্তায় উজ্জীবিত হয়ে সব সময় ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকেন।
ক্রিকেট বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই নির্মল বিনোদন এবং আনন্দের একটা উপলক্ষ হতে পেরেছে। মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িতে বাড়িতে, হেঁশেল ঘরে পর্যন্ত ক্রিকেট তার জায়গা করে নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি ও সামাজিক কয়েকটি ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো। মানব উন্নয়ন সূচকের অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ খুবই ভালো করেছে। আমাদের ক্রিকেট এখনো সহনীয় অবস্থায় আসতে পারেনি।
একনাগাড়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো সময় পার করতে পারেনি। মাঠে পারফরম্যান্সের গ্রাফ ওঠা-নামার মধ্যেই আছে। দেশে ক্রিকেটারের সংখ্যা এবং মান দুটি কম। তারপরও আমরা আশাবাদী, ক্রিকেটে এই অবস্থা থাকবে না। বাংলাদেশ পথ হারাবে না।
সম্ভাবনার আলো তো আমরা দেখতে পাচ্ছি।
খুব বেশি প্রয়োজন দেশের ক্রিকেটকে ঢেলে সাজানো। ক্রিকেটকে যত্নসহকারে লালন-পালন। ঘরোয়া ক্রিকেটকে উপেক্ষা না করে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোগত অবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন।
বাস্তবতার আলোকে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে ক্রিকেটের সম্ভাবনার জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। ক্রিকেটের অভিভাবক হিসেবে বোর্ডের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। প্রয়োজন শুধু ক্রিকেট বোর্ডের কার্যক্রমে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা। পেশাদারি মনোভাব নিয়ে সম্মিলিতভাবে দেশের ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করা।
সম্প্রতি দেশের মাটিতে পরিচিত কন্ডিশন এবং দর্শকের সামনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের ক্রিকেটাররা সম্মিলিতভাবে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্রিকেটারদের মাঠের পারফরম্যান্স সচেতন এবং সাধারণ মহল সবার আশা ভঙ্গ করেছে। পুরো সিরিজে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে ক্রিকেটার কীভাবে খেলেছেন, কীভাবে খেলা উচিত ছিল তা ক্রিকেটাররা নিজেরাও বুঝতে পেরেছেন। শ্রীলঙ্কা দলের সফর এখন অতীতের খাতায় ঢুকে পড়েছে ঠিকই, তবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে সব কিছু কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে। যা থেকে আগামীতে ভাবার এবং বোঝার দরকার আছে।
শ্রীলঙ্কা সফর শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছে এশিয়া কাপের জমজমাট টুর্নামেন্ট। ২০১২ সালে ঢাকার মাঠে এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র দুই রানে হেরে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়েছে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ভারত এবং শ্রীলঙ্কাকেও পরাজিত করেছে। সঙ্গতভাবে সবাই আশা করছেন আমাদের ক্রিকেটাররা উজ্জীবিত হয়ে আবারও আত্দবিশ্বাসের সঙ্গে ভালো ক্রিকেট খেলবেন। কিন্তু লক্ষ করা গেছে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যখন পুরো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতার উষ্ণতার আবির মেখে থাকার কথা, অনুপ্রাণিত থাকার কথা, সেখানে এক ধরনের জড়তা এবং সঙ্কুচিত ভাব! প্রত্যয় এবং মানসিক বলের অভাব।
আমাদের ক্রিকেটাররা আত্দবিশ্বাসের সঙ্গে কিছু ভাবতে পারছেন না। অধিনায়কের প্রথমদিকের বক্তব্যে লক্ষ্য করা গেছে এক ধরনের হতাশা এবং নেতিবাচক মনোভাব। ইনজুরি এবং অন্য সমস্যার খপ্পরে পড়েছে দল। সমস্যা আছে টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক এবং দলের মধ্যে সবই সত্যি! কিন্তু কথা হলো, ভেঙে পড়ে তারপর পরিস্থিতির কথা ভেবে তা সামাল দেওয়ার জন্য মুখে আবার অন্য কথা বলে কি রক্ষা পাওয়া যায়। প্রয়োজন তো আত্দবিশ্বাস, দলগত সংহতি এবং দায়িত্বশীলতা।
পুরো দেশের মানুষ যেখানে পেছনে সেখানে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসের সঙ্গে ইতিবাচক ক্রিকেট খেলার সর্বাত্দক চেষ্টা না করার তো কোনো কারণ নেই। যোগ্য দল জিতবে। কিন্তু লড়াই তো করতে হবে দেশের জন্য নিজেদের উজাড় করে। দেশের হয়ে খেলার চেয়ে বড় গৌরব আর কী হতে পারে!
লেখক : কলামিস্ট এবং বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।