অকর্মা, ভীতু, কাপুরুষ ২২
আজ রাতের কোচে ঢাকা যাচ্ছে বাবু ও তার বাবা। আগামী পরশুদিন রাতে ফ্লাইট। বাবুদের ধানি জমি পুরটাই বিক্রি করে ফেলেছে তার বাবা। ছেলের দুরাবস্থার কথা ভেবে নিজেদের শেষ সহয় সম্বলটুকু কোরবানি করতে পিছু পা হননি তিনি।
এ জমির ধান দিয়ে তাদের সারা বছর চলে যেত।
খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে জমির সঠিক দাম না পেলেও কোন রকমে চালিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভিসার জন্য একটু সময় লেগেছে তারপরও সবকিছু ভাল ভাবে ম্যানেজ করতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট।
আর ঘন্ঠা খানেকের মধ্যে বাবুরা রওনা হবে। সব বন্ধুরা তাকে বিদায় দিতে এসেছে। বিভিন্ন ভাবে তারা তাকে শান্তনা ও উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে, বাবু নিলুর সাথে একবার দেখা করে গেলে হতনা ?
কামাল , ওর সাথে দেখা হলে আমি আরো র্দুবল হয়ে যেতাম তাছাড়া কি লাভ সপ্ন বাড়িয়ে ? কেন যেন মনে হচ্ছে আর বুঝি বাঁচবনা।
এ সব বাজে চিন্তা ছাড়ত, তোর কিছু হয়ে গেলে নিলুর কি হবে ? ওর জন্য হলেও তোকে বাঁচতে হবে বলল মিতুল।
২৩
বাবুর চিঠি পাবার পর থেকে বদলে যেতে শুরু করেছে নিলু। কারও সাথে কথা বলেনা, খাওয় দাওয়া এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছে। রাতে একদম ঘুম হয়না, তার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছেনা , বাবু তার সাথে চালাকি করেছে। বাবুর মতো একজন ছেলে কাওকে ধোকা দিতে পারে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
বাসার সবাই তাকে নিয়ে ভিষণ চিন্তিত। মার জেরায় তাকে সবকিছু বলতে বাধ্য হয়েছে সে। ইমতিয়াজ সাহেব প্রথমে খুব রেগে গেলেও পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন বাবুর অসুস্থতার খবর। বুঝতে বাকী থাকেনা তার ছলনার কারন।
নিলুর মা খাবার নিয়ে ঘরে এলেন।
নিলু বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। ভেবে এসেছিলেন মেয়েকে আচ্ছা মত বকা দিবেন , কিন্তু মেয়ের এ অবস্থা দেখে বকা দেবেন কিভাবে ?
খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে মা, নিলু কোন কথা বলল না.
উঠ না খাবি।
তোমরা খাও গে মা, আমি পরে খেয়ে নেব।
এরকম করলে কিভাবে হবে ? চল
নিলু যে ভাবে শুয়ে ছিল ও ভাবেই শুয়ে থাকল। সেদিনের পর সে একবারই বাইরে গিয়েছে তাও নিপা রুপার কাছে।
তারা বলেছে, কিছু জানেনা এ ব্যাপারে। মিথ্যেটা বলতে তাদের খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু না বলেও উপায় ছিল না, বাবু তাদের ওয়াদা করিয়েছে। নিপা শুধু বলেছিল শরীরের যত্ন নিস। কিন্তু নিজের দিকে কোন খেয়াল নেয় নিলুর। এ কদিনে শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে।
তার সেদিকে কোন খেয়াল নেয়। শুধু একটাই চিন্তা বারবার, বাবু তাকে ধোকা দিতে পারেনা !
