পুলিশের এজাহার অনুযায়ী, তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর। চলন্ত ট্রেনের ছাদের ওপর দিয়ে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় দৌড়াতে পারেন তাঁরা। রাতের অন্ধকারে সুযোগ বুঝে গামছা দিয়ে যাত্রীদের গলা পেঁচিয়ে ধরে কেড়ে নেন সর্বস্ব। তারপর ছুরি মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেন। এরপর লুটের টাকা ভাগাভাগি করে তা দিয়ে মাদক কিনে নেশায় মেতে ওঠেন।
পুলিশ দাবি করেছে, তারা এমন সাত তরুণকে শনাক্ত করেছে। তাঁদের হাতে কমপক্ষে সাতজন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক যাত্রী। হতাহত প্রত্যেক ব্যক্তির দেহে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাত দেখা গেছে। অভিযুক্ত সাতজনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একই সঙ্গে তাঁদের ছিনতাই করা মালামাল নামমাত্র মূল্যে কিনে রাখতেন, এমন এক ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই সাতজন হলেন: শিপন ওরফে বিল্লাল (২০), রাকিব (১৮), সোহেল (২০), রনি ওরফে বড় রনি (২২), জাভেদ (২১), রানা (১৯) ও জীবন ওরফে অসহায় জীবন (২৩)। তাঁদের মধ্যে অসহায় জীবন এই দলের নেতা বলে পুলিশ জানিয়েছে। জাভেদ ও রানাকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এদিকে, আটক হওয়ার পর ১ অক্টোবর সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে জীবন, রনি ও সোহেলের গলায় নাম ও বয়স লেখা কাগজ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
সেখানে উল্লেখ করা বয়সের সঙ্গে এজাহারে উল্লেখ করা বয়সের পার্থক্য দেখা গেছে। গলায় ঝোলানো কাগজে জীবনের বয়স ২৮, রনির ২৬ ও সোহেলের ২৪ বছর বয়স দেখানো হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে জামালপুরে চলন্ত ট্রেন থেকে চারজন এবং ১০ সেপ্টেম্বর রাতে টাঙ্গাইলের কাছে অপর একটি ট্রেনে আরও দুজন খুন হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এ চক্রের সন্ধান পায়।
রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও জামালপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা ইতিমধ্যে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শাহরিয়ার আরাফাতের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আলী খান বলেন, তাঁদের আশ্রয়দাতা হিসেবে ঢাকার একটি আবাসন কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক মো. মোশারফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রেল পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে জামালপুর থেকে ময়মনসিংহগামী অগ্নিবীণা ট্রেনের ছাদের তিনজন এবং একই রাতে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুরগামী ট্রেনের একজন যাত্রী ডাকাতের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। তাঁদের মধ্যে দুজন হলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত-মারিয়মের বিবিএর ছাত্র প্রীতম বিশ্বাস (২৩), ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ছাত্র রেজাউল করিম (২৩)। ওই রাতে অজ্ঞাতনামা আরও দুজন নিহত হন।
দুই দিন পর ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেসে’ একইভাবে খুন হন আরও দুজন।
এ ছাড়া ওই রাতে সাত-আটজন গুরুতর আহত হন।
পুলিশ সূত্র জানায়, এ চক্রটি এর আগে গত ২৩ জুন ঢাকা থেকে সিলেটগামী ‘সুরমা এক্সপ্রেস’ ট্রেনে একজন যাত্রীকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যার পর লাশ ছুড়ে ফেলে দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডের কথাও গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন।
জবানবন্দি: গত ১৮ সেপ্টেম্বর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শিপন ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি, জীবন, রাকিব, সোহেল, রানা, রনি ও জাবেদ জামালপুর থেকে সন্ধ্যা সাতটার দিকে অগ্নিবীণা ট্রেনের ছাদে ওঠেন।
ছাদে চার-পাঁচজন যাত্রী ছিলেন। সাতজন মিলে চার-পাঁচজন যাত্রীর কাছ থেকে টাকা-মুঠোফোনসহ প্রায় ১০ হাজার টাকা ছিনতাই করেন। রাকিব ও সোহেল মিলে একজনের চোখ তুলে ফেলেন এবং অপর একজনের কান কেটে নেন। পরে সব যাত্রীকে ছুরি মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেন।
জবানবন্দিতে শিপন বলেছেন, ‘ময়মনসিংহ এসে আমরা ট্রেন থেকে নেমে যাই।
রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে আমরা জামালপুর কমিউটার ট্রেনে উঠি। এই ট্রেন ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর যাচ্ছিল। নরিন্দী স্টেশন পার হওয়ার পর ছাদে থাকা একজন যাত্রীর কাছ থেকে দুইটা মোবাইল ও টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে আমরা ওই যাত্রীকেও ছুরি মেরে ফেলে দেই। তারপর আমরা ইসলামপুর স্টেশনে নেমে যাই। রাতে আমরা একটি মসজিদে থাকি এবং পরের দিন নদী পার হয়ে জামালপুর চলে যাই।
’
জবানবন্দিতে শিপন আরও বলেছেন, ‘৯ সেপ্টেম্বর আমরা সবাই অগ্নিবীণা ট্রেনে করে ঢাকায় চলে আসি। ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে তেজগাঁও ভাঙাব্রিজ থেকে দিনাজপুরগামী দ্রুতযান ট্রেনের ছাদে উঠি। আমাদের সবার কাছে ছুরি ছিল। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেয়, যাদের নাম আমি জানি না। মির্জাপুর স্টেশন পার হওয়ার পর আমরা একটি বগির ছাদের তিনজন ঘুমন্ত যাত্রীকে ডেকে তুলি।
এই তিনজনের মোবাইল ও টাকা-পয়সা নেওয়ার পর তাদের ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেই। এরপর আমরা পরের বগির ছাদে উঠি। সেখানে চার-পাঁচজন যাত্রী ছিল। এদের টাকা-পয়সা ও মোবাইল নিয়ে আমরা এদেরও ফেলে দেই। মনসুর আলী স্টেশনে গিয়ে আমরা সবাই নেমে যাই।
এরপর গাজীপুর হয়ে জয়দেবপুর রেলস্টেশনে যাই। সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বলাকা ট্রেন আসলে সেটিতে উঠে ময়মনসিংহ যাই। ’
ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী ট্রেনের নিহত যাত্রীরা হলেন হাবিবুর রহমান (২৮) ও শামীম রেজা।
জানা গেছে, শিপন ছাড়া অপর চারজনই একই হাকিমের আদালতে একই ধরনের জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ২ অক্টোবর সর্বশেষ জবানবন্দি দেন রাকিব।
রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরা সবাই দরিদ্র এবং ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তান। এরা মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই এরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।