ক.
দরজায় আলতো করে কড়া নাড়ার শব্দ। পশ্চিমের দেয়ালে সেঁটে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালাম - রাত ১১.৪২ মিনিট। মেয়েটি কিছুক্ষণ আগেই ‘গুট নাইট ’ জানিয়ে গেল। আবার কি বলতে চাই? আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ঘরের দক্ষিণ কোণ থেকে উত্তরের সীমানা যেন কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
পায়ের পাতা মেঝের সাথে থমকে থমকে যাচ্ছে। খুব কষ্ট করে দরজার কাছে পৌঁছলাম। ‘আবার দরজা খুলছ কেন? একটু আগেই না একবার খুললে!’- আমার স্ত্রী মশারি টাঙাতে টাঙাতে বলল। এমনি - আমি উত্তরে বললাম। দরজা খুলেই খানিকটা দূরে দেখি মা দাঁড়িয়ে।
ওহ, মা! কিছু বলবে?
‘আমি বোধহয়...!’
তুমি? কি মা ! কিছু কি হয়েছে?
মা অনেকক্ষণ কোন কথা বলে না।
‘না, কিছু না। ’ বলেই উল্টো দিকে পা বাড়ালো মা।
আমি দরজা লাগিয়ে দিলাম। ‘তোমার কি হয়েছে বলো তো?’- নীলু বলল।
ওহ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। ঘুমাতে যাওয়াটা ওর কাছে পার্টিতে যাওয়ার মতই। কম করেও একঘণ্টা ঘুমানোর প্রস্তুতি চলবে আয়নার সামনে। আমি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। প্রায়ই প্রতিদিনই।
আমার ঘুম ভাঙ্গে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে। খুবই অস্পষ্ট শব্দ, যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে বাস্তবে ভেসে আসছে। উঠে বসি। নীলু অঘোরে ঘুমুচ্ছে। মশারির বাইরে এসে চোখটা ভালো করে ডলে নিই।
ঘড়ির দিকে তাকই, রাত ১ টা ৬মিনিট। দক্ষিণের জানালা খোলা। বৃষ্টির ফোটার মত জোছনা পোকা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। নাকি বৃষ্টিই হচ্ছে, সোনালী বৃষ্টি? ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে ক্লান্তিহীন। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে শেয়াল।
মাঝরাতে পুরো শহরটা যেন পরিপূর্ণ গ্রাম বনে যায়! এই শহরটা কোন এক সময় গ্রাম ছিল, শেয়ালগুলো তখন থেকেই ডেকে আসছে। শেয়ালের ডাকের সাথে সাথে মাঝে মধ্যে আদিম মানুষেরও চিৎকার শোনা যায়- আনন্দ কিংবা বেদনার। আমি খুব আলতো করে দরজার দিকে পা বাড়াই। ঘরের ফার্নিচারগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিই। ঠিক জায়গাতেই আছে বোধহয়।
মাঝে মধ্যে ওদের ফিসফাস শব্দ আমার গভীর ঘুম ভেদ করে আমাকে সেই বাল্য কালের ভুবনে নিয়ে যায়। ওদের শব্দে আমি কদম ফুলের গন্ধ পাই।
মা? এখনো ঘুমোও নি ?
মা কোনও কথা বলেন না।
কিছু বলবে মা ?
‘না, বাবা। ’
তাহলে ? তোমার কি শরীর খারাপ?
‘আমি কি যেন একটা রেখে গিয়েছি?’
তুমি আবার কি রেখে গেলে?
‘চশমা? ’
চশমা তো তোমার চোখেই আছে!
‘ওহ! তাহলে অন্য কিছু।
মনে করতে পারছি না। ’
ভেতরে এসে দেখবে?
মা আর কোনও কথা না বলে ছায়ার মত নিঃশব্দে অন্যঘরের দিকে পা বাড়ায়।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। মা কখন চলে যায়, টের পাই না কিছুই।
নীলুর ডাকে চমকে উঠি।
‘কি হল? ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে কেন?’
এমনি। - আমি বিড়বিড় করে বলি।
দরজা বন্ধ করে বারান্দায় যায়। সিগারেট ধরাই। সিগারেট খাওয়াটা নীলু একদমই পছন্দ করে না।
ওর ধারনা আমি ওকে মাঝবয়সেই বিধবা করে ওপারের টিকিট কাটবো। সিগারেটের ধোয়া কুন্ডুলি পাকিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। একদল জোনাকি পোকা হন্তদন্ত হয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। একটি এসে বসে আমার বাম দিকের কলারের উপরে, কানের ঠিক ইঞ্চি তিনেক নিচে। হয়ত কিছু বলতে চাই আমাকে।
বলতে চাই নীলুর মত ওরও সিগারেটের ধোয়া অসহ্য লাগে। ও কিছুই বলে না। নিঃশব্দে জিরিয়ে নেই খানিকটা সময় তারপর আবার উড়ে যায় শূন্যে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আবারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিই, রাত ৩টা বেজে কয়েক মিনিট। বেশ বিরক্তের সাথে দরজার দিকে এগোই।
মা, তুমি? এখনো ঘুমাও নি?
‘ঘুম আসে না, বাবা। ’
‘তুমি ঘুমোওনি?’