২৪
রাত প্রায় একটা। এত আরামদায়ক আসনে বসেও বাবু চোখ বন্ধ করতে পারছেনা। জানালা দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাতাস আসছে। চাঁদের হালকা আলোয় বাসের মধ্যে কেমন যেন একটা গুমট ভাব তৈরি করেছে।
বাবু ভাবছে নিলুর কথা। নিলু কে মিথ্যা বলাটা মনে হয় তার উচিত হয়নি। মিথ্যা কখনও চাপা থাকেনা। যদি কোনদিন সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে তখন কিভাবে নিলুর সামনে দাড়াবে, নিলু যদি তখন ধোকাবাজ বলে ফিরিয়ে দেয়। হঠাৎ গাড়ির তীব্র ব্রেকে সম্বিত ফিরে আসে বাবুর।
সেই সাথে ড্রায়ভারের চিৎকার,
দামি কিছু থাকলে লুকিয়ে ফেলেন, আমরা ডাকাতের কবলে পড়েছি।
বাবুদের বাসটির সামনে একটি ট্রাক বেরিকেড দেয়া।
ট্রাক থেকে জনা দশেক লোক লাফ দিয়ে নেমে বাসে উঠল। প্রত্যেকের মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা। সবার হাতে চায়নিজ কুড়াল ও চাপাতি , একজনের হাতে পিস্তল।
পিস্তল ধারি ডাকাত বলল, কেও গোলমাল কইরেন না, গোলমাল করলে জানে মাইরা ফেলাব।
সে অন্য ডাকাতদের চোখের ইশারা করতেই তারা যাত্রীদের কাছ থেকে মুল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়া শুরু করল। করিম সাহেব তার হ্যান্ডব্যাগ যেটাতে তাদের পাশপোর্ট প্লেনের টিকিট আছে তা পাছার নিচে লুকিয়ে ফেললেন। এক ডাকাত তাদের সিটের কাছে এসে পিতা পুত্র দুজনের হাত ঘড়ি ও নগদ টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিল। করিম সাহেব দুর্বল মনের মানুষ।
তাকে ঘামতে দেখে ডাকাতের মনে সন্দেহ হয়, এই দাড়া ,
বাবার সাথে এমন ব্যাবহার বাবু মানতে পারে না,
মুক সামলে কথা বলেন, বড়দের সাথে কথা বলা শেখেননি ?
খোকা ছোট পোলাগ মারা আমাগ মানা আছে। আমমরা ভাল ডাকাইততো, নাইলে তোমারে আমি.........কথাটি সে শেষ করল না,
এই মিয়া দাড়ান না,
করিম সাহেব কিছুতেই দাড়ান না। ডাকাত টা অন্য এক ডাকাত কে ডাকল। দুজনে মিলে করিম সাহেবকে টেনে দাড় করাল। ব্যাগটি চোখে পড়তেই ডাকাত দুজনের মুখে হাসি.
তরে কইলাম না মন্টু হালার লগে মাল আছে।
তোমাদের দোহাই লাগে বাবা এটা তোমরা নিও না।
চুপ কর ব্যাটা,
ওস্তাদ পাইছি, লন।
ব্যাগটি তারা পিস্তুল ধারীর দিকে চালিয়ে দিল। ততোক্ষনে করিম সাহেব পৌছে গেছেন ডাকাত সর্দার এর কাছে।
বাবা এ ব্যাগ তোমরা নিও না।
ক্যান এর মইধ্যে কি সব সম্পত্তি? এই চল নাম সবাই।
করিম সাহেব কেঁদে উঠলেন। তোমাদের দুই পায়ে ধরি ওটা নিও না, ওই ব্যাগে আমার ছেলের জীবন আছে। ওই ব্যাগে আমার ছেলের অসুখের কাগজপত্র বিদেশে যাবার কাগজপত্র আছে, ওটি দিয়ে দাও বাবা। ততোক্ষনে ডাকাত দল বাস থেকে নেমে পড়েছে।
করিম সাহেব বাসের মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন। বাবু দৌড়িয়ে এসে তার মাথা কোলে নিল।
