আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি নিছক পাগলামির গল্প

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! শাইখ অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত মুখে গাবতলিতে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। রাগও হচ্ছে একটু একটু। একটুর জন্য সে সাড়ে তিনটার এসি বাসের টিকিট মিস করে ফেলেছে। দশ মিনিট আগেও নাকি সেই বাসের টিকিট বিক্রি হয়েছে।

কিন্তু এখন টিকিট নাই। এখন গেলে লক্কর ঝক্কর বাসেই বাসায় যেতে হবে। আর আগের অভিজ্ঞতা থেকে শাইখ জানে, লক্কর ঝক্কর বাসে এতটা পথ পাড়ি দেবার অনুভূতি মোটেও আনন্দের কিছু নয়। ঝাঁকির ঠেলায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। শাইখের চোখের সামনে দিয়ে দেদারসে লক্কর ঝক্কর বাসের টিকিট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

লোকজন হামলে পড়ে টিকিট কিনছে। দেখে মনে হচ্ছে এখানে রিলিফের চাল দেয়া হচ্ছে, আর এই লোকগুলো সব দুঃস্থ গরীব মানুষ। আরেকটু দেরি করলে এই বাসেরও টিকিট পাওয়া যাবে না। তখন দাঁড়িয়ে যেতে হবে। আগে বসে বসে লাফাতে হত, তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাফাতে হবে।

শাইখ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিছু করার নেই। টিকিট তাকে পেতেই হবে। আহ, কতদিন বাসায় যাওয়া হয় না। আহ, মাকে কতদিন দেখা হয় না।

শাইখের মা দশ পনের দিন ছেলেকে না দেখলেই অস্থির হয়ে যান। বারবার ফোন করেন। বারবার। মাঝে মাঝে শাইখ বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে রাখে। এক দিন।

দুই দিন। তারপরই খারাপ লাগতে শুরু করে তার। অসম্ভব খারাপ। গা গোলানো খারাপ। অনুতাপে ফোন খোলে শাইখ।

ফোন দেয় মার নাম্বারে। অপরাধীর মত গলা করে বলে, মা, কেমন আছ? মা তখন ঈষৎ অভিমানে বলে ওঠেন, ফোন বন্ধ রেখেছিলি কেন? মাকে মনে পড়ে না বুঝি? শাইখ তখন নানা ধরণের অজুহাত বানিয়ে বানিয়ে বলে। হয় বলে ফোনে চার্জ ছিল না, নাহলে বলে সাইলেন্ট ছিল। কিন্তু এসবই সে বলে অনিচ্ছায়। বলে নিরুপায় হয়ে।

এসব তার বলতে ইচ্ছা করে না। বরং তার খুব বলতে ইচ্ছা করে, “সরি মা”। কিন্তু দুনিয়ার আরও হাজার রকম কথা বলা হলেও এই আপাতদৃষ্ট ছোট ও নিরীহ কথাটাই কখনও বলা হয় না শাইখের। শাইখ ভিড় ঠেলে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, মামা, ভাড়া কত? উত্তর আসে, তিনশ টাকা।

বিরক্তিতে কুঁচকে যায় শাইখের মুখ। দুই মাস আগেও নরমাল বাসের ভাড়া ছিল দুইশ বিশ টাকা। এখন এক লাফে সেটা তিনশ হয়ে গিয়েছে। সামনে আরও কত বাড়বে কে জানে। মামা কম হবে না? না।

শাইখ পকেটে হাত দেয়। মানিব্যাগটা বের করে আনে। টাকাটা বের করে কাউন্টারে দিতে যাবে, এমন সময় তার চোখ পড়ে প্রায় বিশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার হাতে বড় বড় দুইটা ব্যাগ। ব্যাগের ভারে মেয়েটা কুঁজো হয়ে আছে।

