বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ অনেক অনেক দিন আগের কথা । রাশিয়ার এক গ্রামে থাকত এক বুড়ি। সেই গ্রামের পিছনে ছিল গভীর এক বন।
সেই বনে কত যে বেরি (এক ধরনের ফল) আর মাশরুম, মানে, ব্যাঙের ছাতা ...। জান তো, ব্যাঙের ছাতা কিন্তু খাওয়া যায় ...যাই হোক। সেই বনে ছিল বড় একটা ভালুক। ভালুকটা দুষ্টু কিনা? না, তেমন দুষ্টু না। তবে বনের ভিতরে একটা কুঁড়েঘরে থাকত সেই ভালুকটা ।
আর সেই কুঁড়ে ঘরে ছিল একটা জানালা আর জানলার পাশে ছিল একটা বেঞ্চ ...
তো, সেই গ্রামের বুড়ির ছিল এক নাতনি। সেই নাতনির নাম মাশা। মাশা কিন্তু ভারি বুদ্ধিমতী ছিল । কেমন বুদ্ধিমতী? এই গল্পটা পড়লেই তবে বুঝতে পারবে মাশার মাথায় কত বুদ্ধি ধরত!
মাশাদের গ্রামটা ছিল ভারি সুন্দর। সেই গ্রামে মাশার অনেক বন্ধু ছিল।
একদিন। সক্কাল বেলায় ঝরঝরে রোদ উঠেছে। চারিদিকে আলোয়-আলোয় ভরে উঠেছে। সেই আলোয় কত যে প্রজাপতি উড়ছিল। মাশার বন্ধুরা ঠিক করল যে ওরা বনে যাবে ।
বেরি আর মাশরুম তুলতে ।
একজন বলল, আমরা বনে যাব। মাশাকে কি নেব না আমাদের সঙ্গে ?
সবাই হইহই করে বলল, নেব। নেব।
তাহলে চল মাশাদের বাড়ি যাই।
তাই চল।
মাশার বন্ধুরা সব দলবেঁধে মাশাদের বাড়ি এল ।
এসে কড়া নাড়তে লাগল। আর বলতে লাগল, মাশা, মাশা দরজা খোল। আমরা যে বনে যাচ্ছি।
বেরি ফল কুড়োতে আর মাশরুম তুলতে।
ঝট করে মাশা দরজা খুলল। তারপর বড় বড় চোখ মেলে বলল, তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তুমিও আমাদের সঙ্গে চল না মাশা। মাশার বন্ধুরা বলল।
মাশার নানু রান্নাঘরে ছিলেন। গাজর সেদ্ধ করছিলেন। মাশা আবার গাজর সেদ্ধ খেতে ভালোবাসে কিনা। মাশা ওর নানুর কাছে গিয়ে বলল, নানু, নানু। আমি কি আমার বন্ধুদের সঙ্গে বনে যেতে পারি?
মাশার নানু কাঠের হাতা দিয়ে গাজর নাড়তে-নাড়তে বললেন, ঠিক আছে যাও।
তবে সবার সাথেই থেকো। কখনও বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা হয়ো না। তাহলে কিন্তু হারিয়ে যাবে।
আচ্ছা। আমি কখনও বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা হব না।
আচ্ছা তাহলে যাও এখন। বলে মাশার নানু মাশাকে বড় একটা ঝুড়ি দিলেন। কেন দিলেন? নইলে বেরি আর মাশরুম কোথায় রাখবে মাশা?