বাবা আমি না হয় বিনা চিকিৎসাই মরলাম, তাতে দুঃখ নেয় কিন্তু দুঃখ একটাই আমার দেশের আইন শৃংখলার এত অবনতি আজ স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও আমরা বদলাতে পারলাম না। এখনও অন্যের হাতে জ্বিম্মি হয়েই থাকলাম।
করিম সাহেব কোন রকম নড়াচড়া করছেনা।
বাবু বুঝল তার বাবা জ্ঞান হারিয়েছে। বাবার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে সেও কান্নায় ভেংগে পড়ল। বাসের অন্য যাত্রিরা নিশ্চুপ। নিজেদের টাকা পয়শা হারিয়ে তারা যতটা না ব্যাথিত হয়েছে তার চেয়ে বেশী মর্মহত হয়েছে বাবু ও তার বাবার অবস্থা দেখে। তাদের শান্তনা দেবার কথাও কারও মনে নেয়।
২৫
প্রায় দুই মাস পরের কথা। বাবু মৃত্যু শয্যায়। প্রায়ই নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে, ডাক্তার বলেছেন রক্ত বদল করে হয়ত আরও কিছুদিন বাঁচান সম্ভব। কিন্তু তা করতেও বেশ খরচের প্রয়োজন। এমনিতেই দুই এক দিন পরপর রক্ত দেয়া লাগছে তাতেও টাকা কম লাগছেনা।
টাকা কোথায় থেকে জোগাড় করবেন এনিয়ে করিম সাহেব পড়েছেন সমস্যায়। বাবুর বন্ধুরা সব সময় তার পাশাপাশি থাকছে। বাবুর জন্য তারা সবাই শরীরের সবটুকু রক্ত দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
কিন্তু সমস্যা হল বাবুর রক্তের গ্রুফ রেয়ার। তাদের কারো সাথে মিলছে না।
বাবু এখন আমরা নিলু কে সব কিছু খুলে বলি।
না আক্তার, তাকে আর নতুন করে কষ্ট দিতে চায়না। কোন রকুমে টেনে টেনে বাবু উত্তর দিল।
ঘরে ঢুকলেন বাবুর মা। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তিনি কান্না চাপতে পারলেন না।
তার একমাত্র ছেলের আজ একি অবস্থা। বাবুর হাত ধরে তিনি বললেন, তুই আমাদের মাফ করে দিস বাবা।
তার গলা ধরে এল, আবারও ডুগরে কেঁদে উঠলেন। বাবু তার মার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দোষ তোমাদের না মা। তোমরা তোমাদের কর্তব্য করেছ।
সব দোষ আমার কপালের। তাই না মা ?
মা আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি ঘর থেকে ছুটে বের হলেন।
২৬
আরে করিম ভাই যে, কি মনে করে ? এমনি যে আসেন নি তাতো বুঝতে পারছি। তা বাবুর শরীরের এখন কি অবস্থা ?
নিলু দোতলার বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, বাবুর শরীর কেমন কথাটি কানে যেতেই থমকে দাড়াল।
বাবু ! কোন বাবু ? কি হয়েছে বাবুর ??? রেলিং এ হেলান দিয়ে সে কান পেতে শুনতে লাগল।
ইমতিয়াজ ভাই আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।
কি হয়েছে ভাই ? খুলে বলুন তো।
করিম সাহেব বাবুর অসুখ ও বিদেশ নিয়ে যাবার সময়ের ঘটনা টা খুলে বললেন।
খুবই দুঃখ জনক। আমরাতো এত কিছু জানতাম না।
তা এখন কেম.........
