অকর্মা, ভীতু, কাপুরুষ ৫
নীলুর বাবা বিরাট ধনী। বাস ট্রাকের ব্যবসা। তাছাড়া জমিজমাও আছে ভালো, ধান চালের মিলও আছে কয়েকটা। নীলুর বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ একটি চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। মিসেস আহমেদ এসে বসলেন পাশের চেয়ারটিতে।
বিয়েতে কি দেবে কিছু ঠিক করেছো।
দেখা যাক চেন বা কানের দুল টুল একটা দিলেই হলো।
নীলু স্কুল থেকে ফিরে রুমে ঢুকার সময় দরজা থেকে বাবা মায়ের কথা গুলো শুনলো। কোথায় যাবে মা ?
সুন্দরপুর তোর রেবা আপুর বিয়ে।
আমিও যাব মা।
হ্যা মা, অবশ্যয় যাবি|
আমরা কিন্তু নতুন মাইক্রোবাসটিতে যাব।
নীলু খুবই আনন্দিত হলো। তার ঘরে গিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসলো। খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুলো। স্কুল থেকে ফিরে একটু রেষ্ট নেওয়া তার অভ্যেসের একটি।
শুয়ে শুয়ে সে বিয়ের দিনের কথা চিন্তা করতে লাগলো। তার মনের পর্দায় সর্বপ্রথম যে ছবিটি ভেসে উঠলো, সেটি বাবুর।
ধুৎ, সে অন্য কাউকে ভাবতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারলো না। শুধু বাবুর ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে সি.ডি পেয়ারে একটি ডিস্ক ঢুকিয়ে দিল।
আনন্দের সময় নীলু ইংলিশ গান শুনে, এটাও তার নিয়মের একটি। মাঝারী ভলীয়্যুমে ‘ডোনা সামারের’ গান যেন ঘর ফাটিয়ে ফেলবে। এমন সময় নীলুর দুই বান্ধবী নিপা ও রুপা এল। কানে হাত দিয়ে ঢুকে চিৎকার করল রুপা, ভলিয়্যুম কমা।
কিরে এত রঙে আছিস কি খবর ? স্বপ্নের রাজপুত্রের দেখা পেলি তাহলে ?
বাজে বকিস না নিপা।
বলনারে তোর এই আনন্দের কারন ?
না রে তেমন কিছু হয়নি। সামনে সোমবার আমরা সবাই সুন্দরপুর যাচ্ছি।
সুন্দরপুরে তো যাচ্ছিস কিন্তু এতে আনন্দের কি আছে ? আমাদের জানা মতে তুইতো বেড়াতে টেড়াতে সেরকম পছন্দ করিস না।
নীলু একথাটিতে প্রচন্ড রেগে যায়। তোরা কি এই জন্যই এসেছিস ? শুধু শুধু জেরা, আমার একদম পছন্দ হয় না।
আসলে বাবু ও নীলু একে অপরকে মনে মনে পছন্দ করে। তাকে দেখার জন্যই নীলু সুন্দরপুরে যেতে এত আগ্রহী। তারা দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই বোন। প্রায় মার্কেটে বা রাস্তায় দেখা হয় কিন্তু কেউ লজ্জায় কথা বলতে পারে না। একে অপরকে দেখেও না দেখার ভান করে।
মনে মনে তারা একে অপরকে পছন্দ করলেও মুখোমুখি দেখা হলে তারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে তাদের শেষ দেখা হয়েছিল। বাবু যখন কৌতুক দিয়ে সবাই কে মাত করে দিচ্ছিল, তখন নীলুর সেকি হাসি। বাবু তার দিকে চেয়ে মনে মনে কল্পনা করছিল তার এ জীবন বুঝি আজকে সার্থক হল। হাসতে হাসতে যেই তাদের চোখে চোখ পড়লো নীলু মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিল।
যে হাসিটি বাবু আজও মনে রেখেছে।
পুরনো দিনের সেই সব স্মৃতিগুলো চিন্তা করে নীলু কেমন যেন আনমোনা হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় নিপা নীলুর পিঠে কিল বসিয়ে দেয়। কিরে সেই প্রথম থেকে আজ তোকে কেমন যানি দেখাচ্ছে। রুপা একটা খাতা আর পেন আনতো।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, খাতা পেন দিলে নীলু একটি কবিতা লিখে ফেলতে পারবে।
নীলু চোখ রাঙিয়ে তাকালো, নিপা
তোর যখন শুধু মুড অফ তখন আমরা যাই
এই শোন, তোরা আমাদের সাথে সুন্দরপুর যাবি ?
