জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।
'আইল অফ ওয়াইট' (Isle of Wight): মেইনল্যান্ড থেকে পাঁচ থেকে আট কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত, মাত্র ২৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দ্বীপ। লন্ডন থেকে দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটারের মতো।
কথা না বাড়িয়ে ঘুরাঘুরিতে চলে আসি। আগেই বলেছি বন্ধু মুনতাকিম বেড়াতে লন্ডনে আসছে।
তাই সব বন্ধুরা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম 'আইল অফ ওয়াইট' ঘুরতে যাবো, কিন্তু যাবার দিনক্ষণ কেউ মনস্থির করতে পারছিলাম না। বাড়তি তথ্যের জন্যে আবার ব্লগের দুরন্ত ভাইকে মেইল দিলাম, তিনি বেশ কিছু লিংক পাঠিয়েছিলেন। যদিও প্ল্যান করে আমাদের কোন কিছু করা হয়নি।
যাইহোক, শুক্রবারদিন সকালে 'আইল অফ ওয়াইট' রওয়ানা হবো বলে ঠিক করি। কথামতো আগের রাতে বার্মিংহ্যাম থেকে মাহিন এসে হাজির, আমি সফি, রাসেল তিনজনই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম, হীরা সোয়াইন ফ্লু'র অজুহাত দিয়ে কাজ ফাঁকি দিয়ে যাবার জন্য রেডি, জর্জ রাসেল যাবার কথা থাকলেও শুক্রবার হওয়াতে সে কেন্ট থেকে আসতে পারেনি।
রাকিবকে অনেক জোরাজুরি করার পরও রাজী করানো গেলো না।
সকাল সাত-আটটার মধ্যে আমাদের বের হয়ে যাবার কথা থাকলেও নয়টার দিকে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি তখনো সবাই ঘুমাচ্ছে। একজন একজন করে সবাইকে ডেকে তুললাম। আমরা ছয়জন যখন ব্যাক প্যাক করে বাসা থেকে বের হবার জন্য যখন প্রস্তুত, তুষার, আগেরদিন রাতে কোন কারণে বাসায় এসেছিল চোখ কচলাতে কচলাতে হঠাৎ বলে, 'দোস্ত তোরা যাচ্ছিস, আমারও তো যেতে ইচ্ছে করে!' তুষারের এমন কথা শুনে আমরা হাসব নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছিলাম না! সবাই তাকে বললাম দৌড় দে, তাড়াতাড়ি রেডি হ। ওর কাজ ছিল বিধায় তাকেও কাজে সিক কল দিতে হলো, বেচারা!
তো বাসা থেকে বের হতেই এগারোটা।
ওয়াটারলু স্টেশনে গিয়ে টিকেট করে যখন পোর্টসমাউথের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠি সময় তখন সাড়ে বারোটা।
হীরাকে সবসময় সফি কিছু না কিছু বলে চেতাতে থাকে। ট্রেনে উঠার সময় হীরা সফিকে বলে, ' সফি ভাই ঘুরতে যাচ্ছি, অন্তত এখন না পচাইলে হয় না!' কিছুক্ষণ পরে দেখি ওরা দুজন হ্যান্ডশেক করে, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বলা চলে!
পোলাপান এমনিতে সবসময় কে কারে পচাইতে পারে সে প্রতিযোগীতা চলে! ট্রেনে উঠে ও কারো রেহাই নাই। টার্গেটটা হীরার দিকে বেশি থাকে বলেই কিনা সে বলে, 'শালা আমি হইলাম মন্দিরের ঘন্টা, সবাই আইসা ডং,টং করে বাজায়ে যায়!' ওর ডায়ালগটা আমাদের ঘুরাঘুরির অংশ হয়ে যায় বটে। কেউ কাউকে কিছু বললেই পাশের জন টং করে উঠে, মানে মন্দিরের ঘন্টা বাজলো।
একটু বেশি পচাইলে ডং, খুব বেশি হইলে ডং ডং করে পোলাপান বাজাইতেই থাকে! হা হা হা.....
