আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান। মানুষের জীবনে কিছু আচমকা বাঁক আসে। এই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে তাকে কিছুটা হলেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। এটা নিয়তি নয়, অবধারিত।
বাঁকের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থমকে তাকাতে হয়; একদিকে অনিশ্চয়তা আর নতুনের হাতছানি, অন্যপাশে ফেলে আসা স্থবির সময়। এটা এমন একটা মুহূর্ত যে, ঠিক এই সময়টাতেই, হিসেবের খেরো খাতায় জমা-খরচ দুই উপাত্তের নিচে ‘০’ লিখে ব্যালেন্স করতে হয়। পেছনের সময় গুলো হয় এ্যালবাম। সামনের সময়গুলো পারদস্তম্ভের মত উঁচুনিচু। খেরোখাতা বগলে নিয়ে পা-বাড়াতে হয়।
কেউ পা-বাড়ায় এ্যালবামের পথে, কেউবা ভবিতব্যের দিকে। আবার শূন্য থেকে শুরু...।
সেই ছেলেবেলায় যখন শ্লেট ছেড়ে কলম ধরলাম, মনে আছে বাবা একটা রেডলিফ কলম হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে’। নতুন কলমের আনন্দে কিছু না বুঝেই সেদিন মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছিলাম-‘আচ্ছা’। না বুঝে মিথ্যে বলেছিলাম সেদিন বাবাকে।
আমার কোনদিন ডাক্তার হতে ইচ্ছে করেনি। আমার তখন থেকেই কবিতা ভালো লাগতো। আর গান। রাত বিরেতে বেরিয়ে পড়তাম বনে বাদারে। আমি শুনতাম রাতের গান-উদারাসপ্তক থেকে মন্দ্রসপ্তক! সবাই বললো-ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে।
আমি মহানন্দে উচ্ছন্নে যেতাম।
এস.এস.সি তে যখন গণিত আর উচ্চতর গণিতে ৯৭ পেলাম, ‘মা’ ভাবলেন ছেলে নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমাকে ভর্তি করা হলো দেশের সর্বোৎকৃষ্ট কলেজে। মফস্বলের জীবন ছেড়ে শহরের উচ্চতরো জীবনে পৌঁছে ইঞ্জিনিয়ার হবার রঙ্গিন ইচ্ছেটা জেঁকে বসলো মাথার উপরে। ক্লাস-ল্যাব এসব কিছুর চাপে পড়ে নিজেকে হারাতে শুরু করলাম।
পড়ার টেবিল জুড়ে শুধু নম্বর আর নম্বর। হাজার হাজার, কোটি কোটি। ঘুমের ঘোরেও চমকে উঠি। উঠতি বয়সের অচিন্তিত স্বপ্নে মেয়েদের স্তন দেখার বদলে আমি দেখি স্লাইড ক্যালিপার্স, স্ক্রু-গজ! আমিও কি যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি? আমার হাতের আঙ্গুলগুলো মনে হতো কাঁটা কম্পাসের মত। বিদ্রোহ করে উঠলো মন।
নিয়মিত স্কুল পালানো ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দু’চোখ থেকে মুছে সেই প্রথম কলেজ পালালো। সবাই বললো আহা! ছেলেটা! ভীমরতি!
দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যখন ভর্তি হলাম দেশের এক কোনে একটা ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে, সবাই হা হা করে উঠলো। আমি কাতর হয়ে বললাম, আমাকে একটু নিভৃত থাকতে দাও। কংক্রীটের বন আমার ভালো লাগেনা। আমার চাই সবুজ জীবন।
হাজার হাজার শিশ্নে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া উত্তপ্ত জীবনের চেয়ে শ্যামল আলিঙ্গনের জন্য কাতর ছিলাম ততোধিক! সবাই বললো ছেলেটা পাগল। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘আচ্ছা’।
এই আমি শেষ পর্যন্ত কিছুই হতে পারিনি। শেষ চারটি বছর হাতের কড় গুণে অপচয় করেছি। সুমনের গানের মতই ‘হারিয়ে যাওয়া মুখ’ হতে আর কত বাকী? স্মিত হাসির শেষে যে কুশল থাকে, তার আড়ালে থাকে ব্যস্ততা।
শেষ বাসটাও ছেড়ে যায় অফিসগামী তাড়া-কে ধাওয়া করে। আমি ফুটপাতে বসে এককাপ চা, তাতে ভেজানো টোস্ট। গায়ে লেগে থাকা পেট্রোলের গন্ধ আর ক্লান্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নতজানু হবার আগেই ‘বৃষ্টি কন্যা’ এসে আগলে ধরে আমাকে। ধ্বসে পড়া থেকে বাঁচায়। হাতে তুলে নেয় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকা আমার খেরো খাতাটাকে।
যোগবিয়োগ শেষে পাওয়া শূন্যটার পাশে একটা নিঃসঙ্গ তীর এঁকে দিয়ে বলে-‘আবার শুরু করো’। আমার কিছু না হতে পারা জীবনে একমাত্র সূচক মেয়েটা-যে আমার শূন্যটাকেও মুগ্ধ হয়ে দেখে। আমার বিগত অপচয়ী চারবছরের একমাত্র সঞ্চয়-যার জন্য শূন্য পকেটেও আমি অনেক কিলো হাঁটতে পারি। জানিনা, সামনের দিন গুলো কেমন যাবে, তবু ‘বৃষ্টিকন্যা’ অধ্যায়টা প্রতিদিনই রচিত হবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।
জীবনের বর্তমান এই অনিশ্চিত বাঁকে আমি যে ছায়াটার নিচে শূন্য খেরোখাতাটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সে-ই ‘বৃষ্টিকন্যা’।
আমার এক পাশে এ্যালবাম। অন্যপাশে-‘জানিনা’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।