বিশ্বাস অনেক বড় জিনিস..........
অনেক ছোটবেলার কথা। তখন আমরা সকালবেলায় মহল্লার মকতবে আরবী পড়তে যেতাম। রাস্তার পাশে সেই ছোট বেলা হতেই দেখে আসছি ছোট্ট উচুঁ পাকা একটা ঘর। লতা পাতা, আর বিভিন্ন গাছপালায় ছেয়ে থাকা ছোট ঘরটাতে ছোট একটা সুন্দর দরজাও ছিলো। আমরা কারণে অকারণে বিভিন্ন সময়ে কৌতুহল বসত সেখানটায় উকিঁঝুকি মারতাম ভয়ে ভয়ে।
পরে যখন জানলাম সেটাতে নাকি অনেক আগে হিন্দুরা মৃত ব্যক্তিকে পুড়ত, তখন থেকেই ভীষণ ভয়ে আর ওটার ধারে কাছেও যেতামনা।
হিন্দুদের হওয়ায় সেটার প্রতি আমাদের অল্পস্বল্প ঘৃণারও জন্ম নিলো আমাদের ছোট্ট মনে। সে ঘৃণার ফলেই হোক আর দুষ্টুমীরই ফসল হোক একদিন কি ভেবে একটা ছেলে সেখানটায় হিসু করে দিল। সে খবর কিভাবে জানি হুজুরের কানেও চলে গেল। হুজুর সে ছেলেটিকে আচ্ছামতো পিটালো।
এবং সবাইকে পরবর্তীতে এরকমটি না করতে উপদেশ দিলেন এ বলেযে, সেটা হিন্দুদের জন্য পবিত্র জায়গা, আমাদের জন্য যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা ও মকতব। হোকনা সেটা অনেক পুরানো, অব্যবহৃত এবং পরিত্যক্ত। তারপর থেকে সেখানে আমরা কেউ আর ঢিল ছোড়া, প্রস্রাব করা থেকে সম্পুর্নভাবে বিরত থাকতাম। সেটা ভয়ে নয়, ছোট্ট মনে ওটার প্রতি সম্মানবোধ জন্মানোয়।
আরেকটু বড় হয়ে স্কুলে গেলাম।
আমার প্রাইমারী স্কুলের সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলো একজন বিধর্মী, নাম বিকাশ বড়ুয়া। সে আমাকে ছেড়ে, আমি তাকে ছেড়ে কখনোই ক্লাসে বসতামনা। এমনকি আইসক্রীম খাওয়া থেকে শুরু করে আচার খাওয়াও একসাথেই। এখনো তার সাথে দেখা হলেই তাকে জড়িয়ে ধরি।
তখন প্রাইমারীতে পড়ি।
যখন হিন্দু স্যার কোন সমস্যার কারনে স্কুলে আসতে পারতেন না, তখন আমাদের হুজুর স্যারই একসাথে হিন্দু আর ইসলামিয়াত ক্লাস করাতেন। প্রথমে ইসলামিয়াত পরে হিন্দু ধর্ম।
ছোট বেলা হতেই দেখে আসছি। টিভির অনুষ্ঠান শুরুর সময় কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। তারপর গীতা পাঠ।
কোরআন তেলাওয়াত শোনার পর আমরা ছেলেপুলেরা গীতা পাঠ নিয়ে কতো ঠাট্টাটাইনা করতাম। মাঝে মাঝে টিভি বন্ধ করে দিতাম। সাউন্ড অফ করে দিতাম। কিন্তু একজন মুরব্বি একদিন বল্লেন কেন গীতাতে কি সমস্যা? দেখো কি বলে। আমাদের যেমন কোরান তেমনি ওদের গীতাও পবিত্র গ্রন্থ।
তখন থেকে কেন জানি সেই ছোট্ট মনে একটু অপরাধবোধ আর সেটার প্রতি সম্মানবোধও জন্মাতে লাগলো। এর পর থেকে আর গীতা পাঠের সময় টিভি বন্ধ করতামইনা, মন দিয়ে শুনতাম।
আমার এক বান্ধবী, তাকে একবার কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা টিভিতে যখন কোরআন তেলাওয়াত হয়, আযান দেয় তখন তোরা কি করিস? সে নির্ভয়ে উত্তর দেয়, প্রথম প্রথম আমি টিভি বন্ধ করে দিতাম, কিন্তু আম্মু বকা দিতেন। বলেন এটা ঠিক না।
শুনতে না চাইলে অন্য কাজ কর, এভাবে একটা চলমান জিনিসকে বিধর্মীও বলেই থামিয়ে দেয়াটা ঠিক না, এতে অসম্মান হয়। এখন আর টিভি বন্ধ করিনা। শুনতে ভালই লাগে। যদি শুনতে ইচ্ছে না হয় ওই সময়ের পরেই টিভি অন করি।
আমাদের স্কুলের একজন হিন্দু স্যার, তিনি ক্লাস চলাকালীনবস্থায় আযান হলে তিনি পাঠদান বন্ধ রাখতেন।