মাশা ওর বন্ধুদের সঙ্গে বনে এল।
বনের গাছে-গাছে কত যে পাখি ডাকছিল। গাছের তলায় ছায়া-ছায়া হলেও আকাশ থেকে হলুদ রোদ ঝরে ঝরে পড়ছিল ডালপালার ফাঁক দিয়ে।
বনের বাতাসও ছিল ভারি মধুর। অনেক ক্ষণ ধরে বেরি কুড়ালো আর মাশরুম তুলল মাশা। ঝোপ থেকে ঝোপে। গাছ থেকে গাছে।
মাশার বড় ঝুড়িটা ভরে গেল বেরিতে আর ব্যাঙের ছাতায়।
বনের ভিতরে মনোরম হলুদ রোদের ভিতরে উড়ছিল হলদে রঙের প্রজাপতির দল । মাশার আবার হলুদ রঙের প্রজাপতি ভালো লাগে কিনা। মাশা আজ কী মনে করে প্রজাপতি ছুঁতে চাইল। প্রজাপতির দলের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু প্রজাপতি ছোঁওয়া কি অত সহজ? পাজি প্রজাপতিগুলি উড়ে-উড়ে নেচে-নেচে মাশাকে বোকা বানিয়ে এদিক-ওদিক কোথায় যে পালিয়ে গেল।
আর মাশাও প্রজাপতির পিছন-পিছন দৌড়াতে-দৌড়াতে কখন যে ওর বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেল ...
হায়! মাশা ঘোর বনের মধ্যে একা হয়ে গেল। সেটা বুঝতে পেরে মাশা ভয়ে চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকতে লাগল । অনেক ক্ষণ ধরে ডাকল। ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু, কেউই সাড়া দিল না।
যাঃ আমি হারিয়ে গেছি। এখন আমি কি করি। নানুর কথা ভেবে ভেবে মাশার অল্প অল্প কান্না পাচ্ছিল। ওর চোখের এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল একটি শুকনো বার্চ পাতার ওপর। হলদে প্রজাপতির ওপর ভারি রাগ হচ্ছিল মাশার।
হতচ্ছাড়া হলুদ প্রজাপতির দল! তোদের জন্যেই আমি এখন হারিয়ে গেলাম!
বনের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মাশা। গাছপালার ফাঁকে ছোট একটা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে । ওই কুঁড়েতে কারা থাকে? যারাই থাকুক - আমাকে নিশ্চয়ই আমার নানুর কাছে নিয়ে যেতে পারবে। এই ভেবে দ্রুত কুঁড়ের কাছে এসে দরজায় কড়া নাড়তে লাগল মাশা ।
এই যে শুনছেন, দরজাটা একটু খুলুন না।
কিন্তু, কেউই যে দরজা খুলল না। এখন কি হবে? মাশা খানিকটা হতাশ হয়ে
দরজাটা ঠেলল । একি! দরজা যে খোলা। অবাক হয়ে মাশা কুঁড়েঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। ঘরটা ছোটই।
আর মেঝেটা কাঠের । ঘরে তেমন চেয়ার-টেবিলও নেই। খালি জানলা কাছে একটা বেঞ্চ। ...হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। এটাই সেই বড় ভালুকটার কুঁড়ে ।
মাশা বেঞ্চের ওপর বসল। এদিক ওদিক তাকাল। পায়ের কাছে বেরি আর মাশরুম ভরতি ঝুড়ি রাখল। বেশ বড় ঝুড়ি। বইতে কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু মাশা ভাবতে লাগল, বনের ভিতরে এই কুঁড়েঘরে কে থাকে ...
মাশা যখন বেঞ্চিতে বসেছিল। ভালুকটা তখন কুঁড়েঘরের বাইরে ছিল। মানে বনের মধ্যে ভালুকটা ঘুরছিল। কেন ঘুরছিল? ভালুকটা মৌমাছির চাক খুঁজে বেড়াচ্ছিল। জান তো, ভালুকেরা আবার মধু খেতে খুব পছন্দ করে।
যাক। ভালুকটা এক সময় বড় একটা মধুর চাক নিয়ে কুঁড়েঘরে ফিরে এল। বেশ বড় সাইজের নাদুসনুদুস ভালুক। গায়ে কালো লোমে ভর্তি। মাশাকে বেঞ্চের ওপর বসে থাকতে দেখে ভারি খুশি হল।
ভালুক বলল, আহা। কি সুন্দর মেয়ে। কি নাম তোমার শুনি?