টিকিট না কিনে শাইখ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটাকে লক্ষ্য করতে থাকে সে। মেয়েটা ব্যাগ দুইটা মাটিতে রাখে। পার্স থেকে মোবাইল বের করে। খুব চিন্তিত মুখে কারও সাথে কথা বলতে থাকে সে।

শাইখের আর টিকিট কেনা হয় না। কেমন একটা দম বন্ধ করা অনুভূতি হতে থাকে তার। এই মেয়ে তার ক্লাসমেট। শাইখ মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

মেয়েটা তার দিকে তাকায়। প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে একটা মুচকি হাসি ঢেউ খেলে যায় মেয়েটার মুখ জুড়ে। মোবাইলে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে সে। তারপর শাইখের দিকে তাকিয়ে বলে, আরে, তুমি এখানে? শাইখ বলে, হ্যাঁ, বাসায় যাব। তোমার বাসা কোথায়? তোমারটা কোথায়? যশোর।

শাইখ মুচকি হেসে বলে, আমারও। মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, তাই? হুম। কোথায়? আগে তোমারটা বল। পালবাড়ির মোড় চেন? চিনব না কেন? ওখান থেকে দুই মিনিটের হাঁটা পথ। ও আচ্ছা।

তোমারটা? ঐ তো ওখান থেকে রিকশায় বিশ মিনিট। ও আচ্ছা। টিকিট কেটেছ? না। তুমি? না। আচ্ছা তুমি কি একা যাবে? হুম।

কেন আমাদের ক্লাসের আর কোন মেয়ের বাসা যশোরে নাই? আছে, কিন্তু ওরা সব কালকে যাবে। ভোরে। আমারও একই অবস্থা। কোন পার্টনার নাই। একা।

তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। মেয়েটা তাকিয়ে রইল নিচে। শাইখ ঘুরে কাউন্টারের দিকে তাকাল। দেখল, লোকজন টাকা হাতে চিল্লাপাল্লা করছে। টিকিট মনে হয় ফুরিয়ে গেছে।

শাইখই নীরবতা ভাঙল, চলো টিকিট কাটি। মেয়েটা কার্টুনের মত একটা মুখভঙ্গি করল। তারপর বলল, চলো। শাইখ মেয়েটার একটা ব্যাগ তুলে নিল। মেয়েটা বাঁধা দিয়ে বলল, আরে কি করছ কি করছ? শাইখ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল।

মেয়েটা বলল, এই এই কোথায় যাচ্ছ? এস আরের কাউন্টার এদিকে না? শাইখের গমনপথের উলটো দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল সে। শাইখ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম। চলো। বলে মেয়েটার দেখানো পথে হাঁটা শুরু করল সে। কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এস আরের আজকের সব বাসই ছেড়ে গেছে, আর মাত্র একটা বাস বাকি আছে।

সেটাতেও মাত্র দশটা সিট ফাঁকা আছে। শাইখ টিকিট বিক্রেতাকে বলল, মামা জানালার পাশে একটা সিঙ্গেল সিট দেয়া যায়? পাশে মহিলা থাকবে এরকম সিট? মেয়েটা এসব শুনে অবাক হয়ে শাইখকে জিজ্ঞেস করল, মানে? তুমি কোথায় বসবে? শাইখ বলল, আমি নাহয় অন্য আরেকটা সিট নেব। কেন? আমার পাশে বসতে অসুবিধা আছে? না, যদি তোমার কোন সমস্যা হয়... আমার সমস্যা হবে কেন? তাহলে পাশাপাশি টিকিট কাটব? কাটো। আচ্ছা। আমি কিন্তু জানালার পাশে বসব না, আমার ঠাণ্ডা লাগে।

ঠিক আছে। শাইখ কাউন্টারে জিজ্ঞেস করল, মামা, দুইটা টিকিট কত? বিক্রেতা বলল, আটশ টাকা। কেন? এত বেশি কেন? বেশি কই? তেলের দাম বাড়ছে তো, তাই টিকিটের দামও বাড়ছে। ও। আচ্ছা আপনার কাছে এক হাজার টাকার ভাংতি আছে? দেন।

