আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি সার্বজনীন উৎসব:পহেলা বৈশাখ

বাংলা নববর্ষ উদযাপন। শহরের কৃত্তিমতা আর গ্রামীণ ঐতিহ্য মিলিয়ে বর্তমানে যা বাংলাদেশের একমাত্র অসাম্প্রাদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব। মোঘল আমল থেকেই বাঙ্গালি জাতি বাংলা বর্ষ বরণের এই উৎসবটিকে নিজেদের মতো উদযাপন করে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রূপদান করেছে। তা আজও পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এও সত্য যে, ধর্মীয় কোন বিধি নিষেধ না থাকলেও সত্যিকারভাবে এই উৎসবটি উদযাপনে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সাড়ম্বর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে কিছুটা সংকীর্ণতাও বেশ জোড়ালো ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছুকাল ধরে।

এদেশে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের উপস্থিতি সত্ত্বেও নববর্ষ উদযাপনে মৌলবাদিতার যে বাধা রয়েছে তা বাঙ্গালি সংস্কৃতির উত্তোরণের পথে যে একটা বড় রকমের বাধা তা বলাই যেতে পারে। অতচ এই ধরনের অনুষ্ঠান উদযাপনের মাধ্যমে প্রত্যেকটি দেশ তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলা উচিত জাতীয় নিজস্বতা বিশ্ব দরবারে হাজির করে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সহ কিছু উগ্র কনসার্ট ব্যতিত বাংলা নববর্ষ উদযাপনে কেবল হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো ব্যতীত অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকজনের সরাসরি সম্পৃক্ততা তেমন চোখে পড়ার মতো নয় এখনো। বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাংলা নববর্ষ উদযানে কোন প্রকার আয়োজন নেই বললেই চলে। এর দুটি কারণ থাকতে পারে- এক. খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা বৃহদাকারে ইংরেজি নববর্ষ পালন করে।

প্রাশ্চাত্যের দেশগুলোর ন্যায় তারাও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রায় জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষের অনুষ্ঠানে মতোয়ারা থাকে। এটা তাদের ধর্মীয় মৌসুম। অন্যদিকে, মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে করেন বাংলা নববর্ষ উদযাপন হলো একটি হিন্দু রীতি। এটা হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব তা-ও মনে করেন কেউ কেউ। আর এরকম চিন্তা করেও কেউ কেউ বাংলা বর্ষবরণকে অবহেলা করে কিংবা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু ভেবে দেখে না।

তাছাড়া, হিজরী নববর্ষকেও অনেক মুসলমান বাংলাদেশে সরবে উদযাপন করার প্রচেষ্ঠায় রয়েছেন। আস্তে আস্তে তা উদযাপিতও হচ্ছে। খ্রিস্টান মৌলবাদিরা এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কোন বাধা সৃষ্টি করেছে তা নয় কিন্তু বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সকল আয়োজন মুসলিম মৌলবাদিদের চরম বাধার শিকার তা বলতেই হয়। তাই প্রতিবছরই এই উৎসবটি উদযাপন নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন শ্রেণীর নিরাপত্তা বেষ্টনী যা উৎসবকে একপ্রকার রুটিন কার্যক্রমে পরিণত করছে দিন দিন। উগ্র মৌলবাদি চিন্তা দিয়ে প্রতি বছরই এই উৎসবটিকে সাম্প্রাদায়িকতার সিল মেরে রাখা হয়েছে; তাতে করে যে সরকারই এখন দেশ পরিচালনা করুক না কেন এখন বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানাদি কিংবা বলা সমীচিন পহেলা বৈশাখের দিনটি ভালয় ভালয় কেটে গেলেই যেন সকলে হাফ ছেড়ে বাঁচে।