আমার সকালে অফিস মা। ভোরে উঠতে হবে।
‘ওহ। ’
মা পিছন দিকে পা বাড়ায়। আমি এগিয়ে যায় খানিকটা। মা, তোমার কি শরীর খারাপ? কি হয়েছে তোমার?
‘আমি কি যেন পাচ্ছি না খুঁজে!’
কি, বলো মা? আমি তোমাকে খুঁজে দিচ্ছি।
‘ঠিক মনে করতে পারছি না, বাবা।
’
মা চলে যায়।
খ
আজ আমার ফিরতে বেশ রাত হয়। প্রায়ই রাত হয়ে যায়। গলির ভেতর বেশ খানিকটা হাটতে হল। আজ ঘুটঘুটে অন্ধকার।
বিদ্যুৎ নেই কিংবা থাকলেও আমি তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। মাঝে মধ্যে আমি বড় অন্ধকার দেখি চারপাশ। অন্ধকারে আমার বাড়ি খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হয়। মনে হয় গলির সবগুলো বাড়িতে নীলু ড্রেসিং টেবিলে বসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। পদক্ষেপ গুনে গুনে অগ্রসর হয়।
ঠিক মনে করতে পারি না, কতটা এগোলে আমি ঠিকানা খুঁজে পাবো। অন্ধকারের শাড়ি পড়ে প্রতিটা বাড়ি ঘোমটা দিয়ে দিব্যি বসে আছে। ঢুকে পড়ি একটাতে। নীলু ড্রেসিং টেবিলে বসে। নীলুই তো ? নীলুর মতই সবকিছু শুধু ঘরের ফার্নিচার গুলো একটু এলোমেলো।
ও ঘরে মা মিতুকে সেই কবেকার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। আমি ক্লান্ত। নীলুকে দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ি। আরও কি কি যেন দেখছিলাম। ঘুম ভাঙলো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।
আমি উঠে বসি। নীলু কিংবা নীলুর মত মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাত ১টা ২৫মি.। ঘড়িটা দেয়ালের উত্তর দিকে। কিংবা দক্ষিণের দেয়ালটাই উত্তর দিকে সরে গেছে।
দরজায় হাত দিতেই খুলে যায়। নীলু বোধহয় লক করতে ভুলে গিয়েছিল। এই ভুলটা ওর খুব বেশি হয় না। আজ হয়েছে। দরজার ওপাশে খাঁখা শূন্যতা।
মা ? - আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলি। কোথাও কেউ নেই। খুলতে দেরি হলে মা এভাবেই চলে যান। আমি দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ - প্রতিদিনকার মতই নিথর, নিশ্চুপ, শব্দহীন।
‘কি করছ ওখানে? এ্যনিথিং রং? ওই দুর্ঘটনার পর থেকে তোমার কি হয়েছে বলো তো?’- নীলার কথায় চমকে উঠি।
ও কিছু না। এমনি।
আমি বারান্দায় গিয়ে বসি। সিগারেট ধরাই। সিগারেটের আলো জোনাকি পোকার মত জ্বলে আর নেভে।
জোনাকি পোকাগুলো আজ এতক্ষণে বিশ্রামে গেছে। শেয়ালগুলো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা ডেকে চলেছে একটানা। ওরা ক্লান্ত হয়না সহজে। আরও একটা সিগারেট ধরাই।
বারান্দার সামনে একটা গাছ আছে, বৃক্ষ জাতিয়। আমি ওটার নাম জানি না। পৃথিবীর সমস্ত গাছ বলতে আমি এখন ওটাকেই বুঝি। যেমন নারী বলতে নীরা। গাছটি নিঃশ্বাস নেই বেশ জোরে জোরে।
অনেকটা মার মত করে। বাবাও এমন করে নিঃশ্বাস নিতো, মার মুখে শুনেছি। গাছটির ফাঁকফোঁকর দিয়ে খামচা খামচা আকাশ দেখা যায়। তারাগুলো মনে হয় গাছে ঝুলে আছে। আমি একবার মিতুকে বলেছিলাম - দেখ মা, আমাদের গাছটিতে কেমন তারা ধরেছে।
মিতু আমার মেয়ে। ওর জন্ম হওয়ার কথা ছিল এক অমাবস্যার রাতে। হয়নি। মিতু আবদার করে বলেছিল, ‘আমাকে একটা তারা পেড়ে দিবে, বাবা?’ আজ বিদঘুটে অন্ধকার-তারাগুলো কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। গলির মোড়ে একটা নেড়ি কুত্তা ঘেউ ঘেউ করছে কখন থেকেই।
অদৃশ্য চোরদের সন্ধান পেয়েছে বোধহয়। নাকি ওই সাবাড় করেছে সবগুলো তারা? আমার সিগারেট থেকে একখণ্ড আলো উড়ে গিয়ে গাছটির ডালে বসে - জ্বলে আর নেভে।
ঘুম ভেঙ্গে যায় কড়া নাড়ার শব্দে। জোনাকি পোকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মিতু ওর মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আমি আবার চেয়ারটিতে এসে বসলাম। আচ্ছা, মিতু কি আমাকে কখনো দেখতে পায়? আরও একবার কড়া নাড়ার শব্দ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।