ক্ষমতাসীনদের প্রার্থীরা ছিলেন অতি আত্মবিশ্বাসী। সর্বশেষ নির্বাচনে তো বলেই ফেলা হলো, গোপালগঞ্জের পর দেশে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শক্ত ঘাঁটি হলো গাজীপুর। অন্যদিকে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা ছিলেন সংশয়াকুল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের অস্থির চিত্ত, নানা চক্রান্তের অভিযোগ আর মানি না মানব না গোছের আচরণই এর প্রমাণ। ফল প্রকাশের পর কিন্তু উভয় পক্ষের অনুমানই মিথ্যা হয়ে গেল।
অতি আত্মবিশ্বাসীদের প্রত্যাশা যেমন পূরণ হলো না, তেমনি সন্দেহবাদী বিরোধী দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও ঘটল অপ্রত্যাশিত বিজয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনচিত্র ছিল এ রকমই।
এই চিত্র থেকে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে সরকার এবং সরকারবিরোধী কোনো পক্ষই অধিকাংশ ভোটার বা জনগণের মনের কথা পড়তে পারেনি। অর্থাৎ উভয় পক্ষই প্রকৃতপক্ষে জনবিচ্ছিন্ন।
সাম্প্রতিক এই নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যু নয়, জাতীয় ইস্যু ভোটারদের কাছে বেশি বিবেচিত হয়েছে, এ কথা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন।
সুতরাং ভোটাররা জাতীয় রাজনীতির বিবেচনায় ক্ষমতাসীনদের পছন্দ করেননি বলেই বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। অন্য কথায় ভোটাররা বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে পছন্দ করে ভোট দেননি, দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থীকে অপছন্দের কারণে। অর্থাৎ যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তাঁরা প্রধানত ভোটারদের নেতিবাচক ভোট পেয়েছেন।
বেশির ভাগ ভোটারের পছন্দের তালিকায় সরকারপক্ষ যেমন নেই, বিরোধীপক্ষও নেই। আবার আস্থা রাখা যায় এমন তৃতীয়পক্ষও ভোটাররা পাচ্ছেন না।
ফলে অসহায়ের মতো তাঁরা একবার এদিকে ঝুঁকছেন আর একবার ঝুঁকছেন ওদিকে। কেবল স্থানীয় নির্বাচন নয়, বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা এমনই লক্ষ করা গেছে। ক্ষমতাসীনদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকে বলে ক্ষোভটা তাঁদের ওপরই বেশি গিয়ে পড়ে। অতীতের বঞ্চনা যে আরও বেশি ছিল, অতীত অভিজ্ঞতা যে অনেক তিক্ত ছিল, এ কথা বর্তমানের ক্ষোভের মধ্যে চাপা পড়ে যায় বলেই মানুষ এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর এর ফলে ক্ষমতাসীনেরা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেন না; সরকারবিরোধীরাই আবার আসেন ক্ষমতায়।
আর ক্ষমতায় আসার পরপরই যখন আবার তাঁরা আগের ক্ষমতাসীনদের মতোই আচরণ করতে থাকেন, তখন জনগণেরও মোহভঙ্গ ঘটে এবং পালাবদল ঘটে তাদের ক্ষোভের। গত শতকের নব্বইয়ের পর থেকে প্রধানত জনগণের ক্ষোভের এই বহিঃপ্রকাশই দেশের বড় দুই দলের ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়েছে। এই দুই দলের মধ্যে আদর্শিক দূরত্ব থাকলেও ক্ষমতাচারের মধ্যে দূরত্ব নেই। ক্ষমতায় গেলে উভয় দল প্রায় একই আচরণ করে। আবার অদ্ভুতভাবে ক্ষমতার বাইরেও উভয় দলের আচরণ প্রায় একই।
ফলে ভোটার বা জনগণ সহজেই তাদের ক্ষোভকে এক দলের থেকে অন্য দলের দিকে চালাচালি করতে থাকে।
আসলে বেশির ভাগ মানুষ বারবার নেতিবাচক ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কালো পতাকা দেখালেও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না, বরং মিথ্যাচার, প্রতারণা, অসলগ্ন ও অসহিষ্ণু কথাবার্তা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দেওয়া ইত্যাদি অতি ভয়ংকর উপাদানের মাত্রা রাজনীতিতে আরও বেড়ে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো যখন দেউলিয়া এবং বেশি বেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখনই এসব ক্ষতিকর উপাদান রাজনীতিতে মিশেল দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। (অবশ্য এসব উপাদানের প্রভাব বেশি দিন টেকসই হয় না। আদর্শ স্থাপন না করে যাঁরা রাজনীতিতে এসব উপাদানের মিশেল দেন, তাঁদের জন্য তা বুমেরাংও হতে পারে।
) জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি দল ও দেশের জন্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
দেশে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় বলা হয়ে থাকে, কোনো দলের ক্ষমতায় বসার প্রথম ঘণ্টা থেকেই শুরু হয় তাদের জনবিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ ওই সময় থেকেই জনগণ ক্ষমতাসীনদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন। নেতিবাচক মনোভাবের সূচনা কিন্তু হয় ক্ষমতাসীনদের নিজ দলের অভ্যন্তর থেকেই। এ দেশে বড় দলগুলোতে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন, মন্ত্রিসভার সদস্য বাছাইসহ ক্ষমতাসীন অবস্থায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে পদায়নের ক্ষেত্রে দলের কর্মীদের বা স্থানীয়দের মতামত উপেক্ষিত থাকে।
যাঁরা এগুলো পাওয়ার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে ঘুরঘুর করেন, শিকে ছেঁড়ে তাঁদের ভাগ্যেই। বেশির ভাগ যোগ্য ও ত্যাগী কর্মী শীর্ষ নেতৃত্বের মোসাহেবি করা পছন্দ করেন না। ফলে তাঁরা অনেকেই ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান। এদিকে পদ লাভকারী মোসাহেবদের বেশির ভাগই নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য ত্যাগীদের এড়িয়ে চলতে থাকেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বিবেচনায় নিজের ক্ষমতাকে তাঁদের প্রভাব খর্ব করার কাজে ব্যবহারও করেন।
