বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর বেশির ভাগ সৎ মায়েরাই বুঝি দজ্জাল প্রকৃতির হয়ে থাকে । যেমন কাতিয়ার সৎ মাটিও ছিল ভীষণ পাজি। তো, অনেক অনেক কাল আগে রাশিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামে কাতিয়ারা বাস করত ।
কিরা নামে কাতিয়ার এক সৎ বোন ছিল । কিরা ছিল ওর মায়ের চোখের মনি। কিরা যাই করুক না কেন- কিরার মা ঠিকই প্রশংসা করত। অথচ শান্ত শিষ্ট কাতিয়ার বেলায় ঠিক উলটো। কাতিয়ার সৎ মা আর সৎ বোন সারাদিন শুয়েবসে আরাম করত আর ভোর থেকে সংসারের হাজারটা কাজ কাতিয়াকে একাই করতে হত।
উঠতে- বসতে দুঃখিনী কাতিয়ার কপালে জুটত কেবল লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। কি আর করা? শীতের প্রান্তরে বাতাস বয়। সে বাতাস মাঝেমাঝে থেমেও যায়। কিন্তু কাতিয়ার দজ্জাল সৎমায়ের অকথ্য অত্যাচার যেন থামাতে জানে না!
যাই হোক। এক কনকনে শীতের দিনে কাতিয়ার সৎমা তার স্বামীকে বলল, শোন বুড়ো, তোমার মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও।
ওকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওকে তুমি তুষারের প্রান্তরে বনের ধারে ফেলে রেখে এস। যাও!
এই কথা শুনে কাতিয়ার বুড়ো বাপ বিষন্ন হল। কি আর করা। চোখের পানি মুছতে মুছতে বুড়ো কাতিয়াকে ঘোড়ায় টানা স্লেজগাড়ি তে তুলল।
কী শীত! নীল রঙের আকাশ থেকে তুষার ঝরছিল। বুড়োর ইচ্ছে হল কাতিয়াকে ভেড়ার পশমের তৈরি একখানি উষ্ণ চাদরে ঢেকে দিতে । তার যে উপায় নেই । বুড়োর দজ্জাল বউ জানালা দিয়ে সব দেখছে। হয়তো কিরাও দেখছে।
ধূ ধূ তুষারের প্রান্তরের বুক চিরে স্লেজগাড়ি চলছে।
দু পাশে দীর্ঘ দীর্ঘ পাইন আর ফার গাছ। দূরে শুভ্র তুষারে ঢাকা পাহাড়শ্রেণি । পাহাড়ের ঢাল অবধি বিস্তীর্ণ নির্জন প্রান্তরে তুষার আর তুষার।
কাতিয়াকে পাহাড়ের ঢালের কাছে একটা উচুঁ পাইন গাছের নীচে রেখে আবার স্লেজগাড়িতে উঠল বুড়ো ।
বুড়োটা ভালো বলেই মেয়ের মৃত্যু দেখার জন্য অপেক্ষা করল না।
শীতে জড়োসরো সঙ্গহীন কাতিয়া এদিক-ওদিক চাইল । ওর ভাঙা হৃদয়টি এখন ক্ষুধার্ত পাহাড়ি নেকড়ের পালের কথা ভেবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠল। তবে একেবারে নিরাশ না হয়ে ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করতে লাগল বিপন্ন মেয়েটি।
নিঃসঙ্গ প্রার্থনারত কাতিয়ার কাছে এলেন একজন প্রসন্ন চেহারার সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ ।
ইনি হলেন হিমপিতা - রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের তুষারের দেবতা । হিমপিতার পরনে পশমের শুভ্র পোশাক । মুখে সাধুসন্তদের মতো লম্বা দাড়ি; নাকটা অবশ্য ঈষৎ লালচে। আর হিমপিতার শুভ্র মস্তকে উজ্জ্বল একটি মুকুট। হিমপিতার হাতে একটি যাদুদন্ড।
হিমপিতা কাতিয়াকে প্রার্থনা করতে দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন । কিশোরী কাতিয়ার সোনালি চুল নিষ্পাপ মুখ আর সরল চোখ দেখে মুগ্ধ হলেন। তার হৃদয় গলে গেল।
