আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা

প্রতি মাসেই বিও হিসাব বন্ধ ও নিষ্ক্রিয় হওয়ার তালিকা বাড়ছে। সর্বস্ব হারানোর অবস্থা এখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'জেবুন নেসা আলো দরপতনের মহাপ্রলয়ে পুঁজি হারিয়ে শেয়ারবাজার ছাড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সরকারের আবেদন, নিবেদন ও আশ্বাসে তারা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। এ কারণে প্রতিমাসেই বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব বন্ধ ও নিষ্ক্রিয় হওয়ার তালিকা বাড়ছে। গত এক বছরে আট লাখ বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে।

অন্যদিকে নতুন খোলা হয়েছে দুই লাখ। এ ছাড়া প্রতিদিন লেনদেন হওয়া ১০ লাখ বিও হিসাবের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে পাঁচ লাখ। অর্থাৎ এসব হিসাবে এখন আর লেনদেন হয় না। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারের ইতিহাসে ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি বিও হিসাব খোলা হয়েছে। সূচক যতই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ততই সারা দেশের আনাচে-কানাচে থেকে স্রোতের মতো বিনিয়োগকারী ঢুকেছে বাজারে।

কিন্তু ডিসেম্বরে বাজার ধসের পর একই হারে কমতে শুরু করেছে তাদের সংখ্যা। সূত্র জানায়, পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ এখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ দূরের কথা, যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলেই যেন মুক্তি। কেস স্টাডি-১ : হাবিবুর রহমান সিকিউরিটিজের একজন বিনিয়োগ-কারী আবদুর রহিম। তিনি বিদেশে থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে ঋণছাড়া বিনিয়োগ শুরু করেন।

তার মোট বিনিয়োগের মধ্যে নিজের ২০ লাখ টাকা, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত দুই ভাইয়ের পাঁচ লাখ, বড় বোন জামাইয়ের পাঁচ লাখ এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ নিয়ে মোট ৩৫ লাখ টাকা। দেশে ফিরে তার আয়ের একমাত্র উৎস হয় শেয়ারবাজার। বাজার চাঙা হয়ে উঠলে তার মোট বিনিয়োগে ১০ লাখ টাকা মুনাফা যোগ হয়। তার পোর্টফোলিওতে সবগুলো শেয়ারও ছিল ভালো মৌলভিত্তির। এর মধ্যে অধিকাংশই আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেক্সিমকো গ্রুপ ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির।

কিন্তু এরপরও তার শেষ রক্ষা হয়নি। দরপতনের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সব সঞ্চয়। মুনাফাসহ পুঁজি নেমে এসেছে পাঁচ লাখ টাকার কোঠায়। বিদেশের মাটিতে শত কষ্টে অর্জিত পুঁজি হারানো কষ্ট বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে আত্মীস্বজনের কাছ থেকে নেয়া টাকা। নিজের তো হারানোর কিছুই বাকি নেই, আপনজনদের কাছে হাত পাতার মতো অবস্থাও নেই।

কী করবেন এখন তিনি এ কথা ভেবেই দিশেহারা। এখন তার মুখে একটাই কথা কোনো রকমে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন। মাঝে মাঝে আন্দোলনে যোগ দেন তিনিও। সম্প্রতি বিক্ষোভ করতে নেমে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছেন। ভাগ্যিস এক সময় ডিএসই ভবনে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন।

সে সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা। হাতের একপাশ কেটে গেছে পালাতে গিয়ে। ঘোরের মধ্যে খেয়াল করেননি। কথা বলতে শুরু করে নিজের হাত দেখছেন আর বলছেন। কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলছেন আর উপরের দিকে তাকাচ্ছেন।

চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কাঁদতে চান কিন্তু কাঁদতে পারেন না। কারণ তার পুঁজি হারানোর কান্না তো কেউ শুনতে পাবে না- এটুকু অন্তত নিশ্চিত হতে পেরেছেন। কেস স্টাডি-২ : শাহ মোহাম্মদ (ছদ্ম নাম) এম অ্যান্ড জেড সিকিউরিটিজের একজন বিনিয়োগকারী। আবুদাবিতে ছিলেন দীর্ঘদিন।

দেশে ফিরে খুব দাপটের সঙ্গেই একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। বেবী ট্যাক্সিও ছিল কয়েকটি। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথায় ঢুকল শেয়ারবাজার ভূত। ২০০৯ সালে ব্যাংকের বিপুল অলস টাকা বিনিয়োগের জায়গা নেই। এসব টাকা আসছে শেয়ারবাজারে।

রোড শো করে বিনিয়োগকারীদের ডাকা হচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই)। সরকার দেশের উন্নয়ন ও শিল্প করতে ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে শেয়ারবাজারে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। এসব প্রলোভনে মাহমুদুল হকও চাকরি ছেড়ে বেবী ট্যাক্সি বেঁচে সঞ্চয়ের সব টাকা নিয়ে ছুটে যান শেয়ারবাজারে। মৌসুমী নয় পেশাদার বিনিয়োগকারী হিসেবে লেনদেন শুরু করেন। কিন্তু প্রলোভনের ফাঁদ তার চলার পথ পাল্টে দিয়েছে।

তার ঋণসহ প্রায় এক কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। যেখান থেকে আয়ে প্রতিদিনের সংসার চলত সেখানে সূচক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই ঋণের বোঝা কমাতে তাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দুই মেয়েকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন তা শেয়ারবাজারের সূচকের মতোই একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে আর শেয়ারবাজারের আশা নয়, এখন তাকে বিকল্প কিছু করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হবে। তাই চান এখান থেকে মুক্তি।

