ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। হলে হলে নির্যাতন সেল, ক্যাম্পাসের আশপাশের দোকানে চাঁদাবাজি, হলে ছাত্র ওঠানো, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার মতো নেতিবাচক কাজের অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ছাত্রলীগের এসব কাজে হয় চুপ করে থাকে, না-হয় সমর্থন জুগিয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহীদুর রহমানের বিরুদ্ধে। তিনি ‘কার্যত ছাত্রলীগের লেজুড়বৃত্তি’ করেন বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চললেও কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে তাঁদেরই সহকর্মী ও সংগঠনের নেতা খুনের ঘটনায় সব নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন ছাত্র-শিক্ষকেরা। তাঁরা ছাত্রলীগের সব নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের দাবি, প্রতিটি হলে গড়ে তোলা ছাত্রলীগের টর্চার সেল বন্ধ করতে হবে। অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যাঁরা এদের প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদেরও পদ ছেড়ে দিতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মুর্শেদুজ্জামান ওরফে বাবুর ভাতিজা সাদিকুর রহমান ওরফে স্বপন, শহীদ শামসুল হক হলের নেতা ওয়াহাব ওরফে রিন্টু, আশরাফুল হক হলের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক সদস্য রোকনুজ্জামানের নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। তাদেরকে পেছন থেকে সমর্থন দেন সভাপতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু হাদী নূর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের টর্চার সেল রয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে। তারা এসব থেকে মুক্তি চায়।
বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। হলগুলোতে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে এখন থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। ’
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগের চিহ্নিত কয়েকজন নেতা-কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলাফেরা করেন। তাঁদের অভিযোগ, কোনো সাধারণ ছাত্রকে ছাত্রলীগ যখন মারধর করে, তখন প্রক্টরকে তা জানালে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেন না, বরং ছাত্রলীগের পক্ষ নেন।
শিক্ষার্থীরা তাই প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
জানতে চাইলে প্রক্টর শহীদুর রহমান খান অভিযোগগুলো অস্বীকার করে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, হল প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়া আমরা কোনো হলে যেতে পারি না। ’
হলগুলোর টর্চার সেলের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ‘কোনো হল প্রশাসন আমাকে বিষয়টি জানায়নি। ’ সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।
লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। ’
কেন লিখিত অভিযোগ করা হয় না—অভিযোগকারী কয়েকজনকে এই প্রশ্ন করলে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রক্টরকে মৌখিকভাবে কোনো অভিযোগ করলে তিনি তা ওই ছাত্রলীগ নেতাকে বলে দেন যে ওমুক তোমার বিরুদ্ধে বলেছে। এরপর ওই ছাত্রকে ছাত্রলীগের হাতে পিটুনি খেতে হয়। তাই ভয়ে কেউ কোনো অভিযোগ দেয় না। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সায়াদের মৃত্যু মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
এ ঘটনা আমাদের মধ্যে অনেক বোধোদয় ঘটিয়েছে। আসলে ক্যাম্পাসের হলগুলোর টর্চার সেল কিংবা আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে আগে আমাদের জানা ছিল না। আমরা এখন নিরাপত্তা কমিটিসহ সবার সঙ্গে বসছি। সবার সহযোগিতায় আমরা ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঠিক করতে চাই। আর কোনো ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
’
শিক্ষার্থীদের সব অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগের সভাপতি মুর্শেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সায়াদ হত্যার বিচার আমরাও চাই। কারণ, তিনি আমাদেরই সংগঠনের কর্মী। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পাসের ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অনেক শিক্ষকও। সবাই মিলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
আর তাই ভিত্তিহীন সব অভিযোগ করা হচ্ছে। ’
হলগুলো নির্যাতন সেল?: আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত বছরের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে রাব্বি নামে ১০ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল ও কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। মে মাসে মুর্শেদুজ্জামানকে সভাপতি ও সাইফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এ কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যায়।
গত এক বছরে প্রতিপক্ষের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের অর্ধশত নেতা-কর্মী তাদের হামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আশরাফুল হক হল, শামসুল হক হল ও নাজমুল আহসান হলে প্রায়ই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রতিরাতেই হলের অতিথিকক্ষে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বৈঠকে বসেন। সেখান থেকে সাধারণ ছাত্রসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় এবং অতিথিকক্ষেই তা বাস্তবায়ন করা হয়।