এখানে এখন আর কোন উৎসব আমেজ নেই। এর প্রধান কারণ হলো পহেলা বৈশাখে রমনায় ছায়নটের অনুষ্ঠান সহ অন্যান্য সকল আয়োজনকে মুসলিম মৌলবাদি চক্র কোন ক্রমেই এদেশের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মেনে নিতে চায় না। একটি অসাম্প্রদায়িক-স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে এদেশের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গঠনে পহেলা বৈশাখকে তাদের বাধার শিকার হতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু বাঙ্গালি জাতির কাছে পহেলা বৈশাখের উৎসব বা তাৎপর্য কোন ক্রমেই অন্যকোন বর্ষবরণের চেয়ে কম নয়। এদেশে ইংরেজি বা হিজরী নববর্ষ যেভাবে পালিত হয় তার চেয়েও বেশী উত্তেজনা নিয়ে বাংলা নববর্ষ পালিত হবে বাঙ্গালি হিসেবে তা-ই সকলের কামনা হওয়া উচিত।

দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়; এই উপমহাদেশে যাদের আবির্ভাব মুসলমানেরও পূর্বে। তখন সকল কর্তত্ব-ক্ষমতা ও জমিদারিত্ব ছিল তাদের কাছেই। তাই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সাথে তাদের ধর্মীয় ভাবধারাও জড়িত হয়ে গেছে। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই হোক বা জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকেই হোকনা কেন, পহেলা বৈশাখকে কিন্তু তারা সাধ্যমত উদযাপন করেই চলেছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের নববর্ষ উদযাপনের একটি চিত্র দেওয়া যেতে পারে- হালখাতা পহেলা বৈশাখের অন্যতম প্রধান আয়োজন।

বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে বাজারে নন্দনাল রায় এর দোকানের হালখাতার মিষ্টি না খেলে তো বৈশাখ উদযাপন সার্থকতাই পায় না। হিন্দু ব্যবসায়ীদের কাছে ভোক্তা বা গ্রাহক দেবতাতুল্য। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা দেবতা গণেশের যে ছবিটি রাখেন তা ভোক্তাদেরও সেই মর্যাদাই প্রদান করেন। তাই বছরের শুরুতেই দেবতাকে প্রসাদ দিয়েই তারা হিসাবের নতুন খাতা খুলেন। অনেকে আবার এভাবেও চিন্তা করেন যে সারা বছর যে বাকির লেনদেন হয়েছে তা মিটিয়ে নেবার জন্যই ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করেন।

তবে হালখাতা এখন আর হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছু কিছু অন্যধর্মীয় ব্যবসায়ীরাও আজকাল হালখাতার আয়োজন করে থাকেন। তাছাড়া বর্তমানে হিন্দু সামাজিক রীতিনীতিতে একটা বিষয় বেশ প্রতীষ্ঠা পেয়েছে তা হলো- ভাইকে ছাতু খাওয়ানো। হিন্দু বোনেরা চৈত্র সংক্রান্তির দিন চালের গুড়া বা গমের গুড়া দিয়ে ছাতু তৈরি করে বসে থাকে কখন তার আদরের লক্ষ্মী ভাইটি নতুন কাপড় নিয়ে আসবে আর অতি আদরে তার মুখে তুলে দেবে নিজের তৈরি ছাতু। ভাইটিকে ছাতু খাওয়ানোই ওই দিনের প্রধানতম কাজ।

এর আগে একটু অন্নও মুখে তোলা যাবে না। এ এক অভিনব প্রেম যেন ভাই বোনের। এসব নানান রীতিনীতি বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে যে আরো অলঙ্কৃত করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদেশে তৃতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলো খ্রিস্টান বা যিশু খ্রিস্টের অনুসারী। (ইতোমধ্যে প্রাচীন খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নেওয়া লোকেরাও যুক্ত হয়েছেন) সে হিসেবে বাংলাদেশে এখন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যাও কম নয়।