কাতিয়া উঠে দাঁড়িয়ে ম্লানস্বরে বলল, স্বাগতম।
ধন্যবাদ।
হিমপিতা মাথা নাড়লেন। তার প্রসন্ন মুখে কৌতুকের হাসি ছড়াল ।
হিমপিতা অত্যন্ত নরম স্বরে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি আমায় চেন? আমি হলাম লালচে নাকের হিমপিতা। বলে হিমপিতা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলন।
হ্যাঁ, আমি আপনার কথা ছোট থাকতে আমার মায়ের কাছে শুনেছি ।
কাতিয়া অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল।
হিমপিতা সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন। তখন পাইন গাছের ডালপাতার জমাট বরফ কড়কড় শব্দ করে ভাঙছিল । আর সেই সঙ্গে প্রান্তরের বাতাসও হয়ে উঠছিল কনকনে ।
হিমপিতা জিগ্যেস করলেন, তোমার বুঝি খুব শীত করছে?
শীতে থরথর করে কাঁপলেও নরম স্বরে কাতিয়া বলল, না, আমার তো তেমন শীত করছে না।
এই কথা শুনে হিমপিতা ভারি খুশি হয়ে মাথা নাড়তে লাগলন। তিনি বিলক্ষণ জানেন যে শক্তসমর্থ মানুষও শীতে অত্যন্ত কাবু হয়ে ওঠে। আর মানুষের মধ্যে খুব কম মানুষই ভালো আর দয়ালু। তবে ভালো কি মন্দ -কোনও মানুষই তীব্র শীত একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কাজেই হিমপিতা কাতিয়ার উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন।
তিনি তার হাতের যাদুদন্ডটি একবার ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ওই যে দেখ।
কি! কাতিয়া তো রীতিমতো অবাক।
ওই যে ...
ওমাঃ। কাতিয়ার পায়ের কাছে শুভ্র তুষারের উপরে কি সুন্দর একটা ঝলমলে ট্রাঙ্ক পড়ে রয়েছে ।
ওটা খোলো। হিমপিতা নির্দেশ দিলেন।
কাতিয়া ট্রাঙ্ক খুলল। ওমাঃ। ট্রাঙ্কের ভিতরে কী সুন্দর-সুন্দর সব জিনিস।
কত রকমের মনিমুক্তো আর দামী দামী পোশাক। আর পালকের মতন হালকা কিন্তু মায়ের কোলের মতো উষ্ণ একটি লেপ ।
এসব তোমার। হিমপিতা বললেন।
কাতিয়া কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।
ওর ফ্যাকাশে মুখে রক্তিম আভা ছড়াল। সোনালি চুলে ঝরল শুভ্র তুষার। নীলাভ চোখে ঝরল আনন্দের অশ্রু। হিমপিতাকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেল কৃতজ্ঞ কাতিয়া । নিঃস্ব আর দুস্থ কাতিয়া হিমপিতার কৃপায় ধনী হয়ে গেল।
যা হোক। ট্রাঙ্কের ভিতরে ছিল রূপা আর মুক্তা বাসানো একটি নীল সারাফান (রুশ উপকথার মেয়েদের ঝুলপোশাক)। নীল সারাফানটি পরল কাতিয়া । কুমারী কাতিয়াকে কি সুন্দরীই না দেখাল ... যেন রুশ দেশের রাজকন্যা। কাতিয়ার রূপের অমলিন ছটায় আকাশের সূর্যও যেন ক্ষণিকের জন্য হেসে উঠল ।
ওদিকে কাতিয়ার সৎ মা রান্নাঘরে কেক বানাচ্ছিল। পরিবারে কারও মৃত্যু হলে পাড়া-প্রতিবেশি এবং গির্জের লোকদের ডেকে খাওয়ানো নিয়ম । চুলা থেকে কেক নামাতে নামাতে বুড়ি তার স্বামীকে বলল, যাও, এখন যাও কাতিয়ার মড়া নিয়ে এস।