অন্যদিকে পদবঞ্চিতদের এক অংশ এবং অপেক্ষাকৃত ভালো অংশ অনেকটা অভিমানে দূরে সরে গেলেও অন্য অংশ কিন্তু শুরু থেকেই প্রকাশ্যে পদপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার কাজে তৎপর হয়।
এভাবে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, যা অতি দ্রুত সাধারণ মানুষ বা ভোটারদের মধ্যে দল ও দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
অযোগ্য ব্যক্তিরা শীর্ষ নেতৃত্বকে তেল মেরে যখন নিজের সুবিধা আদায় করে নেন, তখন তাঁদের শ্রম ও মেধা তৈলমর্দন কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকে, সাধারণের সেবায় তাঁরা আর নজর দিতে পারেন না। আবার ‘তৈলমর্দন’ শব্দটির সঙ্গে অসততা ও দুর্নীতির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এর একটা ছাড়া আর একটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তাই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ক্ষমতাসীন পদবিধারীরা তাঁর পুরো সময়টায় তৈলমর্দনের পাশাপাশি দুর্নীতিরও চর্চা করেন।
আর ভেতরের এই গলদ বা দুর্বলতার কারণে এ ক্ষেত্রে তাঁদের আচরণেও পরিবর্তন ঘটে। অহেতুক বাগাড়ম্বর, মিথ্যাচার এবং সাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার তাঁদের চরিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে এঁদের সঙ্গে আবার আর এক স্তরের মোসাহেব জুটে যায়। এই মোসাহেবরা ক্ষমতাবান্ধব। দল ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বা বিপদাপন্ন হলে এদের টিকিটিও দেখা যাবে না।
এরা নিজ দলেরও হতে পারে, অন্য দল এমনকি বিরোধী দলের সমর্থকও হতে পারে, আবার হতে পারে আমলা। যখন যারাই ক্ষমতায় থাক না কেন, এদের অবস্থানের নড়নচড়ন কমই হয়। ধীরে ধীরে এই মোসাহেবদের কর্মদক্ষতা এখন প্রায় পেশাদারির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। নেতার জনসংযোগের যে তলানিটুকু শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে, তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার কাজে এরা বেশ ওস্তাদ। যেসব দুর্বলতার কারণে নেতার চারপাশে এই ওস্তাদদের ঠাঁই মেলে, সেসব দুর্বলতা আজকের দিনে ঢেকে রাখা যে আর সম্ভব নয়, তা দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব উপলব্ধি করেন কি না বোঝা মুশকিল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে নেতিবাচক ভোটই ফলাফল নির্ধারণ করেছে, এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা একমত। অতীতের কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনেও এই নেতিবাচক ভোটের প্রভাব ছিল। নেতিবাচক ভোট প্রধানত দলীয় ব্যর্থতার প্রতিই ইঙ্গিত করে। ভোটের ফলাফলের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য উপাদানকে অস্বীকার না করেও বলা যায় মূলত নেতিবাচক ভোটই ১৪ দল-সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় এবং ১৮ দল-সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ের পেছনে কাজ করেছে। নেতিবাচক ভোটের অর্থ হলো প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি ভোটারদের অনাস্থা।
কোনো দলের কর্মকাণ্ডই ভোটাররা পছন্দ করছেন না। তাই আগাম বলেই দেওয়া যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়ায় আজ যেমন এর শিকার হয়েছে ১৪ দলের প্রার্থী, ভবিষ্যতে তেমনই এর শিকার হবেন ১৮-দলীয় প্রার্থী। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটাই প্রযোজ্য হবে।
দেখা যাচ্ছে, নেতিবাচক ভোট বা দলের জনবিচ্ছিন্নতার সূচনাটা ঘটছে দলের ভেতর থেকে। সুতরাং বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরে একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন।
দেশে গণতন্ত্রচর্চার পক্ষে বড় দলগুলোর নেতারা খুবই সোচ্চার। কিন্তু দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যে কোনোই চর্চা নেই, সেদিকে তাঁরা ইচ্ছে করেই খেয়াল করছেন না। অথচ দলের অভ্যন্তরে তৃণমূল পর্যায় থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নেতৃত্ব বাছাইয়ে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব হতো। দলে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে, সবার মতামতের প্রতিফলন থাকলে নেতা ও অনুসারী উভয়ের মধ্যেই দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি তৈরি হয়, যা জনবিচ্ছিন্নতা, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করতে পারে, দূরে ঠেলে দিতে পারে স্তাবক সংস্কৃতিকে। শুধু তা-ই নয়, গণতন্ত্রচর্চার শক্তি নিয়ে দল রাজনীতিতে বাইরের ক্ষতিকর উপাদানের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।
সুতরাং আজকের জনবিচ্ছিন্নতা ও ভোটারদের দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতাকে রুখতে হলে দলে গণতন্ত্রচর্চার কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এখন দেখার বিষয়, ক্ষমতাসীন দল নেতিবাচক ভোটের কাছে আত্মসমর্পণ করবে কি না অথবা বিরোধী দল নেতিবাচক ভোটের ওপর নির্ভর করেই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবে কি না। কী করবে তারা? এই গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবর্তে ঘুরপাক খাবে, নাকি ঘুরে দাঁড়াবে?
মলয় ভৌমিক: নাট্যকার, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।