আমার নাম মা ... মা মাশা। ভালুক দেখে অবাক হয়ে আর কিছুটা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে মাশা বলল।
মাশা? বেশ নাম।
আর আমি হলাম ভালুক। বড় ভালুক। এইটে আমার কুঁড়ে। আমি এখানে থাকি।
ও।
ভালুক বলল, হুমম। আমি কিন্তু তোমাকে আর যেতে দিচ্ছি না।
মাশা ভয়ে ভয়ে বলল, তাহলে?
ভালুক বলল, তাহলে। তাহলে আমার একজন কাজের ঝি দরকার। আজ থেকে তুমি এই কুঁড়েতে থাকবে।
আমার জন্য রান্নাবান্না করবে। শোন, আমি কিন্তু আবার গাজর সেদ্ধ খেতে খুব ভালোবাসি। মাশা, তুমি গাজর সেদ্ধ করতে পারবে তো?
মাশা মাথা নাড়ল। ওর মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল।
ভালুক বলল, গুড।
আর রোজ দু-বেলা কুঁড়ের মেজে ঝাঁট দিবে। আর বোতলে মধু ভরে রাখবে। দেখ আবার, এক ফোঁটা মধুও যেন গড়িয়ে মেজেতে না পড়ে।
ভালুকের কথা শুনে মনে-মনে মাশার খুব কান্না পেল। ওর ভীষণ মন খারাপ হল।
কিন্তু কি আর করা। আমারই তো দোষ। তখন নানুর কথা শুনলাম না। এখন ওসব ভেবেই-বা কী লাভ। ভালুক আমাকে এখুনি ধরে খেয়ে ফেলল না এই তো অনেক।
এই ভেবে স্বস্তি পেল মাশা। আমাকে ধরে আস্ত খেয়েও তো ফেলতে পারত।
মাশা ভালুকের জন্য গাজর সেদ্ধ করতে লাগল।
প্রতিদিন ভালুক কুঁড়ের বাইরে যায়। যাওয়ার আগে মাশাকে বলে, কখনও কুঁড়ের বাইরে যাবে না কিন্তু।
যদি যাও তো তোমাকে ধরে কিন্তু আস্ত খেয়ে ফেলব।
শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যায় মাশা। আর ভাবতে থাকে ... এখান থেকে কী ভাবে পালিয়ে যাবে । চারিদিকে ঘন বন। বড় বড় গাছ।
কোন্ পথে গেলে গ্রামে ফেরা যাবে তা তো মাশা জানে না। নানু নিশ্চয় কাঁদছেন। সেদিন কত করে বললেন ... সবার সাথেই থেকো। কখনও আলাদা হয়ো না। তাহলে কিন্তু হারিয়ে যাবে।
ইস! নানুর কথা শুনলাম না। বড়দের কথা শুনতে হয়। নৈলে বিপদে পড়তে হয়। আর হতচ্ছাড়া হলুদ প্রজাপতি! তোদের জন্যেই তো আমার এখন বন্দিদশা!
আগেই বলেছি। মাশা ছিল ভারি বুদ্ধিমতী।
একদিন মাশা একটা বুদ্ধি আঁটল।
কি বুদ্ধি?
বলছি।
সকাল বেলায় ভালুক বনে গেল । তারপর একগাদা গাজর আর বড় একটা মধুর চাক নিয়ে দুপুরের আগে-আগে কুঁড়েতে ফিরে এল।
তখন মাশা বলল, ভালুক, ও ভালুক।
ভালুক বিরক্ত হয়ে বলল, কি হল তোমার আবার?
মাশা বলল, আমাকে একদিনের জন্য ছুটি দাও না।
কেন? কেন তোমায় ছুটি দেব? ভালুক জানতে চাইল।
মাশা বলল, আমি গ্রামে যেতে চাই।
ভালুক জানতে চাইল, কেন গ্রামে যেতে চাও?
মাশা বলল, গ্রামে আমার নানু থাকে। নানুর জন্য আমি কেক নিয়ে যাব।
ভালুক বলল, না, তোমার গ্রামে যাওয়া চলবে না!