এও বলতেন যারা নামায পড়তে ইচ্ছুক তারা নামায পড়তে যেতে পারে। ক্লাসের গুটি কয়েক ছাত্র নামায পড়তে গেলেও দু'একজন এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ক্লাস ফাঁকি দেয়ার মতলব করতো। একদিন সেটা স্যারের কানেও গেল। স্যারের এমন মেজাজ খারাপ হয়েছিলো যে ছেলে দুটোকে পরদিন এ্যাসেম্বলী থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত রোদের মাঝেই মাঠে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
আমাদের গ্রামে বেশ ক’টি হিন্দু, বৌদ্ধ মহল্লা আছে।
ওদের সাথে মুসলিমদের এতো সহনশীল সম্পর্ক যে মনেই হয়না আমরা অন্য ধর্মের। কেবল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেই সেটা বুঝা যেত। আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বিরক্ত হওয়াতো দূরে থাক, উনারা বরং সেটা আনন্দ চিত্তেই উপভোগ করতো। ওদেরগুলোও আমরা। ওদের পুজোগুলোতে আমরা যে যাই তারা সেটা দেখে আলাদা মিস্টি এনে রাখতো মুসলমান বন্ধুদের জন্য।
আমাদের যেকোন অনুষ্ঠানেই (বিয়ে, পিকনিক, ঈদ, কোরবানী) তারা কোন প্রকার সঙ্কোচ ছাড়াই এসে উপভোগ করতো।
আমাদের গ্রামে দু’জন খুবই প্রসিদ্ধ ডাক্তার ছিলেন, এখনো আছেন, একজন চিত্তরঞ্জন আরেকজন মিলন বাবু। এতো অমায়িক, শান্ত মেজাজের মানুষ আমি আর দেখিনি। উনাদের হাতের চিকিৎসা পায়নি এমন কোন নারী পুরুষ, ছেলে বুড়ো, শিশু বৃদ্ধা আমি মনে হয় আমাদের গ্রামে খুঁজে পাবোনা।
ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের বাড়ীতে একজন হিন্দু বৃদ্ধা আসতেন সবসময়।
অনেক বয়স্কা, কিন্তু এখনো সেকি শক্ত। পায়ে হেঁটেই গ্রামের এপাশ হতে ওপাশ ঘুরে বেড়ান। সর্বদা সাদা শাড়ি পরা সে বৃদ্ধাকে সবাই বীনার মা বলেই জানতো। অমায়িক ব্যবহার, সর্বদা হাসিখুশি ওই মহিলাটির আসল নামটা জানা হয়নি কখনো। উনাকে এতো সম্মান দেয়ার হেতু বুঝতাম না তখন।
যখনি কারো ঘরে কোন মহিলা (মা) অসুস্থ হতেন উনাকে ডাকা হতো। গ্রামে এত ভাল ভাল মুসলিম ডাক্তার থাকতে উনাকে ডাকার কারণ কি বুঝে উঠতে পারতামনা। বড় হওয়ার সাথে সাথে তা একটু একটু করে বুঝে গেলাম। উনি ছিলেন একজন দাই। উনার কাজ এতো নিখুঁত ছিল যে উনার হাতে আজ পর্যন্ত কোন মা কিংবা শিশু প্রাণ হারিয়েছে এমন খুব কমই শোনা যায়।
উনার একটা গুন ছিলো উনি যতবারই কোন কাজে যেতেন ততবারই নাকি গোসল করেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে তারপর যেতেন। উনার নিখুঁত কাজ, আর সুন্দর ব্যবহারের কারণে উনি আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে পরের গ্রামেও সমান সম্মানিত ছিলেন। আমাদের আশপাশের বাড়ির প্রায় ৭০% ছেলে মেয়ে উনার হাতেই জন্ম।
উপরের কথাগুলো বলার কারণ একটাই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
একই সাথে একই গ্রামে, পাশাপাশি দুটো ধর্মের মানুষ কি ভাবে মিলেমিশে থাকতে পারে, একে অপরের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে সহাবস্থান করতে পারে সেটা তারই প্রমান। কেউ কেউ ব্লগেও মুর্খের মতো অসাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলে আমাদের সুস্থ মস্তিস্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করার বৃথা চেষ্টা করে। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে পুরো সমাজের সুস্থ পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা কতো যে বোকামী তা তাদের দেখলেই বোঝা যায়।
