স্বপনের সমাধি খোঁড়া এ জীবন ... মনের গোপন ঘরে যে শ্বাপদ ঘর করে তাকেই লালন করে চলা এ জীবন! ক’দিন থেকে সময়টা ভাল যাচ্ছিল না, কোন কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। ভাবলাম কোথাও একটু ঘুরে আসি। হঠাত করেই সিদ্ধান্ত; ফোন দিলাম মিসেস কে, ঘুরাঘুরির জন্য সে সবসময় এক পায়ে খাড়া থাকে, আর আমার পোলা তো এক ডিগ্রি উপরে... প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় জিজ্ঞাসা করে ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা কোথায় বেড়াতে যাব??
জায়গাটার নাম আগেই শুনে ছিলাম, “আমানোহাশিদাতে” – বাংলা করলে দাঁড়ায় “স্বর্গের সেতু”। এটা “নিহোন সাঙ্কেই” জাপানের সুন্দরতম তিনটি জায়গার একটি । কিয়োতো প্রিফেকচারের টাংগো এলাকার মিয়াজু বে ধরে ৩.৬ কি মি জুড়ে একটা প্রাকৃতিক বালির বাঁধ এটি।
যা হোক, নেট ঘেঁটে স্পট গুলো দেখে নিলাম – এখানে এই একটা সুবিধা, নেটে টুরিস্ট স্পট গূলোর এত সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় যে স্বশরীরে যাওয়ার আগেই জায়গাটা অর্ধেক চেনা হয়ে যায়। আমাদের কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সুমুদ্র সৈকত – এই তথ্য আমরা ছাড়া বিশ্বের আর কেও খুব একটা জানে বলে মনে হয় না। যা হোক দেশের বদনাম না করি।
পর দিন সাত সকালে সপরিবারে রওনা হলাম। ওসাকা থেকে যাওয়ার দুই ধরনের ট্রেন আছে, লোকাল আর এক্সপ্রেস।
একটার ভাড়া আরেকটার দ্বিগুণ, সময়ও তেমনি অর্ধেক; সংগত কারনেই লোকাল ট্রেন ধরলাম। কিয়োতো থেকে ৩ বার ট্রেন চেঞ্জ, চেঞ্জের সময় ১ থেকে ৪ মিনিট, চিন্তার কিছু নেই – যেখানে যখন যে ট্রেনের থাকার কথা তার একটু ও নড়চড় হবে না - এ আস্থা আগেই তৈরি হয়েছে। প্রথম ট্রেনটা ভালই ছিল, পরের গূলোর বগি কমতে কমতে ১ এ এসে দাড়াল। বিশাল বিশাল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সরু ট্রেন লাইন, পাহাড় ফূটো করে লম্বা লম্বা টানেল, কোন কোন টা ৪-৫ কিমি লম্বা, দুই পাহাড়ে নিচ দিয়ে ঝর্না তার উপর দিয়ে পুরান আমলের ব্রিজ, ট্রেন লাইনের পাশে মাঝে মাঝে পাহাড়ী গ্রাম, ধান ক্ষেতে পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক --- --- এই সৌন্দর্য লিখে বুঝানো আমার সাধ্যের অতীত। দেশের রাস্তা ঘাটের কথা মনে পড়ে গেল! পাহাড় পর্বতে ভরা একটা দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এরা কত সুন্দর যাতায়াত ব্যবস্থা করেছে আর আমাদের সমতল ভুমির একটা দেশে মহাসড়ক গূলোর কি অবস্থা! দেশের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাত দেখি আমার নিজ জেলা মাগুরাতে পৌছে গেছি – বিশ্বাস হয় না? দেখেন তাহলে ---
ষ্টেশন, ট্রেন লাইন, ট্রেনগুলো দেখে বুঝা যাচ্ছে এগুলো অনেক পুরাণ আমলের।
আবার দেশের কথা মনে পড়ে যায়; দু’দেশেই সম্ভবত ট্রেন চালু হয়েছিল কাছাকাছি সময়ে, এরা সেই পুরাণ ট্রেন থেকে এখন সিংকান্সেন বানিয়ে ফেলেছে আর আমরা যেগুলো ছিল সেগুলোর লোহা-লক্ষড় খুলে কেজি দরে বিক্রি করে লবন কিনে খেয়েছি! সরি, আবার দেশের বদনাম করে ফেললাম!