কেন? মাশা জানতে চাইল। ওর চোখ ছলছল করছিল।
ভালুক বলল, বনের মধ্যে তুমি হারিয়ে যাবে। আমি তোমার নানুর কাছে কেক পৌঁছে দেব।
মাশা মুচকি হাসল।
এটাই সে চাইছিল। তখন বললাম না যে মাশা ছিল ভারি বুদ্ধিমতী আর ও একটা বুদ্ধি আঁটছিল।
মাশা কেক বানাল। বড় একটা ঝুড়িতে কেক ভরে রাখল। তারপর ভালুককে বলল, ঝুড়িতে কেক আছে।
ওটা এখন আমার নানুর কাছে পৌঁছে দাও।
ঠিক আছে। ভালুক বলল।
মাশা বলল, ঝুড়ি কিন্তু খুলো না। আর কেকও কিন্তু খেও না।
আমি উঠানে বড় গাছে উঠে বসে থাকব। দেখব তুমি ঝুড়ি খুলে কেক খাও কিনা ।
ঠিক আছে । বলে ভালুক বৃষ্টি পড়ছে কিনা তাই দেখতে উঠানে এল।
ঠিক তখনই মাশা ঝুড়ির ভিতরে ঢুকে নিজেকে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিল।
চাদরের ওপরে কেক বিছিয়ে রাখল ।
ভালুক উঠান থেকে ফিরে এল। কাঁধে ঝুড়ি তুলে নিল। তারপর কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। বনের ভিতর দিয়ে অনেকটা পথ ।
হাঁটতে-হাঁটতে ভালুক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খিদে পেয়েছে। ভালুক বসে পড়ল । বসে বসে ভাবল, এখন একটা কেক খাব?
ঝুড়ির ভিতর থেকে মাশা বলল, ভালুক ও ভালুক। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি।
আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি । ভালুক তুমি বসো না। কেক কিন্তু খেও না। এখন তুমি নানুর কাছে যাও।
কি চোখ রে বাবা! ভালুক আপন মনে বলল।
তারপর উঠে দাঁড়াল । ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ভালুক আবার ভাবল, এখন অল্পখানি বিশ্রাম না-নিলে আমি ঠিকই মরে যাব। আর আমার খিদেও পেয়েছে। কেউ যখন দেখছে না তখন একটা কেক খেয়েই ফেলি না কেন।
ঠিক তখুনি ঝুড়ির ভিতর থেকে মাশা বলল, ভালুক ও ভালুক। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি । ভালুক তুমি বসো না। কেক কিন্তু খেও না।
এখন তুমি নানুর কাছে যাও।
ভালুক অবাক হয়ে ভাবল, কি চালাক মেয়ে রে বাবা! কত দূরে গাছের ওপর বসে আছে। আর সব ঠিকই দেখতে পাচ্ছে!
ভালুক উঠে দাঁড়াল।
তারপর জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। এক সময় গ্রামের কাছাকাছি চলে এল।
মাশার নানু বাড়ি খুঁজে বের করল। তারপর দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল। আর চেঁচিয়ে বলল, বুড়িমা দরজা খোল। দেখ, মাশা, তোমায় কি পাঠিয়েছে।
দরজা কেউ খুলল না।
তার বদলে গ্রামের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করতে করতে ভালুকের দিকে তেড়ে এল। ভালুক ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দরজার কাছে ঝুড়ি রেখে প্রাণ ভয়ে দৌড়তে লাগল। কুকুরগুলি ভালুককে বনের কিনার পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে গেল ।
মাশার নানু জানলা দিয়ে সব দেখছিলেন।
ভালুক পালিয়ে যাওয়ার পর বেড়িয়ে এলেন। দরজার কাছে ঝুড়ি দেখে ভাবলেন: কি আছে ঝুড়িতে ? তারপর ঝুড়ি খুলে মাশার নানু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না । ঝুড়ির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মাশা। মিটমিট করে হাসছিল। তারপর এক লাফে ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে এল মাশা।
নানু খুশিতে বুদ্ধিমতী নাতনিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলেন ...
অনুবাদ (কিংবা নতুন করে লেখা) ... তার উৎস:
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।