আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঁজিবাজার কারসাজির নেপথ্যে গড ফাদার সাহাবুব আলম

ভালকে সমর্থন এবং খারাপকে বর্জন করতে শিখুন ।

পুঁজিবাজারে নতুন ধরণের প্রডাক্টের মাধ্যমে নিত্যনতুন কারসাজির নেপথ্যে এক গড ফাদারের সন্ধান পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকার পর সম্প্রতি তার মুখোস উন্মোচন হয়েছে। পুঁজিবাজারে সরাসরি লেনদেনে জড়িত না থাকলেও পরামর্শ ফি'র মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তাদের অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে সহযোগিতা করেন তিনি। তিনি বেক্সিমকো গ্রুপের সাবেক উপদেষ্টা ও সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক সদস্য একেএম সাহাবুব আলম।

তার বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় কোনো কোম্পানির অভিহিত মূল্যের শেয়ার কমপক্ষে দশগুণ বেশি দরে বিক্রি করে দেয়ার লিখিত গ্যারান্টির অফার লেটার পাওয়া গেছে। পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন এবং কারসাজির স্বরূপ উদ্ঘাটনে গঠিত তদন্ত কমিটি এ ধরণের একটি অফার লেটারের কপি পেয়েছেন। পুঁজিবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, প্রেফারেন্স শেয়ার, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন ও বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের নতুন ধ্যান-ধারনাটি সাহাবুব আলমই প্রথম দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই সাহাবুব আলমের পরামর্শ নিয়েই সালমান এফ রহমানসহ বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ধরণের কর্মকাণ্ড শাস্তিমূলক অপরাধ হলেও আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এসইসি।

২০০৯ সালের ১ অক্টোবর সাহাবুব আলমের লেখা অফার লেটারে কোনো কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার কমপক্ষে একশ টাকায় বিক্রি করে দেয়ার জন্য এ সংক্রান্ত সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ও সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার অনুমোদন সম্পন্ন করে দিতে নিশ্চয়তা দেন। এজন্য হাইকোর্ট থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন, এসইসি, ডিএসই ও সিএসইর অনুমোদন এনে দেয়া হবে বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এছাড়া কোম্পানির সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করাসহ মার্জার (একাধিক কোম্পানির একত্রীকরণ) করে দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। আর সব ধরনের প্রক্রিয়া ৩১ মার্চ ২০১০ এর মধ্যে সম্পন্ন করারও গ্যারান্টি দেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শাইন পুকুর সিরামিকস ও নাভানা সিএনজির সরাসরি তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ায় পরামর্শক হিসেবে একেএম সাহাবুব আলম কাজ করেছেন।

সরাসরি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় এ দুটি কোম্পানির উদ্যোক্তাদের তিনি প্রত্যাশার চাইতে অনেক বেশি অর্থ সংগ্রহ করে দেন। এ দুটি কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তির কাজে সফলতা পাওয়ায় পরবর্তিতে আরো কয়েকটি কোম্পানিকে এ প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্তির প্রস্তাব দেন তিনি। প্রস্তাবে সরাসরি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় পনের কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকায় পুঁজিবাজারে বিক্রি করে দেয়ার লিখিত গ্যারান্টি দিয়ে অফার লেটার (প্রস্তাব পত্র) দেন বিভিন্ন কোম্পানিতে। কিন্তু ২০১০ সালে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য সরাসরি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভিন্নপথ অবলম্বন করেন তিনি। এবার বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে উচ্চ প্রিমিয়ামে তালিকাভুক্তির প্রস্তাব দেন তিনি।

এজন্য সাহাবুব আলম লিখিত গ্যারান্টি দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রস্তাব পাঠান। অভিযোগ রয়েছে, সালমান এফ রহমানের সহযোগিতায় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন সাহাবুব আলম। গত দু'বছরে সালমান এফ রহমান যেসব কোম্পানির প্লেসমেন্ট নিয়েছেন এর প্রায় সবগুলোই নিয়েছেন সাহাবুব আলমের সহযোগিতায়। সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেঙ্মিকো লিমিটেডের সাথে ঢাকা সাংহাই সিরামিক, বাংলাদেশ অনলাইন লিমিটেডসহ বিভিন্ন কোম্পানি একত্রীকরণের পরামর্শ তিনিই দিয়েছেন। বেক্সিমকো কোম্পানির ঋণ শেয়ারে রূপান্তরের ধারণাটিও তার কাছ থেকে নেয়া।

