স্বপ্ন ছুঁয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় আমি দাঁড়িয়ে আছি বাড়িটার সামনে। গেট বন্ধ। পিছনে ঠেলা ওয়ালা ঠেলা থামিয়ে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি করব বুঝতে পারছি না। দুবার গেট ঝাকালাম, কেউ খুলল না।
বাবা এখনো আসেন নি। তিনি আরো একটা ঠেলা নিয়ে আসছেন। সেখানে আমাদের সংসারের যাবতীয় অতি মূল্যবান সম্পত্তি। ফ্রীজ, টেলিভিশন সহ আরো কিছু। কাজেই বাবা দেরি করছেন।
বাবা বলে দিয়েছেন , এসেই নাকি দেখব গেট খোলা, সরাসরি মালপত্র বাসায় ঢুকানো শুরু করা যাবে। এখন তো দেখছি গেট খোলা থাকা তো দূরের কথা , ধাক্কানোর পর ও কেউ গেট খুলছে না! কি করব যখন বুঝছি না, তখনই বাবা রিকশায় আসলেন। পাশে ঠেলা। বাবার সাথে রুমু ও আছে। আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি দেখে বাবা বোধহয় একটু অবাক হলেন! কিছু না বলে নিজেই এসে বেল চাপলেন।
আর প্রায় সাথে সাথেই বয়স্ক একজন লোক গেট খুলে দিলেন। বোধহয় ইনিই বাড়ি ওয়ালা। “আরে আপনি চলে এসেছেন। আসুন আসুন”, হাসি মুখে বললে ভদ্রলোক। ইশ, বেল যে গেটের পাশে এরকম খুপড়ি জায়গায় লুকানো আছে তা আমার খেয়ালই হল না।
আমার দিকে তাকিয়ে , চাপা গলায় একবার গাধা বলে বাবা ভিতরে ঢুকে গেলেন। আসলে ঢাকা শহরের অন্যান্য ভাড়াটিয়ার মত নিয়মিত বাসা বদলানো কখনো আমাদের হয় নি। এর কারন আমাদের প্রাক্তন বাড়ী ওয়ালা রহমতউল্লাহ সাহেব। তার কাঁঠালবাগানের এক তলার বাড়িটায় আমরা ভাড়া ছিলাম প্রায় বছর পনের। ভদ্রলোক যথেষ্ঠ অদ্ভুত।
এত বছরে খুব কমই ভাড়া বাড়িয়েছেন। নিজে থাকতেন ধানমন্ডির বাড়ীতে। কিন্তু দিন বিশেক আগে হঠাৎ ই এসে তিনি বললেন, জায়গাটা তিনি ডেভলপারদের দিয়ে দিয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। বাবা শান্ত মানুষ, কিছুই বললেন না।
দিন দশেকের ভেতরই আমরা এখন এই বাড়ীতে। বাড়ীটার নাম বলতে পারছি না, কারন গেটে কোন নাম লেখা দেখিনি। দোতলা বাড়ি। একতলায় আমরা থাকব। দোতলায় থাকেন বাড়ীওয়ালা।
আপাতত এর বেশি কিছু জানি না। আমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল চলছে। এর ভেতর এই যন্ত্রনা। রুমু –মুমু দুইজনই বাড়িতে এসে মহাখুশি! এই বাড়িটা নাকি আগের টার চেয়ে অনেক ভালো! সামনে নাকি অনেকখানি জায়গা। অবশ্য রুমু-মুমুর এখন যেই বয়স সবই ভালো লাগার কথা ওদের! রুমু পড়ে ক্লাশ নাইনে।
মুমু ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ইতিমধ্যে সে প্রেমে পড়েছে বলেও মনে হচ্ছে। ইদানিং প্রায়ই তাকে কলেজে যাওয়ার সময় ভালোমত সাজগোজ করতে দেখা যাচ্ছে।
কোন নতুন জায়গায় এলে প্রথম সকালটা বেশ অদ্ভুত লাগে। ঘুম থেকে উঠেই কেমন যেন একটু অসহায় অসহায় লাগে।
মা কেরোসিন কুকার বসিয়ে নাস্তা বানাচ্ছেন। গ্যাস এর চুলায় হয়ত এখনো লাইন দেয় নি। বাবা, রুমু, মুমু ঘুমুচ্ছে এখনো। “মা তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দাও, পড়তে বসব”। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।
রাস্তার কোন শব্দ নেই, সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। ঢাকা শহরে দশ দিনের ভেতর এমন একটা বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য বাবাকে বিশেষ একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত!
