আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার খেরো খাতা-১



মাঝেমাঝেই বস্তুবাদী আর ভাববাদী দর্শন আমাকে খুব অবিন্যস্ত প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে আমার বিন্যস্ত যাপিত জীবনকে নাড়া দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়ে যায়। যেখানে বাইরের আবরণকেই বাঁচাতে হিমশিম খায় তখন ভেতরের এই পুনঃ পুনঃ দর্শনের আস্ফালন অনেক সময়ই আমাকে আত্মিক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। যে অবস্থার পরিবর্তনের নূন্যতম যোগ্যতার ধারকও নিজেকে মনে হয়না তখন সেটা অন্তঃস্থ মনে বার বার আঘাত করার ফলে একধরণে মনোবিকার জন্মে যার ফলে ক্রোধ জাত প্রতিহিংসা জন্মে কিন্তু তাতে আমার মনের চপল দর্শন খুব বেশি সুস্থির থাকেনা। তবে এক সময় পরিত্রাণের উপায় হিসেবে এই চলমান বিশ্বসংসারের আর দশটা অভ্যাসমত মনের ওই দর্শন এর মুখে সৈন্ধব লবণ লাগিয়ে দিই, আর তাতে আমার মন মরে কিনা জানিনা তবে অনর্থক কিছু আনাড়ী প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছেনা বলে আত্মপ্রসাদে ভুগতে থাকি , যদিওবা এতে আমার অস্তিত্ত্ব কতটুকু মানব আর কতটুকু যান্ত্রিক তা নির্ণয় করা মাঝে মাঝে আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এবার আসি একটু তত্ত্বে, নিষ্কাম কর্ম ,সকাম কর্ম গুলোর বিষয়ে প্রথম জানি ক্লাস সিক্সে যদিও তা ছিল শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের নিমিত্তে পড়া ।

এরপর কিছু ভাসা ভাসা ধারণা, নিজের স্বল্প জ্ঞানে অর্জিত কমিউনিজম, আশপাশেরর পূঁজিবাদ, প্রশ্নবিদ্ধ ধর্মচারণ আমার ভিতরে একধরণের জগাখিচুরি ব্যাক্তিত্ব তৈরী করতে সক্ষম হয়। যা হয়ত যুক্তির বেড়াজালে ধরাশায়ী কিন্তু মনের আবেগে সর্বদা নিজেকে চারিদিকে জানান দিতে থাকে। সদ্যরোপণকৃ্ত রুগ্ন গাছের চারা যেমন বাতাসের গতি পরিবর্তনের সাথে নিজের শরীর পরিবর্তন করে ঠিক তেমনি আমার সেই ছোট্ট নড়বরে ব্যক্তিত্বের উপর ছড়ি ঘোরাতে থাকেন কখনও বঙ্কিম, কখনও নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, আবার কখনওবা সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,চার্লস ডিকেন্স। আমার নিজেকে খোঁজার শ্রান্তি যোগায় সত্যজিত রায় এবং অতি অবশ্যই আর্থার কোনান ডয়েল। তখন পুরো শহর আমি চষে বেড়ায় ফেলুদা এবং শার্লক হোমসের জন্য।

আবার কিছুদিন দর্শনের বাণপ্রস্থ গমন। কিছু মানুষ থাকে যারা সবসময় নিজেদেরকে একটু আলাদা করে রাখতে চায় এই আচারণ যতটুকু না তার ব্যক্তিত্ব থেকে আসে তার চেয়ে বেশি আসে নিজের অহংকে বাঁচিয়ে রাখতে। তবে এটা যে খারাপ না ভাল সে আলোচনা এখানে নিরর্থক। তবে এটা মানুষকে অন্যকিছু বিষয় নিয়ে ভাবার অন্তঃপ্রেরণা যোগায়। আমার হাতুড়ে জ্ঞান চর্চার হাতেখড়ি সেখান থেকেই।

অতি বস্তুবাদের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল আমার আমার আপাত রোমান্টিক ভাববাদিতার আঁতুর ঘর। যখন আমি গীতা, বাইবেলে কখনও কখনও কোরান শরীফ নিয়ে মহা ব্যস্ত এবং ভাবছি ভাববাদীতার সমস্ত গুনাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান তখন কাল মার্কস আমাকে গভীর ভাবে ভাবিত করে যায় আমার তরুণ মণ সমাজ তান্ত্রিক নামক এক মোহের দিকে ছুটতে শুরু করে। আমি ভাববাদীর ভালবাসা আর বস্তুবাদীর যুক্তি দুইজন কেই গভীর ভাবে ভালবেসে ফেলি। এর ভেতরে আরও এক জনের প্রবেশ আমাকে রীতিমত বিভ্রান্ত করে ফেলে, আর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন হেগেল। হেগেল মুলত ছিলেন ভাববাদী কিন্তু তিনি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মূল বিষয় হল তত্ব যেটাকে আমরা বলি Thesis এবং প্রতিতত্ব (Antithesis ) এর দ্বন্দ্ব এবং এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি Synthesis এ পৌঁছা।

এইখানে এসে আমার মনে হল এই সব ভারী ভারী দর্শন যদি সাধারণ মানুষের জীবনে প্রয়োগ করা না যায় তবে তার মুল্য কোথায় ? তবে হেগেল আমাকে আকর্ষণ করে তার এই তত্ত্বটিতে যেটাতে তিনি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। হেগেলর দর্শন শেষপর্যন্ত যা দাঁড়ায় তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘Absolute Idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। কিন্তু হেগেলের এই মতবাদকে বিরোধিতা করে মার্ক্স বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই।

মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তিনি বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

এই সময়ে আমার ভেতরে একধরণের উন্নাসিকতা তৈরী হয় যার ফলে আমি নিজেও কষ্ট পেতে থাকি এবং আমার প্রিয়জনদের ঠুনকো স্বার্থের কাড়াকাড়ি দেখে লজ্জিত হতে থাকি এবং এধরণের দর্শন ভাবনা এবং জ্ঞান নামক প্লাটিনামের হরিণের পেছনে শুধু শুধু সময় নষ্ঠ বলেই মনে হতে থাকে এবং আমার পরিবারের অনেক সদস্যই তখন আমার সাময়িক ব্যর্থতার দায়ভারটুকু আমার অতি আদরের বই গুলোর উপরে চাপাতে ব্যস্ত থাকে শুধু আমার বাবা, মা এবং ভাই ছাড়া। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।