যাইহোক, ঘুরাঘুরিতে ফিরে আসি। পোর্টসমাউথ হার্বার স্টেশনে পৌছাতে আমাদের প্রায় দুঘন্টার মতো লাগে। তারপর সেখান থেকে 'ফাস্টক্যাট' ফেরিতে করে বিশমিনিটে দ্বীপে পৌছালাম। ফেরি থেকে নেমে কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না, ততক্ষণে সবার হাতে ট্যুরিস্টদের মতোই ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুক। কোন হোটেল কিংবা গেস্ট হাউসে সাতজনের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
তো সবাই একেকটা হোটেলে ফোন করতে শুরু করি। কিন্তু একটাতে ও কোন ভ্যাকেন্সি নাই। এমনিতে এই সময়টাতে ওখানে ট্যুরিস্টদের ভিড় থাকে, তাছাড়া উইকএন্ডে 'কাউস ফেস্টিভ্যাল' নামে বোট রেসের একটা ফেস্টিভ্যাল আছে, যে কারণে নাকি প্রায় দশ হাজারের মতো বাড়তি ট্যুরিস্টের সমাগম হবে। সমস্যা তো বটেই! টেনশনে আমি বাদে সবাই তখন সিগারেট ফুঁকছে। আমি বললাম চল আগে তো টাউনে যাই, তারপর না হয় একেকটা হোটেলে গিয়ে কথা বলা যাবে! সেটা না হয় করাই যাবে কিন্তু তার আগে আমাদের ঠিক করতে হবে কোনদিকটায় যাবো।
'আইল অফ ওয়াইট' গাইডগুলোতে প্রধান এ্যট্রাকশনস এর ছবি, ম্যাপসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া ছিল, তো ওটা দেখে সবাই ঠিক করলাম 'স্যান্ডডাউন বিচে (স্যান্ডি বিচ) যাবো।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515738_8-Optimized[1].Emon_(9).JPG]
ফেরি থেকে নেমে।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515763_9-Optimized[1].Emon_(10).JPG]
মন্দিরের ঘন্টা হীরার সাথে। ব্রীজটা পার হলেই বড় টাউন 'রাইড'।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515632_5-Optimized[1].Emon_(4).jpg]
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515722_7-Optimized[1].Emon_(8).JPG]
'ফাস্টক্যাট' ফেরি।
রাইড, ফেরি থেকে নেমে যেখানটায় আমরা আটকে আছি সেখান থেকে বাসে করে সরাসরি বিচে যাওয়া যায়। পুরোদিনের ট্রাভেলকার্ড করতে খরচ পড়ে দশ পাউন্ডের মতো, যেখানে 'রাইড' থেকে বাস নিয়ে স্যান্ডডাউন যেতেই চার পাউন্ডের মতো লাগবে। সবাই ঠিক করি একদিনের ট্রাভেলকার্ডই করি ফেলি!
বাসে উঠার সময় ড্রাইভারকে সাতজনের টিকেট দিতে বললে সে আমাদের বাসে উঠতে বলে, ভাবলাম বাস ছাড়ার পরে হয়তো কেউ একজন এসে ভাড়া আদায় করবে! বাসে উঠেও কেউ টুকে নেওয়া হোটেলের নাম্বারে ফোন দিচ্ছে, আমি আইফোন থাকার সদ্ব্যবহার করতেই কিনা গুগলের সাহায্যে একেকটা হোটেলের নাম্বার নিয়ে ফোন দিচ্ছিলাম। কিন্তু একটাতে জায়গা পাচ্ছি না দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো। মুনতাকিম বলে, আমরা হোটেল না পেলে রাতে লন্ডনে ফিরে যাবো, শুনে দু-একজনের মন খারাপ হয়ে গেলে আমি বলি আরে দূর, দরকার হলে এখানে ঝোপে জঙ্গলে একরাত পার করে দেবো।
অনেক ইউরোপিয়ানদের ক্যাম্পিং করে ঝোপের আশে পাশে থাকতে দেখেছি। এটা কোন ব্যাপার না, ঘুরতে এসে না ঘুরে চলে যাবার পক্ষপাতি আমি নই।
ততক্ষণে আমরা গন্তব্যস্থল স্যান্ডডাউন এ পৌছে যাই। মজার ব্যাপার হলো ভাড়া নিতে কেউ আসেনি! আমাদেরও আর ভাড়া দেওয়া হলো না। পকেট থেকে সত্তর পাউন্ড কম খরচ হতে চাইলে ক্ষতি কি!
বাস থেকে নেমেই বিচ দেখতে পেলাম।
আহ! সমুদ্র, কতদিন দেখি না। বিচ ঘেষে কক্সবাজারের মতোই অনেক হোটেল দেখে কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে একটাতে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা পেয়ে যায়, কিন্তু একরাতের জন্য যা গুণতে হবে সেটা শুনে একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে! আমি ওদের বলি চল, ওদিক থেকে ঘুরে আসি, এখানে তো জায়গা আছেই, আরেকটু কমে কোথাও পাওয়া না গেলে নাহয় এখানে উঠবো।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দুএক জায়গায় ফোন দিয়ে দেখি ঘটনা একই। হাটতে হাটতে হঠাৎ ছোট্ট অক্ষরে সাইনবোর্ডে 'গেস্টহাউস' লেখা চোখে পড়ে। দরজায় নক করতেই সত্তরের মতো বয়সি এক চাচা (দাদা হবার চান্সই বেশি!) বের হয়ে আসে।
যাইহোক, ঘটনা খুলে বললে চাচা আমাকে আগে রুম দেখে নিতে বলে। আমি দেখে অন্যদের দেখতে বলি। সবাই উঠার জন্য রাজী হই, রাসেল গিয়ে চাচাকে স্টুডেন্টের দোহাই দিয়ে তেইশ পাউন্ড থেকে বিশ পাউন্ডে রাজি করিয়ে ছাড়ে!