নিবি আমাদেও ? তাহলেতো আমরা বত্তে যাই। সরজমিন গিয়ে আনন্দের কারন টা নিজ চোকে দেখে আসতে পারব।
৬
রবিবার বাবু স্কুলে গিয়ে শুনলো রইস স্যার একটা পুরো ইংরেজী রজনা মুখস্ত করতে দিয়েছে। এই শুনে যারা আগের দিন স্কুলে যায়নি তাদের মুখের রক্ত সরে গেল।
কারন রইসুদ্দিন স্যারের স্বভাব এবং সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করা বেত সম্পর্কে তারা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছে।
বাবু এসব কিছুই জানে কিন্তু তার মুখের কোন পরিবর্তন হলো না। যদিও সে আগের দিন স্কুলে আসেনি। রুটিন বের করে দেখলো ইংলিজ দ্বিতীয় পত্র সপ্তম অর্থাৎ শেষ প্রিয়ডে। মানে আর মাত্র চার ঘন্টা সময় আছে।
কিন্তু কি করবে কিছু ভেবে পেল না। মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য মনে মনে নীলুর কথা চিন্তা করতে লাগলো। নীলুর কথা মনে আসতেই একটি চমৎকার বুদ্ধি মাথায় এলো।
ষষ্ঠ প্রীয়ড শেষ করেই বাবু ক্লাস থেকে উধাও। খোঁজ খোঁজ, কিন্তু বাবু কোথাও নেই।
এদিকে রইসুদ্দিন স্যারকে হাজিরা খাতা ও তেল মাখা বেত হাতে ক্লাসের দিকে আসতে দেখা গেল। খাতা আজ হাতে আছে, মানে কপালে আজ দুঃখ আছে।
খাতা খুলে তিনি প্রথম প্রীয়ডের সাথে মিলিয়ে দেখবেন কেউ পালিয়েছে কিনা। বাবুর পালিয়ে যাবার পরিনতির কথা চিন্তা করে সকলে শিহরিত হলো। স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলেন।
সকলে উঠে দাঁরালো। ‘বস, - - -
খাতা খুলে তিনি শুরু করলেন, ১, ২, ৩, ৪, . . . . .১০, . . . ১৫. । কিন্তু যেই তিনি বললেন ২০, কেউ প্রেজন্ট করলো না। তিনি পর পর তিনবার বললেন ২০, ২০, ২০।
ভয়ে ছাত্রদের মুখ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে।
স্যার আজ প্রথমেই ক্ষেপেছেন, মানে আজ হাড্ডি থাকছে না। নাম হাজিরা করে স্যার প্রশ্ন করলেন, কি পড়া ছিল যেন ?
স্যার নিউজ পেপার।
বেশ তা কে কে পড়া পারবে না দাঁড়াও।
সাথে সাথে প্রায় দশ বারো জন ছাত্র উঠে দাড়াল।
রইসুদ্দিন স্যার কর্কশ ভাবে হুকুম দিলেন নীলডাউন দাও।
সাজা প্রাপ্ত ছাত্ররা বাবুর উপর প্রচন্ড ভাবে ক্ষিপ্ত হল। কারন তার জন্য আজ তাদের একটি শাস্তি বেশি বোগ করতে হচ্ছে। রইস স্যারের শাস্তি সম্পর্কে ইতিমধ্যে বেশ পরিচিত হয়েছে। তার শাস্তির নিয়ম হচ্ছে প্রথমে চলিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা এবং পরে পাঁচ মিনিট বেত্রাঘাত।
পঁয়তালিশ মিনিটের ক্লাসে যখন ৩৫ মিনিট পার হয়েছে ঠিক তখন দরজার কাছে কে যেন বলল, ‘মে আই কাম ইন স্যার’
ইয়েস পিজ ডু।
রইসুদ্দিন স্যার দরজার দিকে তাকাতেই চক্ষু স্থির। দরজায় বাবু দাড়িয়ে।
ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি, ক্লাস শেষ হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। গম্ভীর ভাবে বললেন,‘এখানে এস। ’
বাবু এগিয়ে গেল।
কোথায় গিয়েছিলে ?
স্যার ছোট ঘরে।
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ছোট ঘর ?.
অন্দর মহলে স্যার।
এবার রইস স্যার ক্ষেপে গেলেন, কি বলতে চাচ্ছ তুমি ? ছোট ঘর, অন্দর মহল এসবের মানে কি ?