আজ পর্যন্ত অন্তত আমাদের গ্রামে দেখিনি যে, হিন্দুদের পুজোর কারনে কোন মুসলিমকে বিরক্ত প্রকাশ করতে। আবার এমন কোন হিন্দুকেও দেখিনিযে মুসলিমদের ধর্মীয় আচার আচরণে কোন প্রকার তিক্ততা প্রকাশ করতে।
যারা বলে হিন্দু পূজার কারণে মুসলমানদের ঘুম হারাম হয়, যারা বলে মুসলমানদের আযানের কারনে হিন্দুদের ঘুমের সমস্যা হয় তারা মুর্খ, বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গীর্জা সবই যার যেটা, সে মতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র ও শান্তির স্থান। এবং সেখানটায় যে যার মতো করে শান্তি খুঁজে নিতেই যার যার নিয়ম মতোই ধর্ম পালন করে থাকেন। এবং সেটার আনুসঙ্গিক কিছু কর্মের কারণে ভিন্নধর্মীদের জীবন চলায় শান্তি বিঘ্নীত হয়, সেটা মনে করাটাই বোকামী। যারা এরকমটি মনে করে তাদের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
আমার ছোট্ট মনে সেই ছোট্ট ঘরটির প্রতি সম্মান জন্মানোয় আমি ধর্মহীন হয়ে যাই নি। হিন্দু বন্ধুর সাথে এক বেঞ্চে বসে আচার ও আইসক্রীম খাওয়ায় আমার ধর্মত্ব চলে যায়নি। হিন্দু শিক্ষকের কাছে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠায় আমি অমানুষ হয়ে বেড়ে উঠিনি। টিভিতে আযান কিংবা কোরআনের তেলাওয়াত শুনে সেই বান্ধবীর হিন্দুত্ব চলে যায়নি। আমার গীতা পাঠ শুনে কোরআনের অপমান হয়নি।
ক্লাসে আযানের সময় পাঠদান বন্ধ রাখায় সেই স্যারের নিজ ধর্মের অপমান হয়নি। একসাথে হিন্দু আর ইসলামিয়াত পড়ানোয় হুজুর স্যারের মুসলমানিত্ব হারিয়ে যায়নি। চিত্তরঞ্জন আর মিলনবাবুর চিকিৎসায় কোন মুসলমানের রক্ত অপবিত্র হয়ে যায়নি। সব শেষে একজন হিন্দু দাইয়ের হাতে জন্মানোয় আমি আমার মুসলমানিত্ব হারাইনি।
অনেককেই দেখা যায় নিজ নিজ ধর্মকেও হেয় করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনা।
আপনি ধর্ম পালনে অপারগ, অক্ষম সেটা যে কারনেই হোক , ইচ্ছা অনিচ্ছাকৃত যেকারণেই হোকনা কেন, সেটার দায়ভার আমার/ আপনার নিজ নিজ। ধর্ম পালনটা মনের ব্যাপার, বিশ্বাসের ব্যাপার। পালন করতে না পারি/করি, কিন্তু আমি ধর্মকে আঘাততো করতে পারিনা, হেয় করতে পারিনা, অপমান করতে পারিনা, ঘৃণা করতে পারিনা। সে যে ধর্মই হোক। হোক নিজ ধর্ম কিংবা অন্য কোন ধর্ম।
আমার ধর্ম আমার কাছে সবসময়ই সর্বোত্তম, পবিত্র ও শান্তিময় । তার মানে এ না যে অন্য ধর্মগুলোকে হেয় করা, অপমান করা, ঘৃণা করার ধৃষ্টতা দেখাতে যাবো। এটা কখনোই উচিত না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান সবাই আমার দেশে মিলে মিশেই থাকুক সে কামনাই করি। আমার দেশ হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শ্রেষ্ট উদাহারন।
সকলের মঙ্গলময় জীবন কামনায়.. ...............................................
পোষ্টটি ব্লগের সকল হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ভাইদের জন্য উৎসর্গিত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।