শাইখ তার মানিব্যাগ বের করে হাতড়ানোর ভান করে। এক হাজার টাকার কোন নোট সেখানে নেই। এক শ টাকার কয়েকটা নোট মনে হয় আছে। আর কিছু ভাংতি আছে। সে মুখে বিড়বিড় করে বলে, আটশ রেখে সে ফেরত দেবে দুইশ টাকা... মেয়েটা সেটা শুনতে পেয়ে বলে ওঠে, আরে আরে তুমি আমারটা দিচ্ছ কেন? কেন দিলে কি সমস্যা? আরে তুমি আমারটা দিবা কেন? এই যে...বলে নিজের পার্স থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দেয় সে।

লাগবে না। লাগবে না কেন? ধরো! অনেকটা ধমকের সুরেই বলে ওঠে মেয়েটা। পাঁচশ টাকার নোটটা ধরিয়ে দেয় শাইখের হাতে। শাইখ মানিব্যাগ হাতড়ে খুঁজে পাওয়া ভাংতি টাকাগুলোর সম্ভাব্য যোগফল খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, চারশ পনের হয়ে যাবে মনে হয়।

পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা বাদামওয়ালা। শাইখ মেয়েটাকে বলে ওঠে, ওকে একটু থামাও না যাও। কেন? এই দুপুরে বাদাম খাবে? হুম। আরে চলে গেল তো। থামাও না।

যাও। মেয়েটা বাদামওয়ালাকে ডাকতে চলে যায়। শাইখ মানিব্যাগ ঘেঁটে সব টাকাপয়সা বের করে কাউন্টারে রাখে। খুবই দ্রুতগতিতে একশ এবং পঞ্চাশ টাকার নোটগুলো বেছে বেছে আলাদা করে সে। তাতেও হচ্ছে না দেখে সে দশ বিশ টাকার নোট দিয়ে চারশ পনের টাকা পুরো করে শাইখ।

সেখান থেকে তিনশ আর মেয়েটার পাঁচশ টাকার নোট মিলে আটশ টাকা কাউন্টারে দেয় সে। রঙ্গিন দেখতে টিকিটটা একটু পরেই হাতে পায় শাইখ। টিকিট আর ব্যাগ নিয়ে একটু দূরে মেয়েটার সাথে মিলিত হয় সে। মেয়েটা ততক্ষণে একশ গ্রাম বাদাম কিনে ফেলেছে। শাইখ তার দিকে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই যে তোমার বাকি টাকা।

মেয়েটা সংকুচিত হয়ে টাকা গ্রহণ করে। বাদামের ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দেয় শাইখের দিকে। তোমার বাদাম। থ্যাংকস। সিট কোনটা কোনটা? ই ওয়ান আর টু।

ছাড়বে কখন? এই তো আর বিশ মিনিট পর। গাড়ি কি টার্মিনালে আছে? আছে। তাহলে চলো ওদিকে আগাই। চলো। আর ইয়ে, বাদামের দাম কত? কেন কি করবে? বল না।

একশ গ্রাম পনের টাকা। শাইখ একটু আগেই আলাদা করে রাখা পনের টাকা মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দেয়। মেয়েটা ভ্রূ কুঁচকে বলে, এই কি ব্যাপার? আমাকে টাকা দিচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে খাওয়ালাম। শাইখ বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা বুক পকেটে রেখে দেয়। ওরা হাঁটতে হাঁটতে টার্মিনালে পৌঁছায়।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর বাসটা চোখে পড়ে ওদের। ওরা দুজনে মিলে বাসে উঠে পড়ে। ব্যাগগুলো দেয়া হয় নিচের বক্সে। মেয়েটা জানালার পাশে বসে। শাইখ বসে ভিতরের দিকে।