সাজাপ্রাপ্ত আসামীর একজন বলল ‘পায়খানা’। স্যার চোখ পাকিয়ে তাকালেন বাবুর দিকে। ঐ ছেলে যা বলেছে তা সত্যি।
জ্বী স্যার।
আর ইউ ম্যাড ? ৩৫ মিনিট ধরে তুমি পায়খানায় বসে ছিলে।
জ্বী স্যার বিশ্বাস না হলে কাউকে পাঠান, গিয়ে দেখে আসুক অন্তত কেজি পাঁচেক দিয়েছি।
হোযাট ? এগিয়ে এসো।
বাবু এগিয়ে যেতেই স্যার প্রচন্ড জোরে পিটে আঘাত করলেন।
সাথে সাথে ছাত্ররা শুনতে পেল কে যেন খিক খিক খ্যাক খ্যাক করে শব্দ করছে। স্যারও এদিক ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। তারা সবাই অবাক হযে দেখলো এই বিচিত্র শব্দটি বাবুর মুখ থেকে বের হচ্ছে এবং তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্যার ঠিক বুঝতে পারলেন না যে সে হাসছে না কাঁদছে। তিনি কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
বাবুর আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর আকার দারন করলো। স্কুলের পাশে রাস্তার কৌতুহলী কিছু লোক জানালার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো এবং কিছুক্ষনের মধ্যে ঘরের চারপাশের জানালায দেখা গেল অন্তত বিশ পচিশ জন লোক জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়ে রয়েছে।
রইসুদ্দিন স্যার লজ্জায় ক্লাস ত্যাগ করলেন। সাথে সাখে ছাত্ররা বাবুকে মাথায় তুলে নিল। সাজা প্রাপ্ত আসামীদের একজন বলে উঠলো বাবু ভাই,
সকলে একত্রে জিন্দাবাদ।
৭
রেবার হবু বর ম্যাজিষ্ট্রেট |
আজকাল বিযের বাজার ম্যাজিষ্ট্রেট বরদের প্রচুর দাম। কনের বাবারা যে কোন মুল্যে কিনে নিতে প্রস্তুত। রেবার বাবা রায়হান সাহেবও জামাইকে কিনে নিয়েছেন প্রায় দুই লক্ষ টাকা দিয়ে।
সি.ডি.আই মটরসাইকেল কেনা হয়েছে, তাছাড়া টিভি, রেফ্রীজারেটর, ভি.সি.পি, ষ্টীলের আলমারী সহ সব ফার্নিচার কেনা শেষ হয়েছে।
আজ রোববার, কালকেই বিয়ে।
সবকিছু কেনাকাটা শেষ।
পাঁচটি গরু ও আটটি খাশি জবাই হবে। রায়হান সাহেবের একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য সামান্যতম কার্পণ্য করেন নি। যদিও তার আর্থিক আওতার বাইরে বাজেট তাই কিছু টাকা তিনি সুদে ধার করেছেন। প্রায় ১০০০ লোককে দাওয়াত করা হয়েছে।
তার বাড়ির সামনে আজ প্যান্ডেল করা হয়েছে। সদরের ডেকরেটর থেকে লোক আনিয়ে একটি সুসজ্জিত গেট ও পুরো বাড়ির আলোক সজ্জা করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে আলোক সজ্জার প্রচলন এখনও তেমন হয়নি। তাই অনেক মানুষ মুগ্ধ নয়নে দেখছে এই বিষ্ময়।
আজ রায়হান সাহেব প্রচন্ড ব্যস্ত।
কাল তার মেয়ের বিয়ে। এটাকি কম বড় কথা। এই সেদিনের কথা, রেবা তাকে জড়িয়ে ঘুমাতো। তিনি যতক্ষন বাড়িতে থাকতেন, ততক্ষন মেয়েকে কোলে নিয়ে থাকতে হতো। তার কাছ ছাড়া রেবা আর কারো কাছে যেতো না।
আজ দেখতে দেখতে তার এই আদরের মেয়েটি কতবড় হয়ে উঠেছে। কাল তার আদরের মেয়েটি তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এই কথা চিন্তা করতে তার বুক হাহাকার করে উঠলো। তিনি অনেক কষ্টেও চোখের পানি নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না। চোখের পানি এমনই এক জিনিস, যার উপর কারো নিয়ন্ত্রন নাই।
বাবা,
চমকে পিছনে ফিরলেন রায়হান সাহেব। চোখ মুছতে মুছতে বললেন কিরে ?
বড় মামা এসেছেন।
কখন ?
এইমাত্র।
তুই যা আমি আসছি। রায়হান সাহেব তার এই শ্যালককে খুব পছন্দ করেন।
তার যে কোন কথাই খুব গুরুত্ব দেন। প্রায় ছুটে ঢুকলেন বাড়ির ভিতরে।
এই যে দুলাভাই কেমন আছেন ?
ভাল।
একি দুলাভাই কেদেছেন নাকি ? চোখ একদম লাল করে ফেলেছেন। এ সময় দুর্বল হয়ে পড়লে চলে ? আমি চলে এসেছি, এখন আমি সবকিছু সামলাচ্ছি।
আপনি বিশ্রাম করুন গিয়ে, আর কোন প্রকার চ্িতা করবেন না।
তাই কি হয় রে ভাই, চিণ্তা কে না ডাকলে যদি চিন্তা না হাজির হত, তবেতো চিন্তা বলে কিছু থাকতোনা।
চলবে_________________________________________ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।