দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট এবং সুন্দর দেশ সিঙ্গাপুর। আমাদের দেশের কিছু লোক সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা তথা চিকিৎসার জন্য যায় অঢেল টাকা খরচ করে। কেননা, সিঙ্গাপুর নগরপ্রধান দেশ এবং নগরেই সবকিছু পাওয়া যায়। নগরকেন্দ্রিক সিঙ্গাপুর উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। নগর জীবন পল্লীজীবনের চেয়ে উন্নত না হলে তারা সারাদিন খামারে কাজ করে সন্ধ্যায় নগরে ফিরে আসতো না।
সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলা মায়ের কোলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্ভার থাকলেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে আজ আমরা সেগুলো উপেক্ষা করে পিতা-মাতার কাছ থেকে অনেক দূরে রূঢ় বাস্তবতাকে বরণ করে নগর জীবনে বাধ্য হয়েছি। কারন পিতা-মাতার অনায়াসলব্ধ স্নেহের দানে আজ আমাদের সকল প্রয়োজন মেটে না।
জনসংখ্যা বা বংশবৃদ্ধির কারনে জমিজমা ভাগ হতে হতে অনেকে আদিম পেশা কৃষি ত্যাগ করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। এ কারনে অনেকেই মমতাময়ী মায়ের ন্যায় গ্রামকে উপেক্ষা করে নগরবাসে বাধ্য হচ্ছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমতে কমতে দেশে এখন অনেক লোক ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।
গ্রামে ভূমিহীন মানুষের অবস্থা চাতক পাখির চেয়েও খারাপ বলা যায়। অপরদিকে শহরে অনেক লোক জমাজমি দালানকোঠা ছাড়াও যেনতেন উপায়ে দু’বেলা আহার জোটাবার ব্যবস্থা করতে পারছে। ঘর না থাকলেও রাস্তা বা স্টেশনে বেওয়ারিশের মত ঘুমাতে পারে।
একসময় অধিকাংশের গোলাভরা ধান ছিলো, পুকুর ভরা মাছ ছিলো, গোয়াল ভরা গরু ছিলো। গ্রাম ছিলো শান্তির নীড়।
এখন সে চিত্র একেবারেই বিরল। গ্রামে এখন অভাব, অভাব আর অভাব। অভাব যে কত রকমের তা বলে শেষ করা যাবে না। কাজের অভাব, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসার অভাব, নিরাপত্তার অভাব, সম্ভ্রমবোধের অভাব, ইত্যাকার নানা অভাবের কারনে গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরমূখী হচ্ছে। গতিময় পৃথিবীর সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে তাল রেখে এগিয়ে চলেছে নগর জীবন।
পল্লী জীবনে মানব সভ্যতার অনেক কিছুরই সংযোগ নেই।
প্রাচীনকালে আরব, ইরান, তুরান ইত্যাকার অনেক দেশের মহারথীগণ বাগদাদে এসে নিজেদের সাধনার সমৃদ্ধি ঘটান এবং বাগদাদকে তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগরীর খেতাব দান করেন। তাদের অনেকের জীবনের শেষ বছরগুলো কেটেছে বাগদাদে। কেননা ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছাত্র-শিক্ষক, রোগী ও চিকিৎসক সকলেরই প্রয়োজন মেটে শহরে। গ্রামে কেউ আছে কেউ নেই।
তাইতো সেখানে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। আমাদের গ্রামগুলোতে আধুনিকতার নোংরা কিছু বর্জ্য পৌঁছাতে পারলেও সভ্যতার সোনার কাঠি সেখানকার কোনো কুমারীর শয্যায় কেউ রাখেনি।
বিধাতার আশীর্বাদে গ্রাম পুষ্ট। মানুষ বিধাতাপ্রদত্ত বুদ্ধি এবং স্বীয় কৌশলে নগর সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে। ধীরে ধীরে নগরকে আধুনিক এবং অত্যাধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সবই মানুষের প্রয়োজনে এবং যুগের সাথে তাল রেখে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষের শুধু কোকিলের ডাক শুনে সময় কাটালে চলে না। প্রগতির পথে নব নব প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে জীবনমান উন্নত করাই যেখানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে পল্লী জননীর মেঠো পথে হাঁটার সুখ ভোগ করবার ফুরসৎ কোথায়?