অদ্ভুদ একটা শব্দ শুনে ইমতিয়াজ সাহেব কথা থামিয়ে উপরে তাকালেন। ইমতিয়াজ ভাই মেয়েটা এমন করছে কেন? করিম সাহেব উদভ্রান্তের মতো উপরে তাকালেন
নিলু দুই হাতে কান চেপে চোখ বন্ধ করে দুলছে। শরীরের সমস্ত জোর যেন মূহর্তে নাই হয়ে গেছে। ইমতিয়াজ সাহেব তাকে সাবধান করার পূর্বেই ঘটে গেল যা ঘটার।
মিসেস ইমতিয়াজ ছুটে আসলেন।
ড্রয়ং রুমে ঢুকেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন। সব আগে ধাতস্ত হলেন করিম সাহেব।
ওকে এখনি হাসপাতালে নিতে হবে।
ততোক্ষনে বাড়ির চাকর বাকর ড্রায়ভার মালী সবাই হাজির। সবাই মিলে ধরাধরি করে নিলুকে গাড়িতে উঠাল।
ইমতিয়াজ সাহেন ও মিসেস ইমতিয়াজ পেছনের সিটে বসে তাদের কোলে নিলু কে শুইয়ে নিলেন। সামনে বসেছেন করিম সাহেব। বিদ্যুত বেগে গাড়ি চলছে। ভেতরে নিলুর মাথা দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। মিসেস ইমতিয়াজ চিৎকার করে কাঁদছেন।
ইমতিয়াজ সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। করিম সাহেব ভেতরে ভেতরে ভীষন অনুতপ্ত।
না জানি তার জন্যই.......আল্লাহ তুমি বাবু কে নিচ্ছ নাও কিন্তু এই ফুলের মত মেয়েটা কে নিওনা।
মিসেস ইমতিয়জের কান্না দেখে তিনি চুপ থাকতে পারলেন না।
আপা কাঁদবেন না, আল্লাহ কে ডাকুন।
করিম ভাই নিলুর কিছু হয়ে গেলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচব, আমাকে মা বলে কে ডাকবে?
করিম সাহেব কচি খোকা নন। বাবুর সাথে নিলুর সম্পর্কের কথা তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে এত ভালবাসা ছিল আগে বুঝেননি। নিলু বোধহয় বাবুর অসুখের কথা জানতনা উপর থেকে সবকিছু তার কাছ থেকে শুনেই......তিনি আর ভাবতে পারলেন না। সব কিছুর জন্য নিজেকেই দোষি মনে হল।
ড্রায়ভারের ডাকে বুঝতে পারলেন হাসপাতাল এসে গেছেন।
জলদি নেমে চারজনে জরুরী বিভাগে গেলেন।
ডাক্তার আমার মেয়ে কে বাঁচান। ইমতিয়াজ সাহেব হাও মাও করে কেঁদে উঠলেন।
পুলিশ কেস না তো ?
জ্বী না ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে গেছে।
ডাক্তারের কথায় করিম সাহেব উত্তর দিলেন।
নার্স ট্রলি আন ওটি তে নিতে হবে।
দুই ঘন্ঠ পর নিলুকে ওটি থেকে বের করল। ইমতিয়াজ সাহেব ডাক্তার সাহেবের হাত চেপে ধরলেন।
ডাক্তার সাহেব এ মেয়েই আমাদের একমাত্র সন্তান।
ডাক্তার সাহেব ইমতিয়াজ সাহেবের ঘাড়ে হাত রাখলেন, ভেঙ্গে পড়বেন না। আল্লাহ কে ডাকেন আর বুকে শাহস রাখেন।
এই মাত্র একটা কেবিন খালি হল আমি আপনার পেশেন্ট কে ও খানে রাখার ব্যাবস্থা করছি।
জ্বী আপনাকে অনেক ধন্যবাধ। করিম ভাই আপনি বাড়ি গিয়ে আপাকে খবর দেন।
আমি আর নিলুর মা এখানে আছি
২৭
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ইকবালের সাথে দেখা। প্রচন্ড জোরে সাইকেল চালিয়ে হাপাচ্ছে ইকবাল।
চাচা বাবুর অবস্থা খুব খারাপ, জলদি চলেন।
করিম সাহেব প্রায় দৌড়ান শুরু করলেন। বাড়ির কাছে এসে তিনি ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন।
ইকবাল বাবু বেঁচে আছেতো?
