অষ্টম শতাব্দি অর্থাৎ বায়েজিদ বোস্তামি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের বরেণ্য মানুষদের একটি জীবনী গ্রন্থ করতে গিয়ে আমি তাদের সম্পর্কে অবগত হই। প্রায় হাজার দুয়েক বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যদি শীর্ষ ১০ জনের তালিকা করা হয় সেখানে জামাল নজরুল ইসলাম থাকবেন। যদিও জামাল নজরুল ইসলাম একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব।
কিছুদিন থেকে চেষ্টা করছিলাম রাজনীতির ডামাঢোল থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু এরমধ্যেই এ বিখ্যাত মানুষটির মৃত্যু আমাকে অনেক বেশি ব্যথিত করেছে।
নিজকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এটার প্রধান কারণ জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের জন্য আমার বিবেক যা চেয়েছিল আমি তা করতে পারিনি। তার জন্য এদেশের কেউ দায়িত্ব পালন করেননি। যদিও তিনি দেশের টানে বিদেশের ঝকঝকে জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন।
হয়তো তিনি তার জীবনযাপন নিয়ে সšত্তুষ্ট ছিলেন।
তবে তিনি যথাযথভাবে মর্যাদা পাননি তার দেশের মানুষের কাছে। সেটা না পাবার কারণটুকু আমি আমার নিজের মত করে ব্যক্ত করছি।
কর্পোরেট দুনিয়া বলে পরিচিত এখানে কোন বরেণ্য ব্যক্তিকে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে না পারলে ওই মানুষটিকে কোন মূল্যায়ন করতে চাইনা কেউ। তাই মিডিয়া নির্ভর মানুষগুলোর রমরমা। আর মিডিয়াও যাকে দিয়ে সুবিধাজনক ব্যবসা ফাঁদতে পারে তাকে বা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
গণমাধ্যম বলতে যা বুঝায় তা তো আছেই। আর এখন নানা রকম মিডিয়া নানা সংজ্ঞায় আবির্ভূত হচ্ছে। এরা প্রত্যেকে মিলে কর্পোরেট কালচারে ব্যক্তির জ্ঞান কর্মকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিপণন করছে।
কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম স্যার দেশপ্রেমে ছিলেন অটল। আমরা যেমন দেশপ্রেমের কথা বলি তিনি ছিলেন তা থেকে আলাদা।
আমরা আমাদের কোটারি স্বার্থ রক্ষার জন্য বা নিজে খেয়ে বাঁচার জন্য দেশের অমঙ্গল হলেও মুখ কিছু বলতে চাই না। আর বড় ধরনের ধান্ধাবাজ হলে অন্যকে দেশপ্রেমের ছবক দেই। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম স্যার ছিলেন অন্যরকম মানুষ। নিজের দেশের স্বার্থ ছেড়ে তিনি কোন কথা বলেননি। এমনকি মুখের উপর জবাব দিয়েছেন।
দেশের স্বার্থটাই তার কাছে বড় ছিল।
বিভিন্ন সভা - সেমিনারে তিনি যখন অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখতেন তখন তাকে যে প্রতিষ্ঠান অতিথি করে নিয়ে যেতেন তার বক্তৃতার অনেক কথাবার্তা -মন্তব্য এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেত। এমনকি কোন পত্রিকার প্রোগ্রামে গিয়ে আমি তাকে পত্রিকার স্বার্থের বিরুদ্ধেও কথা বলতে দেখেছি। এনজিও সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামে গিয়ে তিনি বলতেন আমাদের ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মূলত দেশের স্বার্থে নয় বেশিরভাগ এনজিওওয়ালারা ব্যক্তিস্বার্থেই ব্যবসা করে।
বিভিন্ন এনজিওতে যারা দেশের প্রধান থাকতেন তাদের টাকা ইনকামের একটা উপায় ছিল এটা। জনকল্যাণ অনেক পরের নাটক। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের টার্গেট এনজিও ব্যবসায়িরা ছিলেন না। তিনি মনে করতেন সামগ্রিকভাবে এটা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। জনগণের প্রকৃত কল্যাণে নয়।
এভাবে চোখ বন্ধ করে কথা বলতে গিয়ে একজন বিখ্যাত মানুষ হিসাবে প্রথম প্রথম জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের মিডিয়াায় যে কদর ছিল সেটা কমতে থাকে। কারণ পত্রিকা ওয়ালারা এদেশে যে স্বার্থে পত্রিকা বের করে তার কথাবার্তা তাদের স্বার্থে ছিলনা। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতি হবার সম্ভাবনাই বাড়ত। এ কারণে পত্রিকাগুলো তাকে অনেকটাই এড়িয়ে গেছে।
আর জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে চেনার চোখও দরকার।