পুঁজিবাজারে নতুন এ ধারণার ফলে সালমান বেঙ্টেঙ্রে ৬শ ৩৫ কোটি টাকার ঋণ শেয়ারে রূপান্তর করেন। রাইট শেয়ারের জটিলতা এড়িয়ে স্বল্পতম সময়ে প্রেফারেন্স শেয়ার অনুমোদনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের নতুন পদ্ধতির পরামর্শ সাহাবুব আলম দিয়েছেন। এছাড়া কোম্পানির সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন ও বানানো ইপিএস দেখিয়ে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দরবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বিভিন্ন কোম্পানিকে পরামর্শ দিয়েছেন। এর প্রতিটি বিষয়ে তিনি এসইসির সহযোগিতা নিয়েছেন। এসব অভিযোগ বিষয়ে সাহাবুব আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয় আমার জানা নেই।

গত বছর এসইসি জেনারেশন নেঙ্ট কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়ার পর আবার তা বাতিল করে দেয়। এরপর সাহাবুব আলম ওই কোম্পানির উদ্যোক্তাদের কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, আইপিও'র চাইতে বেশি লাভজনকভাবে তিনি এ কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেবেন। তাই আইপিও বাতিল হওয়ার পর ওই কোম্পানির মূলধণ বৃদ্ধির অনুমোদন করিয়ে নেন এসইসির কাছ থেকে। এরপর মূলধন বৃদ্ধির অংশ প্লেসমেন্টের মাধ্যমে সালমান এফ রহমান, লুৎফর রহমান বাদলসহ কয়েকজন শীর্ষ কারসাজিকারকদের কাছে বিক্রি করেন। এছাড়া সাহাবুব আলমের পরামর্শে জিএমজি এয়ারলাইন্স, এসটিএস হোল্ডিংস (এপেলো হাসপাতাল), ওরিয়ন ফার্মাসহ বেশ কিছু কোম্পানির তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় মূলধন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্লেসমেন্ট ব্যবসা করেছে বলে জানা গেছে।

এসইসির অনুমোদন ছাড়াই বেআইনীভাবে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। একেএম সাহাবুব আলমের স্বাক্ষরযুক্ত ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর লেখা অফার লেটার থেকে জানা যায়, কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে স্টক এঙ্চেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্ত করে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে প্রস্তাব দেন। সাহাবুব আলম এ কাজের জন্য ফি বা কমিশন ধার্য করেন কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকা অথবা শেয়ার বিক্রির থেকে অর্জিত আয়ের তিন শতাংশ। এছাড়া চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রথম দিনের ফি ১০ লাখ টাকা এবং কাজ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসের অগ্রিম ফি পাঁচ লাখ টাকা নেয়ার প্রস্তাব করেন। এসব কাজের অর্থ মাসের শুরুতে অগ্রিম প্রদান করতে হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাহাবুব আলম অফার লেটারটি তার নয় বলে দাবি করেছেন। তিনি শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, এ ধরণের অফার লেটারের কথা আমার জানা নেই। আপনাদের হাতে যেটা রয়েছে সেটা মিথ্যা অফার লেটার। জানি না কোথা থেকে কে এই লেটার তৈরি করেছে। এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে স্বাক্ষর নকল করে এ ধরণের কাগজপত্র তৈরি করা যায় বলে তিনি শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন।

তবে এই অফার লেটারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি কোনো কিছু বলতে অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার কারসাজির তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, আমরা নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে সাহাবুব আলমের স্বাক্ষরযুক্ত অফার লেটারটি পেয়েছি। তবে ওই অফার লেটারটি কোন কোন কোম্পানিকে সাহাবুব আলম দিয়েছেন, সময় স্বল্পতার কারণে তা জানা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি। ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এর মাধ্যমে সাহাবুব আলম আইনের লঙ্ঘন করেছেন কি-না তা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও তিনি যে অনৈতিক কাজ করেছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে আরো অধিকতর তদন্ত করা প্রয়োজন।

খালিদ বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর মনে হওয়ায় আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেনো বেসরকারি কোম্পানিতে পরামর্শকের কাজ করতে না পারেন। কারণ এসইসির সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ার সুবাধে এসব ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে অনৈতিক কাজ করতে পারেন। এ বিষয়ে এসইসির সদস্য (আইন) মো. আনিসুজ্জামান বলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুতর ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরণের কাজ এসইসির আইনের লঙ্ক্ষন। তবে এ ধরনের অভিযোগ আমরা এখনো পাইনি।

অভিযোগ পেলে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কি-না জানতে চাইলে মো. আনিসুজ্জামান বলেন, এসইসির বিভিন্ন নির্দেশনায় এ ধরণের অপরাধের শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। সেসব নির্দেশনা দেখে শাস্তির বিষয়টি বলা যাবে। সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯তে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে বলে তিনি জানান। Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.