অবোধ শিশুর কাছে মাতৃক্রোড় যেমন নিরাপদ আশ্রয়, শহরও ঠিক তেমনি ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল সকলের আশ্রয়স্থল আজ। এখানে কেউ শিখতে আসে, কেউ শেখাতে আসেন, কেউ কাজের খোঁজে, কেউ কাজ ফেলে সময় কাটাতে। কেউ বাণিজ্য করতে, কেউ খেলা করতে, কেউ খেলা দেখতে।
সবাই এখানে অবাধ বিচরণ করতে পারেন। শহরের অসংখ্য মানুষের ভীঁড়ে কে কার খবর রাখে? শহরে পরকে নিয়ে মাতামাতি করার সময় নেই। নিজের চরকায় তেল দিতেই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই হিমশিম খায়। এর ফলে অনেক লোকই এখানে ঝামেলাহীন জীবন উপভোগ করতে পারে। বর্তমানে গ্রামে যা কল্পনাও করা যায় না।
নগরপ্রধান জীবনের সুবিধার কথা বলে শেশ করা না গেলেও কিছু বলতেই হয়। মানুষের জীবন সবচেয়ে বড় যে প্রয়োজন শিক্ষা, তার জন্য সবাইকে শহরে আসতে হয়। কেননা বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো পাড়াগাঁয়ে গড়ে ওঠে না। বড় বড় হাসপাতাল, সরকারী-বেসরকারী দপ্তর সবই তো শহরে, কল কারখানা তথা মানুষে কর্মসংস্থানের যাবতীয় সুব্যবস্থা শহরেই একের পর এক গড়ে উঠেছে, দেশের নামকরা শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক সবাই নগরে বাস করেন। আমোদ-প্রমোদ, নাট্যশালা নানা রকম মিডিয়া সেণ্টার সবই নগরে।
নগর হচ্ছে ধনীর বিলাস-সাগর আর দরিদ্রের কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। এখানে কেউ ফেরেনা খালি হাতে। শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকেরা আজকাল বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে দেখি শহরেই বসবাস শুরু করেছেন।
এককালে যারা শহরের কোলাহলকে অসহ্য মনে করে গ্রামের শ্যামলীমায় অবগাহণের দাওয়াত দিতেন, আজ তারাই শহরের কোণে ছোট্ট একটি বাড়ি বানিয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস শুরু করছেন। মাঝে মাঝে কুমীরে না কামড়িয়ে লেজ দিয়ে আঘাত করে।
সে আঘাত সবচেয়ে বড় প্রাণীকেও কাবু করে ফেলতে পারে। আমাদের গ্রামীণ কুম্ভীররা নিজেদের পেট ভরা থাকে বলে জলচর কুমীরের ন্যায় গ্রাস না করে লেজ দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। সে জ্বালা সইতে না পেরে মধ্যবিত্ত ভদ্র মানুষেরাও অনন্যোপায় হয়ে শহরে বসবাস শুরু করেছেন। নিজের খেয়ে নিজের পরেও গ্রামে ভালো থাকা যায় না। সেখানে হাসলেও দোষ, কাঁদলেও দোষ।
স্বচ্ছলতাও কেউ ভালো চোখে দেখে না, আবার অস্বচ্ছল হলেও কেউ পোছে না। এক কথায় গ্রাম ভদ্রজনের বসবাসের একপ্রকার অযোগ্য স্থানে পরিণত হয়েছে।
উপোরোক্ত এবম্বিধ কারনেই সিঙ্গাপুর সিটিকে মনে পড়ে। সেখানে সবাই দিনে কাজ করে এসে রাতে শান্তিতে ঘুমায়, কেউ কাউকে লেজ দিয়ে বাড়ি মারে না।
একটি নূতন বিষয়ের অবতারণা না করে পারছিনা।
পাবনার এক মানবদরদী বন্ধু অসহায় বয়স্ক মানুষদের জন্য একটি নিরাপদ বসবাসের স্থান করেছেন গাজীপুরের উপকণ্ঠে। এটিও কেনো শহরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠল? মিরপুর চিড়িয়াখানাও তো প্রকৃতির সন্তানদেরই, সেগুলো শহরে কেন স্থাপিত হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা আগেই পেয়েছি। কেউ দেখতে আসে, কেউ দেখাতে আসে। সবাই শহরে আসে, সবাই গ্রামে যায় না। কারন একটিই, গ্রামীণ জীবনের চেয়ে নগর জীবন অনেকটা স্বচ্ছল, গতিময়, ঝামেলাহীন এবং নিরাপদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।