বলতে পারবনা চাচা, আমি যখন বের হয় তখন ছিল। আজ খুবই ব্লিডিং হচ্ছে, ইকবাল কেঁদে কেঁদে উত্তর দিল।
করিম সাহেন দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন পেছনে ইকবাল। বাবু বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা। তার বন্ধুরা তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে সবার চোখে পানি।
কেও কেও জোরে কাঁদছে। বাবুর মা তার মাথার কাছে বসে চিৎকার করে কাঁদছেন। বাবু একদমই নড়াচড়া করছেনা। করিম সাহেব এগিয়ে গেলেন বাবুর দিকে। কপালে হাত দিলেন, গরম।
ও এখনও মরে যায়নি, বেঁচে আছে।
আক্তার ও মিতুল করিম সাহেবের দুই হাত ধরে টেনে আনার চেষ্টা করল। করিম সাহেব চিৎকার দিয়ে কাঁদা শুরু করলেন। ছেড়ে দাও আমাকে। আমার একমাত্র ছেলে আমার নয়নের মনি যে আমাকে ছাড়া একলা কোথাও কোনদিনই যায়নি, সে এতটা পথ একা কিভাবে যাবে ?
এই বাবু আমাকে সাথে নিবিনা ?
কামাল এগিয়ে এসে করিম সাহেবের ঘাড়ে হাত রাখল, চাচা বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ইকবাল রিক্সা নিয়ে আয় খালাম্মা আপনিও চলেন। নিপা তুই আর রুপা বাবুর কিছু কাপড় সাথে নে।
কামাল ডাকে, বাবু..এই ..বাবু সামান্ন ঘঢ় ঘড় শব্দ আসে তার মুখ থেকে কোন নড়া চড়া নেয়। দৌড়ে ঘরে ঢুকল ইকবাল।
রিক্সা এসে গেছে।
ঠিক আছে নিপা রুপা তোরা খালাম্মা ও খালু কে নিয়ে রিক্সায় উঠ।
আক্তার মিতুল ইকবাল তোরা বাবু কে ধর আমার সাথে। চার জনে চেড়ে বাবু কে রিক্সায় উঠাল। কামাল ও মিতুল রিক্সায় বসল তাদের কোলে বাবু।
রিক্সা অয়লা ভাই একটু টান দিয়া যান, বলল মিতুল।
বাবুর ঘাড় বাম দিকে ডান দিকে দুলছে রিক্সার ঝাকুনিতে। কামাল বাবুর মাথাটি শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে চিন্তা করল, এটাই বুঝি নিয়তি। যে বাবু তাদের এতদিন মাতিয়ে রেখেছে, তাদের কারো কোন বিপদে পাশে দাড়িয়েছে। শু পরামর্শ দিয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে। তার অনুপ্রেরনা ছাড়া তারা যে অচল আর চিন্তা করতে পারল না কামাল ।
ক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। কামাল পরম মমোতায় বাবুর চুলগুলি নাড়তে লাগল।
বাবুরে তোর জন্য দুঃখ হচ্ছেরে, এই একুবিংশ শতাব্দিতে এসেও কেও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে কেও ভেবেছিল? অবশ্য চাচাতো কম চেষ্টা করেন কিন্তু ঐ অমানুষ যারা ঠেলে দিল তোকে মৃত্যুর দরজায় ওদের কি হবে ? এভাবে তারা আর কতদিন হত্যাকান্ড করে যাবে ? এ সব কি কেও দেখবে না ? আর কত কাল আপনারা অন্ধ হয়ে থাকবেন ? শুনেছি ইচ্ছা করলে আপনারা সব পারেন তবে কেন এই নিরবতা? এক বার চোখ মেলে ভাল করে দেখেন আমরা আজ কতটা অসহয়।
স্পিড ব্রেকারের ঝাকুনিতে কামালের বাস্তবে ফিরে আসে। রাস্তার লোকজন কৌতুহলি হয়ে দেখছে তাদের।
এ কামাল কি হয়েছে রে ? রাস্তায় দাড়িয়ে চিৎকার দিল তাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড ।
বাবুকে হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছি।
হাসপাতাল ! অবাক চোখে সে রিক্সাটি সামনের বাঁক না নেয়া পর্যন্ত চেয়ে থাকল এরপর জোরে হাটতে লাগল। তাদের the great বাবুর সিরিয়াস অবস্থা, হাসপাতলে ভর্তি হয়েছে এ খবরটি সবার কাছে পৌছাতে হবে। তার হাটার গতি আরো বেড়ে গেল।
নিপা ও রুপা বসেছে এক রিক্সায়। আজ পথ যেন শেষই হচ্ছে না। বলল রুপা।
ঠিকই বলেছিস আচ্ছা রুপা তোর কি মনে হচ্ছে, বাবু বাঁচবেতো ?