নতুন বাড়িটায় এসে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আমি খেলাম সন্ধ্যার সময়। সারদিন পড়েছি। মনে হচ্ছে এখন মাথার ভেতর থার্মোডিনামক্সের সূত্র না মেনেই কোন ইঞ্জিন চলছে! তাই সামনের জায়গাটায় এসে একটু দাঁড়ালাম। কিন্তু পাশ ফিরতেই দেখলাম একটা মেয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! কোন মেয়ে যে এত কঠিনভাবে কারো দিকে তাকাতে পারে তা আমার জানা ছিল না! “বাবা , আপনাদের বলে দেয় নি যে সন্ধ্যার সময় এখানে আসা যাবে না? ”, মেয়েটা তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
মুহুর্তেই বুঝে গেলাম বাড়ীওয়ালার মেয়ে এটা। অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করে ঊঠল। কোনরকম কথা না বলেই সরাসরি বাসায় ঢুকে গেলাম। রাতে খেতে বসার সময়, রুমু জোরে জোরে বলল, “আজ ভাইয়া ঝাড়ি খেয়েছে, আমরা বারান্দা থেকে দেখেছি!”। মুমু হাসছে মুখ টিপে ! ইচ্ছে করল দুটোর মাথাই ফাটিয়ে দেই।
রাগটা ঝাড়লাম বাবার উপর। “তুমি একথা বলে দাও নি কেন আমাদের?”। “তুই এত রাগ করছিস কেন? তোকে তো আর মারে নি কেউ। এরকম হতেই পারে”, বাবার নির্লিপ্ততায় আমিই উলটো বোকা বনে গেলাম!
দিন সাতেক পরের কথা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
খালার বাসায় যেতে হবে,রিকশা খুজছি। হঠাত করেই আগমন বাড়ীওয়ালা কন্যার, আমার দিকেই সরাসরি এগিয়ে এল। চোখের দৃষ্টি আগের দিনের মত কঠিন না! “কি আজ কি বলবেন, গেটের সামনে দাঁড়ানো ও নিষেধ?”, আমার খোঁচাটা গায়েই মাখল না মেয়েটা! উপরন্তু আমাকে যা বলল , তা শুনে আমি পাথর হয়ে গেলাম। “মুমু বলল, সেদিন নাকি আমার বকা শুনে আপনি বাসায় গিয়ে কেঁদেছেন! আমি খুব স্যরি! আসলে সেদিন আমার মেজাজটা খুব খারাপ ছিল তো! আর ওই সময়ে আমি একটু একা হেঁটে বেড়াই”। আমার ইচ্ছে হল এখনি লাফ দিয়ে পাশের ড্রেনে পড়ি! মুমুটাকে আজ আমি দোতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলব , সেটা নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।
যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, “মুমু আপনার সাথে মজা করেছে”। “ও আচ্ছা, আমি তো ভাবলাম আপনি সত্যি কেঁদেছেন! সারাদিন নাকি পড়াশোনা করেন আপনি? এই ধরনের ছেলেগুলো তো একটু ভিতু আর ছিঁচকাদুনে টাইপের হয়! তাই আমি সত্যি ভাবলাম!”। আমি তখন শোকে পাথর না স্টেইনলেস স্টীল হয়ে গিয়েছি!
আপনি নাকি লেখালেখি করেন? পাশ থেকে প্রশ্নটা শুনেই চমকে তাকালাম। বসে আছি টি এস সি তে, ক্লাশ নেই এখন। পাশ ফিরে দেখলাম অরনীকে।
আমাদের বাড়ীওয়ালার মেয়ে। এতদিনে এই মেয়ের নাম জেনেছি, কোথায় পড়ে তাও শুনেছি। ঢাকা ভার্সিটিতে ইকোনোমিক্স এ পড়ে। আতঙ্ক বোধ করলাম! আজ না জানি কি বলতে এসেছে! “সেটা দিয়ে আপনার দরকার কি? যন্ত্রনা করবেন না”। বেশ ভাব নিয়ে কথাটা বলে ভাবলাম সেদিনের অন্তত একটা শোধ নেয়া গেল! “ না মানে আপনি কি কবিতা লিখেন? এখন তো আবার কবি আর কাকের সংখ্যা সমান!” কথাগুলো বলেই কিছুই হয় নি, এমন ভঙ্গীতে হেঁটে চলে গেল অরনী! আমি মনে মনে বললাম, “হলি কাউ!”
সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল।
গভীর ঘুম থেকেই টের পেলাম কে যেন আমার পিঠ খোচাচ্ছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলতেই মা বললেন, “হাসান একটা রিকশা ডেকে আন না। অরনীর পরীক্ষা আছে, বেচারির ভার্সিটিতে যেতে হবে। এই বৃষ্টিতে বেচারি বের হতে পারছে না। ওর বাবার জ্বর”।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে একটা রিকশা ডেকে আনলাম। “এত রেগে আছেন কেন? আপনার চেহারা তো এমনিতেই ভাল না। এখন তো আরো খারাপ দেখাচ্ছে!”,অরনী রিকশায় উঠতে উঠতে বলল! আমি কিছুই বললাম না, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম!
“আপনাকে যে আমি অসম্ভব রকম পছন্দ করে ফেলেছি এই ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন?”, এক লাইনের চিঠিটা পড়ে আমার মাথায় বাজ পড়ল! অরনী এই কাজ করতে পারে আমার আগেই ভাবা দরকার ছিল। আসলেই আমি গাধা। এই মেয়েকে এখন কিভাবে সামলাব।
অরনীদের বাসায় গেলাম সরাসরি। “তুমি আমাকে পছন্দ করতে পার, কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি না। আমার আরেকটা মেয়েকে পছন্দ”, কথাগুলো বলে যখন অরনীর দিকে তাকালাম, তখন দেখি সে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে হাসছে! “হাসান ভাই, আপনি ঠিকমত মিথ্যাও বলতে পারেন না!” কিছু বললাম না, তবে মেনে নিলাম , আমি আসলেই মিথ্যা বলতে পারি না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।