যাদের তাকে চেনার চোখ ছিল তারা প্রথমে প্রথমে স্যারকে ফোকাসে নিয়ে আসতে চাইলেও পরে তারা রণে ভঙ্গ দিয়েছে। কারণ জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে দিয়ে তারা যা বলাতে বা লেখাতে চাইবে তিনি তা লিখবেন না। অথবা তিনি তাদের স্বার্থের পক্ষে নন।
শুধু স্বার্থ ছাড়াও তুমি যত কুতুবই হও না কেন তোমার নিজের লেখা বা তোমার সম্পর্কিত কোন লেখা ছাপাতে হলে অন্তত আর কিছু না হোক পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের যথেষ্ট তেল মাখাতে হয়। এদেশে যারা পত্রিকায় লেখালেখি করে বা মিডিয়ায় কথা বলে তা বেশিরভাগই এই পদ্ধতিতে চলে।
আর ব্যক্তিকে যদি বেচার মত হয় তাহলে তো কথাই নেই। পত্রিকা তাকে চমৎকার পণ্য হিসেবে তার মেধা প্রজ্ঞা ও সুনামকে বাজারে বিপণন করে।
আমি এখানে প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে তুলনাটা নিয়ে আসতে পারি। তিনিও বিদেশ থেকে চলে আসেন দেশের টানে। এখন জাফর ইকবাল দেশে জনপ্রিয় লেখক এবং সুশীল নাগরিকও।
এখানে একটা বিষয় বলতে চাই জাফর ইকবাল স্যার নিজের মত প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিন সহজে ফোকাসে আসেন।
এমনকি মিডিয়ায় প্রচার পায়নি বলে চট্টগ্রামের লোকজনও জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের বিশাল মর্যাদাকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। তিনি সামাজিক সভা সেমিনারে যোগদান করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাকে প্রয়োজনীয় কোথাও ডাকা হয়নি।
মূল্যায়ন তিনি হতেন যদি মিডিয়ায় বেচাকেনার তালিকায় সুনাম কুড়াতে পারতেন। অথবা কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতেন। এই তো কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের কয়েকজন কৃতি ব্যক্তিকে পুরস্কার দিয়েছে গ্রামীণফোন আর দৈনিক পূর্বকোণ। যেখানে গাধা-ঘোড়া অনেকে আছেন। যা আমার কাছে চমৎকার হাস্যকর মনে হয়েছে।
জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের বাড়ি ফটিকছড়িতে। তবে আজ মিডিয়াগুলো তার সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এটা এড়িয়ে গেছে। তবে তার পূর্বপুরুষ সম্ভবত বাংলাদেশের নন।
জামাল নজরুল ইসলাম স্যার দেশপ্রেমের বাইরেও একটি বিষয় মেলাতে চাইতেন সেটা হল রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এক সভায় বলেছিলেন - সম্ভবত তার মা রবীন্দনাথের গোরা উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
এটা তিনি অনেক উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে তিনি বেশি রেফারেন্স টানতেন রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আবদুল্লাহকে(নামটা কিছু ভূল হতে পারে)। মূলত উর্দু ও বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো তিনি ব্যাপক পরিভ্রমণ করেছেন- এটা তার বক্তৃতা থেকে বোঝা যেত।
ধোপ- ধুরস্ত প্যান্ট শার্ট পরে শতভাগ দেশপ্রেমিক হওয়া কষ্ট। বড়জোর ভান করা যায়।
হয়ত এ কারণে তিনি ৭৪ বছর বয়সে চলে গেলেন। ৭৪ বছরে এমন একজন দেশপ্রেমিকের মৃত্যু মেনে নেয়া যায়না। আমার কাছে তার এমন মৃত্যু একটা অজুহাত মনে হয়। তাও চট্টগ্রামের একটি সাধারণ ক্লিনিকে এ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর চিকিৎসার জন্য স্থান হল। আমার কাছে অবহেলাই মনে হল।
কিন্তু আমি ক্ষমা প্রার্থি অন্য কারণে। গত বছর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসার পর দেখছি কাজের চাপ অনেক কম। আমার হাতে অনেক সময় পড়ে থাকে। ভালো একটা কাজের চিন্তা করে ভেবেছিলাম- জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের উপর ডকুমেন্টারি জাতীয় একটা কিছু করব। কিন্তু টাকা কোথায় পাব -টাকা কোথায় পাব এমন তড়পানিতে দ্রুত এগোয়নি।
তবে তিনি যে এত দ্রুত মারা যাবেন আমি চিন্তা করিনি। তবে একটা অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম তার স্বাস্থ্যটা অনেক ভেঙ্গে গেছে। আজ সারাদিন অনেক অপরাধী মনে হয়েছে নিজকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।