গত বছরের ২৯ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত তিন দিন আশরাফুল হক হলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় ভেটেরিনারি অনুষদের ছাত্র জাহিদুল ইসলামকে।
এ বছরের ১২ জানুয়ারি শামসুল হক হলে কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের প্রথম বর্ষের ছাত্র জায়েদ মোহামঞ্চদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী শেষমোড় এলাকা থেকে তুলে অতিথিকক্ষে নিয়ে পেটানো হয়। গত ৫ মার্চ নাজমুল আহসান হলে আশেকুজ্জামান ও মাহবুব নামে ছাত্রদলের দুই কর্মীকে লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়।
শুধু হলে নয়, ক্যাম্পাসেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ২৮ আগস্ট ক্যাম্পাসের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে ক্লাস করতে এলে ছাত্রদলের কর্মী নাজমুল হাসানকে পেটায় ছাত্রলীগ। সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ ক্যাম্পাসের কামাল-রঞ্জিত মার্কেটের সামনে কৃষি অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র রাশেদুল ইসলাম ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে আসওয়াদ হোসেনকে পেটানো হয়।
গত সোমবার সন্ধ্যায় আশরাফুল হক হলের ২০৫ কক্ষে সায়াদ বিন মোমতাজকে ডেকে নেন সুজয় কুমার কুণ্ডু ও রোকনুজ্জামান। এ সময় সেখানে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা স্বপন, রেজা, রোকনুজ্জামান, জাহিদ হাসান, রামচন্দ্র ও রাসেল। তাঁরা সবাই মিলে সায়াদকে রড, লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পেটান। পরদিন সকালে হাসপাতালে মারা যান সায়াদ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতিও এই হলেরই ছাত্র।
হলে ছাত্র ওঠানো: প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের মাধ্যমে তাঁদের হলে উঠতে হয়েছে। আশরাফুল হক হলে ছাত্র ওঠানো এবং নির্যাতনের কাজটি করছেন ছাত্রলীগের সভাপতির ভাতিজা সাদিকুর রহমান ওরফে স্বপন, রাব্বী হত্যা মামলার আসামি রোকনুজ্জামান, সায়াদ হত্যায় অভিযুক্ত সুজয় কুমার কুণ্ডু, রেজা, হূদয়, দেবাশীষ ও রামচন্দ্র।
শহীদ শামসুল হক হলে ছাত্র ওঠানোর দায়িত্ব ওয়াহাব রিন্টু, অনিক, সজীব, রিপন, জনি, পাশা। শহীদ নাজমুল আহসান হলের দায়িত্বে আছেন শাহীন, নাজমুল, নাঈম, এনাম, লিমন, রিফাত, শাহীন ও আসিফ। শহীদ জামাল হোসেন হলের দায়িত্বে আছেন প্রিন্স, জয়, রনি।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাশের হলের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের দায়িত্বে রয়েছে তানভীর, কুশল, আকিফ। ফজলুল হক হলে দায়িত্বে আছেন পরাগ, সোহেল, প্রদীপ কুমার, রাহুল, দ্বীপ, সুজন, দুর্জয়।
তবে ছাত্রলীগের যতজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষ ও চারজন করে হাউস টিউটর থাকলেও ছাত্রলীগই সব নিয়ন্ত্রণ করে।
হলগুলোতে ছাত্র তোলার বিষয়টি কেন ছাত্রলীগ করছে জানতে চাইলে হল প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক আবদুল মোমেন মিয়া গতকাল অসহায় কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণেই হল প্রভোস্টদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
সামনে যেন এমন না হয়, দেখা যাক সেটা করা যায় কি না।
উত্ত্যক্তে আতঙ্কিত ছাত্রীরা: ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। তিনটি ছাত্রীহলের অন্তত ১০ জন ছাত্রী জানিয়েছেন, প্রতি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রীহলের সামনে মহড়া দেন। তাঁরা নানা অশ্লীল কথাবার্তা বলেন এবং অঙ্গভঙ্গি করেন।
গত ১২ মার্চ ছাত্রীরা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সামনে নিরাপত্তা দাবি করে মানববন্ধন করেন।
সায়াদ হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশেও গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতাদের সামনে ছাত্রীরা আবার এসব অভিযোগ করে নিরাপত্তা দাবি করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রীতম সাহা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রী উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের ছেলেরা তাঁকেও পিটিয়ে পার্শ্ববর্তী নালায় ফেলে দেন। তিনি এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানালেও কোনো বিচার পাননি।
চাঁদাবাজি, ফাউ খাওয়া: ক্যাম্পাসের আশপাশে অর্ধশত দোকান রয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসব দোকান থেকে চাঁদা ওঠান বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া হলের ক্যানটিন এবং ক্যাম্পাসের পাশের খাবার দোকানগুলোতে ফাউ খাওয়ার অভিযোগ আছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
ক্যাম্পাসের পাশের একটি হোটেলের মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে লাখ খানেক টাকা বাকি পড়েছে তাঁর। এঁদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলা মাত্রই আমাকে মেরে ফেলবে। ’
ছাত্রলীগের সভাপতি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এগুলো সবই মিথ্যা অপবাদ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।