সম্প্রতি আদমশুমারীর প্রতিবেদন দেখলে তা আরো স্পষ্ট হতে পারে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কোন কর্মকান্ড চোখে পরে না। তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে যে এ দিনটিকে নিয়ে কোন আয়োজন করবেন সে বিষয়টি এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। তাদের মধ্যেও ধর্মীয় কিছু সংকীর্ণতার কাজ করতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে যে উচ্ছলতা এবং আয়োজন ও ভাবগাম্ভীর্যতা দেখা যায় বাংলা নববর্ষ সেখানে ম্রিয়মান।

যদিও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনেও ধর্মীয় কোন বিধান নেই। হতে পারে তারা চিন্তা করেন যীশু খ্রীস্টের জন্ম হয়েছে ইংরেজি সাল গণনার শুরু থেকেই। সে হিসেবে ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি হতে পারে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর যে বড়দিন। সে দিনটিকে আবার ধরে নেওয়া হয় যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে।

সেদিক থেকে দুটি দিনেরই তাৎপর্য সমানভাবে প্রদর্শন করার কোন যুক্তিকতা কতটুকু রয়েছে তা চিন্তার বিষয়। তবে ব্যক্তিগত ভাবে যে তারা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করেনা তা নয়। তা অনেকটা আয়োজনের চাকচিক্যতার বদৌলতেই। আজকাল বেশ সংখ্যক বিদেশী পর্যটকদেরও বৈশাখী মেলাতে উপস্থিত হতে দেখা যায়। পরবর্তী অংশটা হলো বৌদ্ধ।

২৫ বৈশাখ বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা থাকলেও পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাস দিয়ে একটি নতুন বছরের আগমন তাতে কোন দাগ কাটে না। উপজাতীয়দের বেশীর ভাগই বৌদ্ধের অনুসারী। তারা পুরাতন বর্ষকে বিদায় এবং নববর্ষকে বরণ করা উপলক্ষে ৪/৫দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অনুষ্ঠান বৈসাবি তাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। এ উপলক্ষ্যে বান্দরবানে ৫ দিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই উৎসবের মধ্যে দুইদিন জলখেলী বা মৈত্রী পানি খেলা অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও রয়েছে পিঠা তৈরি বালিখেলা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের বছরের শেষ তিনদিন এবং নতুন বছরের প্রথম ২ দিন বৈসাবীকে মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’, ম্রো সম্প্রদায় ‘চাংক্রান’, খেয়াং ও ঢাক সম্প্রদায় ‘সাংগ্রান’, খুমী সম্প্রদায় ‘সাংগ্রায়’, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় ‘বিজু’ এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈসু’ নামে বর্ষবরণ এবং বর্ষ বিদায় উৎসব পালন করে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে এদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান হয়ে আসলেও তা অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মেই আর কিঞ্চিৎ অংশ গ্রহণ করছে হিন্দু ও উপজাতীয়রা। তবে নতুন ধান উঠা এবং কৃষকের এক চিলতে হাসি নিয়ে বাঙ্গালি ঐতিহ্যের এই অন্যতম প্রধান একটি উৎসবের গুরুত্ব সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের অনুধাবন করা যথার্থ হয়ে উঠেছে। এটিই এদেশের একমাত্র উৎসব হতে পারে যাতে সকল ধর্মের মানুষ সানন্দে এক হয়ে যাবে এবং এক আনন্দে মত্ত হবে।

বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারের মধ্যে বা বার্ষিক ধর্মীয় কোন কর্মকাণ্ডে এই দিনটিকে নিয়ে নিতে পারেন ইচ্ছে করলে। যেভাবে ইংরেজি নববর্ষ বা Thirty First উদযাপন হয় ঠিক সেভাবেই আমাদের এই দেশ বাংলাদেশেও বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতে পারে। এতে করে সাম্প্রদায়িক ভাবে যে বিরোধ এখনো মানুষের মনে কাজ করছে তা অনেকাংশে কমে যাবে এমনকি বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাতে করে গড়ে উঠতে সহজ হবে অসাম্প্রদায়িক নতুন এক বাংলাদেশের ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.