তা বলতে পারবনা। তবে আল্লাহ না করুন ওর কিছু হল....কথা শেষ হবার আগেই সে ডুগরে কেঁদে উঠে।
নিপাও নিজেকে থামাতে পারেনা।
রিক্সা অয়ালা পেছনে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আপা নামেন ,হাসপাতাল চইল্যা আইসছি।
ওরা নামল। ইকবাল ও আক্তার সাইকেল নিয়ে আগেই এসে গড়েছে। তারা সবাই মিলে বাবুকে ভেতরে নিয়ে গেল।
কর্তব্যরত ডাক্তার ছুটে এসে বাবুকে দেখলেন। এখানে ভর্তি করতে হবে কিন্তু কেবিন বা অয়ার্ডে কোন বেড খালি নেয়। মেঝেতে থাকতে হবে নয়তো কোন বেসরককারি ক্লিনিকে নিয়ে যান।
মিতুল চিন্তা করল , হায়রে দেশের অবস্থা ! মন্ত্রি এমপি রা সবসময় দেশের বাইরে চিকিৎসা করায়তো তাই একটা জেলা শহরের সদর হাসপাতালের আসন সংখ্যা ৫০ শয্যা।
মেজেতে থাকতে পারলে বলেন আমি ব্যাবস্থা করি।
একটা কেবিন ছিল ঘন্ঠা খানেক আগে একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে।
জ্বী , আমি জানি। ইমতিয়াজ সাহেবের মেয়ে ওখানে ভর্তি হয়েছে। উনি আমার ভাইরা।
কি বললে, নিলু হাসপাতালে ? জিজ্ঞেস করলেন বাবুর মা।
ঠিক একই প্রশ্ন নিপা রুপা কামাল ইকবাল মিতুল আক্তার সবার।
হ্যাঁ।
সংখেপে করিম সাহেব জানালেন সবকিছু।
আচ্ছা উনি যখন আপনার আত্নীয় তখন উনাকে বলে দেখুন। উনি অনুমতি দিলে আপনারা ডাবলিং করে থাকতে পারতেন বেডতো দুটোই আছে।
বললেন ডাক্তার সাহেব।
জ্বী আমি যাচ্ছি এখনি।
কিছুক্ষন পর করিম সাহেব ফিরে এলেন সাথে ইমতিয়াজ সাহেব। বাবুর মা কে দেখে কেঁদে উঠলেন তিনি।
আপা বাবুতো আমার ছেলেই এর জন্য অনুমতি কি? চলেন কেবিনে যায় নিলুর মা একা আছে।
বাবুর বন্ধুরা তাকে ধরাধরি করে কেবিনে নিয়ে গেল।
২৮
পরের দিন নিলু ও বাবু দুজনেরই অবস্থার আরো অবনতি হল। নিলুর সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মাথায় ইন্টরনাল রক্তক্ষরন হচ্ছে। ডাক্তাররা তার ব্যাপারে আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছে। অপারেশন করলে ক্ষীন একটা সম্ভবনা আছে কিন্তু তাতো এখানে সম্ভব নয়।
আর রোগীকে এই অবস্থায় অন্য কোথায় নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। ইমতিয়াজ সাহেব ও মিসেস ইমতিয়াজের বিদ্বস্থ্য মুখের দিকে কেও তাকাতে পারছেনা। একমাত্র মেয়ে এত অল্প বয়সে মৃত্যু সয্যায় একি এত সহজে মানা যায় । অপর দিকে বাবুর বাবা মার মনের অবস্থাও প্রায় একাই। তবু তারা অনেকটা ধৈর্য্য ধরে আছেন কারন বাবুর অসুখতো আজ নতুন নয়।
এ ক’মাসে অনেকটা সয়ে এসেছে। তার পরও ছেলেতো তাও একমাত্র।
ছোট্ট একটা ঘর। সেই ঘরে দুইজন মৃত্যু পথযাত্রী। বাবুর বাবা মা নিলুর বাবা মা তাদের বন্ধু বান্ধব, আত্নীয় স্বজন যারা আসছেন সবাই আজ ভীষন বিষন্য।