যাহোক, পুরা জার্নি আমার ছেলে খুব এঞ্জয় করল। পুরা ট্রেনের বুড়া-বুড়ি গূলো না ঘুমিয়ে ওর বাঁদরামি দেখতে লাগল। আর সেও উৎসাহ পেয়ে পারলে ট্রেন থেকে লাফ দেয়! ১ টার দিকে পৌঁছুলাম আমানোহাশিদাতে ষ্টেশনে, আমাদের হোটেলের চেক-ইন ছিল ৩ টা থেকে, ভাবলাম দু’ঘণ্টা একটু আশে পাশে ঘুরে নিই। ৫/৭ মিনিট হাটতেই একটা ব্রীজ এর মুখে দেখলাম কিছু মানুষের জটলা, কাছে গিয়ে বুঝলাম, আসলে ওটা রিভল্বিং ব্রীজ, জাহাজ চলাচলের জন্য কিছু সময়ের জন্য খুলে রাখা হয়েছে।
বীচে গোছল করার জন্য পোলা আর আমি বিশাল প্রিপারেশন নিয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু দেখি বিশাল বীচ পড়ে আছে অথচ একজনকেও সেখানে নামতে দেখলাম না। মিসেস বিশেষজ্ঞের মত জানালো, এখানে জুলাই-আগষ্ট ছিল সামার, এখন সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ, সামার শেষ, সুতারাং পানি ঠান্ডা হোক আর না হোক এখন পানিতে নামা দামে (নিষেধ)! জাপানীজদের এই রোবটের মত নিয়ম মানা মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে!! কি আর করা অগত্যা পানিতে পা ডুবিয়েই বাপ-বেটাকে সন্তষ্ট থাকতে হলো।
গোছলটা হোটেলে গিয়েই দিতে হলো। হোটেল থেকে আবার বীচে ফিরে আসতে সাড়ে পাঁচটা মত বাজল। ইচ্ছা ছিল রাতে বীচের পাশে কোন এক জাপানী রেস্টুরেন্টে খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বীচে কাটিয়ে হোটেলে শুধু ঘুমানোর জন্য ফিরব।
হায় কপাল! দেখি সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ, বীচে মানুষজন নাই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞ মিসেস জানালেন, সবকিছু ৫ টা পর্যন্ত খোলা, এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে তাই সব বন্ধ। খিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আমি গজ গজ করতে থাকলাম – জাপানিজরা কি মানুষ না রোবট! ৫ টার সময় নাকি ঘুরার জায়গা বন্ধ হয়ে যায়! আরে আমাদের দেশে তো ৫ টার সময় ঘুরা ঘুরি শুরু হয়!! দিনটাই মাটি হলো!
আবার হোটেলে ফিরলাম। রিসিপ্সনিষ্ট দু’টি ফ্রি টিকেট ধরিয়ে দিল – জাপানী ওন্সেন।
অনেক দিনের শখ ছিল, আজ সুযোগ পেয়ে আর মিস করতে চাইলাম না। হোটেলে ডিনার সেরে বাপ-বেটা রওনা হলাম এডভেন্সারে। ওখানে ঢূকতেই তো চক্ষু চড়কগাছ। আমার পোলাতো লোকগুলোর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে হাসে আর কয় নেংটু... নেংটু ... দেখ বাবা, ওজিচানটা (দাদু) না নেংটূ!! আমি ওদিকে আর কি দেখব, পোলার কাছে নিজের ইজ্জত বাচাতে ব্যস্ত তখন! পানিটা এত গরম যে প্রথমে ভেবেছিলাম এখানে নামা অসম্ভব, কিছুক্ষন পরে অবশ্য ঠিক হয়ে গেল! উনি অন্য মানুষের নেংটূ দেখে বেড়াচ্ছেন, উনার নিজের টার খবর নাই!!
পরদিন খুব সকালে বের হয়ে আবার বীচে গেলাম। স্বর্গের সেতু ধরে হাজার হাজার পাইন গাছের মধ্য দিয়ে ৩.৬ কিমি পথ হেটে অন্য প্রান্তে গেলাম।
স্বর্গ আসলে কেমন হবে তা তো শুধু কল্পনা! তবে বাস্তবে জায়গাটাকে স্বর্গের সাথে তুলনা করা যথার্ত মনে হল। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও মনে হয় বোর লাগবে না। আমানহাশিদাতের দু’প্রান্তে পাহাড়ের উপর পার্ক, অব্জারবেশন টাওয়ার, পাহাড়ে উঠার রোপ-ওয়ে এখাঙ্কার সৌন্দর্য আরো বাড়ীয়ে দিয়েছে। এত সৌন্দর্য আমার ছোট্ট সস্তা ক্যামেরায় ধারণ করা ব্যর্থ চেষ্টা। তারপরও কিছু ছবি না দিলেই নয়ঃ
সমুদ্র-পাহাড়-আকাশ
প্রায় ৮০০০ পাইন গাছে ঢাকা পুরা পথটা
ক্লান্ত দুপুরে শান্ত ছায়া
তৃষ্ণা জুড়াতে এখানকার বিখ্যাত মেলন আইস্ক্রিম
একটা টেম্পলে গিয়ে দেখি সদ্য বিয়ে হওয়া জাপানী বর-বধু (মেয়েটাকে খুব হাসি খুশি দেখাচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা কেন জানি খুবই বিরক্ত - বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরেছে মনে হয় !!)
উত্তর প্রান্ত থেকে দেখলে এমন দেখায়
না, এখানে পোলা বাঁদরামি করছে না; এটাই এখানকার দৃশ্য দেখার ট্রেডিশনাল উপায়
উল্টা হয়ে দেখলে এমন দেখায়
এটা দক্ষিন প্রান্ত হতে ভিউ, কিছুটা ড্রাগন সেপ
জাপানে যারা আছেন তারা তো অবশ্যই অন্যরাও সুযোগ থাকলে এখানে বেড়াতে আশার জন্য রিকমান্ড করব।
সবাই ভাল থাকুন !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।