কীভাবে কবে অবশিষ্ট টুকু নিয়ে বেরিয়ে যাবেন সেই অপেক্ষায় রয়েছেন তিনিও। এভাবেই লাখ লাখ টাকার বিনিয়োগকারীরা এখন অসহায় বালকের মতো কাঁদছেন। সর্বস্ব খুইয়ে কেউ নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে নেমেছেন। কেউবা আত্মহত্যা করে জীবন থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। নাম জানাতে অনিচ্ছুক আজম সিকিউরিটিজের এক বিনিয়োগকারী বললেন, সরকার গলা টিপে ধরে বলছে বাঁচতে।

আর উ: শব্দটি যেন করতে না পারে এজন্য পাহারা বসানো হয়েছে পুলিশের। সামরিক শাসনেও সাধারণ মানুষের কণ্ঠ রোধ করা হয় না এভাবে। বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, বিপর্যয় শুরুর পর সরকারি মহল থেকে বার বার বলা হয়েছে '৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি হবে না। ধৈর্য ধরে নতুন করে বিনিয়োগ শুরু করতে বলা হয়েছে। তাদের এ আহ্বানের ফাঁদে পা দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

কারণ এ সময়ের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে একের পর এক বেরিয়ে গেছে। আর তারল্য সঙ্কটে মরুভূমিতে বার বার পানি ঢেলেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে মূল পুঁজি ও নতুন বিনিয়োগ সবই সূচক পতনের স্রোতের তলানিতে এসে পড়েছে। ওই সময় এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস না দেয়া হলে অনেকেই অন্তত মূল পুঁজি ফেরত পেতেন। বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার ছাড়ার চিত্র প্রতিফলন হয় বিও হিসাবে।

২০১০ সালের ১ জানুয়ারি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের আওতায় বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৭টি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না করায় গত বছর জুলাই মাসে প্রায় এক লাখ এবং অক্টোবরে প্রায় ৩০ হাজার বিও হিসাব বাতিল করা হয়। তা সত্ত্বেও ৩১ ডিসেম্বর বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়ে ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ১৫৮ জনে দাঁড়ায়। সেই হিসাবে এক বছরে পুঁজিবাজারে নতুন প্রায় ১৯ লাখ ৪২ হাজার বিনিয়োগকারী যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে বড় ধরনের লোকসান দেয়ার পর অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন।

একই সঙ্গে নতুন বিও হিসাব খোলার হারও কমতে থাকে। এতে ২০১১ সালে দুই লাখ ৯০ হাজার ৬১০টি বিও হিসাব খেলা হয়, যার বিপরীতে বন্ধ হয়ে যায় আট লাখ তিন হাজার ৫৬৮টি। ২০১১ সালের বিও হিসাব খোলা ও বন্ধ হওয়ার হিসাব পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জানুয়ারিতে নতুন হিসাব খোলা হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৮১৬টি। যার বিপরীতে বন্ধ হয়েছে ছয় হাজার ৯৬২টি, ফেব্রুয়ারিতে খোলা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৪৯টি এবং বন্ধ হয়েছে ১৩ হাজার ৬৭৪টি, মার্চে খোলা হয়েছে ২৭ হাজার ৩৯১টি এবং বন্ধ হয়েছে ১২ হাজার ৪২৭টি, এপ্রিলে খোলা হয়েছে ১২ হাজার ৬০৮টি এবং বন্ধ হয়েছে সাত হাজার ২৬৮টি, মে মাসে খোলা হয়েছে নয় হাজার ৫৩৭টি এবং বন্ধ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৬টি, জুনে খোলা হয়েছে ছয় হাজার ১৫৬টি এবং বন্ধ হয়েছে দুই লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৭টি, জুলাইয়ে খোলা হয়েছে ২৩ হাজার ৩৮১টি এবং বন্ধ হয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৯টি, আগস্টে খোলা হয়েছে ২১ হাজার ২০১টি এবং বন্ধ হয়েছে ৪৯ হাজার ৪৭টি, সেপ্টেম্বরে খোলা হয়েছে ২১ হাজার ২০১টি এবং বন্ধ হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৩০টি, অক্টোবরে খোলা হয়েছে ৩৩ হাজার ১৪৬টি এবং বন্ধ হয়েছে তিন হাজার ৯৭৬টি, নভেম্বরে খোলা হয়েছে আট হাজার ১০৩টি এবং বন্ধ হয়েছে তিন হাজার ৬৪৮টি, ডিসেম্বরে এসে খোলা হয়েছে নয় হাজার ৯২২টি এবং বন্ধ হয়েছে দুই হাজার ৫৫৪টি। বর্তমানে মোট বিও হিসাব রয়েছে ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪টি।

তবে প্রতিদিন সব বিও থেকে লেনদেন হয় না। সে অনুযায়ী ২০১০ সালে প্রতিদিন সক্রিয় বিও সংখ্যা ছিল নয় লাখ ৩৩ হাজার। গত বছরের ডিসেম্বরে এসে সক্রিয় বিও সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ৯৫ হাজারে। অর্থাৎ পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার বিও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় প্রতিদিনের লেনদেনে।

২০১০ সালে যখন প্রতিদিন ১০ লাখ বিও সক্রিয় ছিল তখন লেনদেন হতো দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে। এখন লেনদেন নেমে এসেছে ২০০ কোটি টাকার ঘরে। এ ব্যাপারে ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখতে না পারলে মন্দার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে বলেই বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা এখন বাজার বিমুখ হয়ে পড়লে তাদের আবার ফিরিয়ে আনা এবং বাজার গতিশীল করা কঠিন হয়ে পড়বে।

একই সঙ্গে সরকার পুঁজিবাজার থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব পেত তাও হারাবে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারী শূন্য হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কর্মসংস্থান হারাবে। সব মিলিয়ে একটি বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.