অস্রশিক্ত নয়ন সবার। এমন কি কর্তব্যরত নার্সও না কেঁদে থাকতে পারেনি। ডাক্তার রাউন্ডে এলেন সকাল এগারটায়। প্রথমে তিনি নিলুকে দেখলেন তারপর বাবুকে। এর পর তাদের রিপোর্ট গুলি কিছুক্ষন নাড়া চাড়া করলেন।
কামাল মনেমনে চিন্তা করল, বাবু ও নিলু দুজনে হাটছে হাত ধরে। নিলুর চুলগুলি বারবার উড়ে এসে তার মুখ ঢেকে দিচ্ছে সে সরাবার চেষ্টা করছে বারবার কিন্তু অবাধ্য চুল কিছুতেই তার কথা শুনছেনা। তারা হাটছে অজানার উদ্দেশ্যে অচেনা পথে। তাদের চারপশে শুধুই সবুজের সমারহ। ঠিক যেন কোন সবুজের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দুজন।
আচ্ছা এটা কি স্বর্গ !
ইমতিয়াজ সাহেব করিম সাহেব, আপনারা একটু বাইরে আসবেন ? ডাক্তার সাহেবের কথায় কামাল ভ্যাবাচাকা খায়।
আরে কি ভাবছি এ সব, খামখা।
ইমতিয়াজ সাহেব করিম সাহেব ডাক্তারের পেছনে বাইরে গেলেন। আক্তারও উনাদের কথা শোনার জন্য পিছু নিল।
দেখুন যদিও আমার বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তবু আপনাদের জানা উচিত।
আপনি চলদি বলুন ডাক্তার সাহেব। ডাক্তারের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন করিম সাহেব।
ইমতিয়াজ সাহেব ডাক্তারের হাত চেপে ধরলেন, ওদের জন্য কি কিছুই করার নেয় ?
জ্বী না, আমি দুঃখিত। আসলে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আপনারা মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি নেন।
আড়ালে দাড়িয়ে আক্তার স্তব্ধ হয়ে গেল।
পরিশিষ্ট
খুক চমৎকার একটা ফুল বাগান। ফুলে ফুলে ভরে আছে চারদিক। অন্য পাঁচটি ফুল বাগানের মত মনে হলেও এটি প্রকৃত কোন ফুল বাগান নয়। এটি একটি কবরস্থান।
ফুলে ফুলে ঢেকে আছে পাথর দিয়ে বাঁধান দুটি কবর । পাশাপাশি।
চারপাশে নাম জানা অজানা অজস্র ফুল গাছ। মাঝে মাঝে এখানে ক্রদনরত অবস্থায় দুজন লোককে দেখা যায়। তাদের একজন বাবুর বাবা অন্যজন নিলুর বাবা।
মাঝে মধ্যে কামালরা ও আসে। কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকে, তারপর চলে যায়।
স্ত্রীদের অনুরোধে ইমতিয়াজ সাহেব ও করিম সাহেব তাদের পাশাপাশি সমাধিস্থ করেন।
কবরস্থানের কেয়ারটেকার বৃদ্ধ সবেদ আলী প্রায় দেখেন, ষোল সতের বছর বয়সী দুজন ছেলে মেয়ে ঐ বকুল গাছটার নিচে বসে আছে। ছেলেটি মেয়েটির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে ঘন্ঠার পর ঘন্ঠা।
আর মেয়েটি পরম মমতায় হাত বুলাতে থাকে ছেলেটির চুলে। চোখে থাকে তাদের আনন্দের ঝিলিক। ঠিক যেন পূনিমার চাঁদের মত চিকচিক করে।
__________________শেষ_____________________ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।