কাতিয়াকে নিয়ে আসব? বুড়ো বিড়বিড় করে বলে।
আহ্ ! ওকে কবর দিতে হবে না? কিরা ধমক দিয়ে বলল।
বুড়ো দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।
বুড়ি মনে মনে বলল, পাজি কাতিয়া মরেছে। বেশ হয়েছে। আমায় কি জ্বালানোই- না জ্বালাত। কাতিয়া মরাতে এখন আমি বেশ শান্তিতে আছি।
অনেক ক্ষণ বাদে বুড়ির কানে গেল বাইরে কারা কথা বলছে। আর হাসছে। দরজা খুলে বুড়ি যা দেখল তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেল । নীল রঙের সারাফান পরে কাতিয়া দাঁড়িয়ে। কাতিয়াকে রাজকন্যার মতো সুখি আর আনন্দিত দেখাচ্ছে ।
কাতিয়ার পাশে কাতিয়ার বুড়ো বাপ ভারী ট্রাঙ্ক টানছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে ট্রাঙ্কের ভিতরে মূল্যবান জিনিসপত্র রয়েছে।
বুড়ি যা বোঝার বুঝল।
সৎবোনকে দেখে কিরার চোখ দুটিও ঈর্ষায় ধকধক করে জ্বলতে লাগল।
বুড়ি তার স্বামীকে বলল, স্লেজ গাড়িতে আবার ঘোড়া জুতে যেখান থেকে কাতিয়াকে নিয়ে এলে সেখানে আবার কিরাকে রেখে এস।
বুড়ো কিরাকে স্লেলগাড়িতে তুলল। তারপর নির্জন তুষার প্রান্তরে সেই উচুঁ পাইন গাছের নীচে কিরাকে একা রেখে ফিরে এল।
হিমপিতা কিরার কাছে এলেন। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বুঝি খুব শীত করছে?
এই বুড়ো! কে তুই! হিমপিতাকে দেখে কিরা চিৎকার করে উঠল।
আমি হিমপিতা।
কিরা ক্ষেপে উঠে বলল, যাঃ ভাগ! আমাকে একা থাকতে দে! দেখছিস না আমার হাতপা সব শীতে অবশ হয়ে আসছে!
গাছের ডালে তুষার করকর শব্দে ভাঙতে লাগল ...
হিমপিতা আবার একই প্রশ্ন করলেন, তোমার কি শীত করছে?
কিরা চেঁচিয়ে উঠল। বলল, আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ বুড়ো!
হিমপিতা এবার ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। সহসা প্রান্তরের তুষার তার শীতলতম রূপ ধারণ করল। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নীচে নেমে গেল। সেই তীব্র শীত সহ্য করতে না - পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল কিরা।
বুড়ি তার স্বামীকে বলল, যাও কিরাকে নিয়ে এস।
বুড়ো দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
আর শোন ট্রাঙ্ক আনতে ভুলো না যেন।
বুড়ো কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে স্লেজ হাঁকিয়ে রওনা দিল তুষার প্রান্তরের উদ্দেশে ।
অনেক ক্ষণ বাদে দরজায় শব্দ হল।
বুড়ি দ্রুত বেরিয়ে এল। তারপর বুড়োর কোলে কিরার নীলবর্ণের মৃতদেহ দেখে চিৎকার করে উঠল। পাগলের মতো কিরার নীল রঙের অবশ ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল আর চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অবশ্য তার কান্না কেউই শুনল না। কাঁদতে কাঁদতে বুড়ি বারবার বলতে লাগল, আমি আমার নিজের দোষেই আমার মেয়েকে হারালাম।
উৎসর্গ। লবঙ্গলতিকা।
রাশিয়ার লোককাহিনীটি যেখান থেকে অনুবাদ করলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।