একটু পরেই শাইখ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে কানে ধরে বলে, হ্যাঁ মা, বল। ...হ্যাঁ রওনা দিয়েছি। ...না বাস ছাড়েনি। এখনই ছাড়বে।

...হ্যাঁ একা আসছি। ...আচ্ছা। ...আচ্ছা। ...হ্যাঁ। ...না।

...আচ্ছা হ্যাঁ। ...রাখি মা। আল্লাহ হাফেজ। মেয়েটা বলে, তোমার আম্মু কল দিয়েছিল? শাইখ বলে, হুম। মেয়েটা মাথা নাড়ায়।

যেন অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। বাস চলতে শুরু করে। মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। শাইখ সিটে হেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিচঢালা রাস্তার বুক চিরে প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যায় এস আর পরিবহনের দিনের শেষ বাসটি।

*** রাত দশটা। বাস যশোরে পৌঁছে গেছে। শাইখ আর মেয়েটা বাস থেকে নেমে নিচের বক্স থেকে কেবল ব্যাগগুলো বের করেছে। শাইখ বলল, তুমি বাসায় যাবে কিভাবে? এই তো, গাড়ি আসবে। তুমি? আমি রিকশায় যাব।

তোমাকে আমাদের গাড়িতে পৌঁছে দি? না থাক। প্লিজ। না। মা অন্য কিছু ভাববে। আমি নাহয় দেখা করে আসব।

না। প্লিজ। ওকে। মেয়েটার গাড়ি চলে এল। ড্রাইভার মেয়েটার ব্যাগ নিয়ে পিছনের বক্সে রেখে দিল।

মেয়েটা গাড়ির দরজা খুলল। তারপর শাইখের দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ। ওয়েলকাম। একটা কথা বলব? বল। কলেজে তুমি মেয়েদের সাথে একদম কথা বল না।

এজন্য সবাই ভাবে তুমি নারীবিদ্বেষী, নারীদের সহ্য করতে পারো না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই? হুম। কিন্তু...আজকে আমাদের মধ্যে যা হল...তুমি আসলে অনেক ভালো একটা ছেলে শাইখ। হুম। তুমি আজকে আমাকে অনেক হেল্প করেছ।

অনেক। সত্যি কথা বলতে কি, এটা আমার এক্সপেক্টেশনের বাইরে ছিল। তার মানে আমি কাউকে হেল্প করতে পারব না? আমি তা বলছি না। আমি বলছি, গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল মেয়েটা, তুমি কলেজে এরকম মুখোশ পরে থাকো কেন? *** একটা দোকানের বাইরে ব্যাগ রেখে ওটায় ভর দিয়ে বসে আছে শাইখ। আকাশে কালো মেঘ।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শাইখ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। আজ পাঁচদিন ধরে ওটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। হা হা হা, মেয়েটা কি ধোঁকাটাই না খেয়েছে! সে মনে করেছে আমি আসলেই মার সাথে কথা বলছি! পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল সে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় দেখল, তার কাছে মোট সাইত্রিশ টাকা আছে।

আর আমি দেব ওর ভাড়া? আমার কাছে থাকবে এক হাজার টাকার নোট? হা হা হা! মানিব্যাগের মধ্যে আইডি কার্ড ছিল শাইখের। ওটা চোখের সামনে তুলে ধরল সে। অ্যাড্রেসের জায়গায় স্পষ্ট দেখা গেল, “MANIKGONJ, BANGLADESH”। আর মেয়েটা ভেবেছে আমি শালা যশোরের মাল! হা হা হা! আমি তো জীবনে প্রথম যশোরে আসলাম! শাইখ কালই বাসায় চলে যাবে। কিভাবে যাবে জানে না।

জানার প্রয়োজনও নেই। সে আকাশের দিকে তাকায়। কালো মেঘে এখনও ঢেকে আছে ওটা। কখন সরে যাবে কালো মেঘ? কখন আসবে জোছনা? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.