চাচার গেস্টহাউজ।
রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত হয়ে গেলে সবাই ব্যাগ প্যাক রেখে বিচে যেতে উদ্যত হই। অনেকদিন পরে সমুদ্রের দেখা পেলে যা হয়, দৌড় ঝাপ ইত্যাদি।
স্যান্ডডাউন নামে পরিচিত এই বিচ আয়তনে আমাদের কক্সবাজারের চেয়ে অনেক ছোট।
এটাই স্যান্ডডাউন বিচ।
পেডেল চালিত বোট এবং কায়াক(kayak) দেখে কেউ কেউ দৌড়ে ওদিকে ছুটে যাই। শহরে চার দেয়ালের সীমানায় বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা হঠাৎ গ্রামে গেলে যেমন ছুটোছুটি করে ঠিক আমরা ও বিচে গিয়ে যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম। সবার আগ্রহে দুটো কায়াক এবং একটি পেডেল চালিত বোট ভাড়া নিয়েছি।
সফি, মুনতাকিম, মাহিন পেডেলচালিত বোট দখলে নিয়ে নেয়। দুটো কায়াকের একটাতে রাসেল/ হীরা, অন্যটাতে আমার সাথে তুষার। তুষার সাতার পারে না দেখে আমি পড়ি মহা বিপদে! বৈঠা চালিয়ে একটু সামনে গেলেই তুষার পিছন থেকে চিল্লানো শুরু করে। দোস্ত আর যাইস না, আমি সাতার পারি না। আমি বলি তুই শালা সাতার পারস না তো কি হইছে, আমি তো আছি, চুপ থাক, শান্তি মতো কায়াক চালাইতে দে।
ওইদিকে রাসেল/ হীরা আমাদের পিছনে ফেলে অনেক দুরে চলে যাচ্ছে। আমি ওদের তাড়া করতে সামনে বসে সমানে বৈঠা মেরে যাচ্ছি আর এদিকে পিছনে বসা চিকেন হার্টেড ব্যাটা হাত পা গুটিয়ে বলে যাইতেছে, দোস্ত এবার ঘুরা, আর যাইস না।
কায়াক চালাতে রেডি হচ্ছে সফি, মাহিন, রাসেল।
কায়াক।
শেষমেষ আমি তুষারকে বলি তুই হীরার সাথে যা, আমি রাসেল একটাতে উঠি।
তারপর পার্টনার বদলিয়ে দু দলের মধ্যে একটা রেস ও দিয়েছিলাম, যেটাতে আমরা জয়ী হই, আমার সাথে তুষার থাকলে জীবনে জিততে পারতাম না। কায়াক চালিয়ে হাত পা ভালোই ব্যথা হয়ে গেছিলো। ততক্ষণে ভিজে সবার অবস্থা কাহিল, সন্ধ্যার দিকে হালকা বাতাসে ভেজা শরীরে ঠান্ডা পাচ্ছিলো দেখে একজন গেস্টহাউসে ফিরে যাবার কথা বলতেই সবাই রাজী হই। এই ট্রিপে একটা মজার ব্যাপার ছিল, কেউ কিছু বললেই সাথে সাথে অন্যরা বলে চল,চল; কোন বিরোধী দল ছিল না যে না বলবে!
থ্রি ইডিয়টস।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515989_14-Optimized[1].Emon_(15).JPG]
মডেল হইতাম চাই।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249516036_15-Optimized[1].Emon_(16).JPG]
কফি খেতে খেতে বিচ উপভোগ করা।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249516182_16-Optimized[1].Emon_(17).JPG]
ফাজিল পোলাপান। যেখানেই যাই এটা একটা পোজ হয়ে গেছে।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515974_13-Optimized[1].Emon_(12).JPG]
ফ্যামিলি ফটুক।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515698_6-Optimized[1].Emon_(7).jpg]
ভাবুক মন।
হি হি...
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/metalfreakblog_1249515615_4-Optimized[1].Emon_(3).jpg]
ক্লিক ক্লিক, ক্যামেরার ঝলকানি!
তো গেস্টহাউসে ফিরে সবাই কাপড়চোপড় চেন্জ করে ইংলিশদের ট্রাডিশনাল 'ফিশ এন্ড চিপস' খেতে বেরোয়। বিচ থেকে দুরে একটা শাদা পাহাড় দেখেছিলাম, খাওয়া সেরে বিচের পাড় ঘেষে সবাই হাটতে হাটতে ওদিকে যাই। 'আইল অফ ওয়াইট' এ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ে। আরেকটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম; আমাদের বয়সি ছেলেমেয়ে খুব একটা চোখে পড়ে না।
( লিখতে বসলে আমি কেন জানি অল্প লিখতে পারি না।
একদিনের কাহিনী লিখেই দেখি অনেক বড় হয়ে গেছে, লেখার পরে মুছে দিতে ও মায়া লাগে, তাই ভাবলাম দুপর্বে পোষ্টাবো। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।