সকাল ৮ টায় ঘুম ভাঙ্গলো ক্লাস মনিটরের ফোন পেয়ে। মনিটর স্বাগ্রহে জানালো, আজ একটি মাত্র ক্লাস, দুপুর ৩ টায়। সকাল বেলাটা একেবারে ফ্রী, এজন্য কিছুটা খুশি হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাব। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই এক বন্ধুর ফোন, তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে যেতে হবে, কী যেন কাজ। তারাহুরা করে ১০ টার মধ্যেই ক্যাম্পাসে যেয়ে দেখি বন্ধুরা সব আড্ডা দিচ্ছে, বললাম কিরে, তোদের পড়ালেখা নাই, আমাকে হঠাত জরুরি তলব।
বন্ধুদের মধ্য থকে একজন বলল, নাহ পড়ালেখা করে কি আর হবে, চল আড্ডা দেই, তোরে ছাড়া আড্ডা জমে না। ওদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিলাম অনেক্ষন, অনেকদিন পর প্রাণখোলা হাসাহাসি আর ফাজলেমো করার পর দুপুর যখন সাড়ে ১২, ভিড় করলাম কবিরের টঙ্গে।
কবেরের টং একটা অসাধারণ জায়গা। চেনাজানা প্রচুর পোলাপান। আর কবিরের চা নাস্তাটাও ভাল।
কবিরের টঙ্গে যেতেই সেখানে বসে থাকা পোলাপান, সিনিয়র কি জুনিয়র সবাই ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পড়লো। ভাই কী খবর/ ভাইয়া ভাল আছেন/ কী অবস্থা ভাই/ বন্ধু চা খাও???? এইসব কোশল বিনিময়ের উত্তর দিতে দিতে শেষে বেঞ্চিতে বসে কবির কে বললাম, কবির ভাই এক প্লেট ফুল খিচুড়ি আর দুইটা আলুর চপ দাও। বলা মাত্রই কবিরের পরিবেশন। তারপর খিচুড়ি খাচ্ছি আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। হঠাত চোখ পড়ে গেল এক কোণায় বসা একটা মেয়ের দিকে।
কি আশ্চর্য, মেয়েটাও আজ আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অনেক্ষন চোখাচোখির পর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ, টের পেলাম ফোন বাজছে। বাসা থেকে ফোন, আমার বাবা জানালেন, এস, এ, পরিবহনে এ মাসের টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। খুশি হলাম।
দুপুর ২ টা, আস্তে আস্তে চার তলায় উঠলাম সবাই মিলে।
শুনলাম রেজাল্ট দিছে, বোর্ডে নজর দিতেই চোখে পড়লো B+ । খুব ভাল তা বলা যায় না। কারণ পরীক্ষা আরো ভাল দিয়েছিলাম, যাই হোক বেপার না।
ক্লাস শুরু ৩ টায়। বরাবরের মতই সামনের বেঞ্চে বসছি।
সিট রাখাই ছিল। আমার এক বান্ধবী, প্রতিদিন আমার জন্য জায়গা রাখে, ভাল মেয়ে। মনযোগ দিয়ে ক্লাস করলাম, ক্লাস করতে আমার ভালই লাগে।
শেষ দুপুরে মেসে ফিরলাম। তারপর গোসল শেষে আজকের পত্রিকাটা হাতে নিয়ে ভাত খেতে বসলাম, পেপার পড়তে পড়তে ভাত খাওয়া আমার বহু দিনের অভ্যাস।
যাই হোক, তাড়াতাড়ি করতে হবে, সন্ধ্যায় টিউশনি আছে, তারপর সাড়ে ৮ টায় কে কে আরের খেলা, আজ দেখতে হবে কারণ সাকিব খেলবে।
ইংলিশ মিডিয়ামের একটা স্টুডেন্ট পড়াই। ভাল স্টুডেন্ট, মাস শেষে বেতনও ভাল দেয়, সাড়ে ৩ হাজার। মাসের শেষ, তাই আজই সেলারিটা পেয়ে গেলাম, একদম গরম গরম।
টিউশনি থেকে ফিরে সুরমা গেটে নামতেই বন্ধুদের সাথে দেখা।
সেলারি পেয়েছি জেনেই বায়না ধরলো খাওয়াতে হবে। কি আর করা, সবাইকে একটা করে মাউন্টেন ডিউ আর চকলেট কেক খাওয়ালাম। সবাই খুশি, আমিও খুশি।
খেলা দেখতে বসছি, সাকিব বল করছে, ২ টা নিয়েছে কেবল আরো হয়ত পাবে। আই পি এলে কে কে আরের খেলাটা দেখে মজা পাই।
যাই হোক, ম্যাচ শেষ, সাকিব ৩ উইকেট আর ব্যাট হাতে ২০ রান করে ম্যান অফ দা ম্যাচ। বড্ড শান্তি পেলাম।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে পড়তে বসলাম। টানা ২ ঘন্টা পড়াশোনার পর ল্যাপটপ অন করে নেটে ঢুকে ফেইসবুক লগ ইন করে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম, সারাদিন ব্যস্ত থাকি, নেটে বসার সময়ই পাই না। এর মধ্যেই ফোন বেজে উঠল।
একটা মেয়ে আমাকে প্রতিদিন ফোন দেয়, ওর নাকি রাতে আমার সাথে কথা না বললে ঘুমই হয়না। তারপর ঘন্টাখানেক কথা বলে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম.। .। ।
এই হল সারাদিনের অঘোষিত রুটিন।
ভালই যাচ্ছে দিনকাল। কোন ট্যানশন নাই। সত্যি জীবনটা অনেক সুন্দর।
হুমমম, কিন্তু এতক্ষন যা বলেছি সবই ভুয়া। জীবনটা সত্যিই সুন্দর হত যদি এভাবেই সবকিছু হত।
কিন্তু সব কিছুই কী আর এত সহজ। তাহলে কেমন চলছে জীবন??? দেখা যাকঃ কী ভাল কী মন্দ !!!!
সকাল সাড়ে ৮ টায় বিরক্তিকর এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো, একেবারে কাঁচা ঘুম। ঘড়িতে এলার্ম দেওয়াই ছিল। একটিপে সাড়ে ৮ টা থেকে সাড়ে ৯ টা বানিয়ে দিয়ে আবার ঘুমালাম। ঠিক ঠিক ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসব।
পড়ালেখা ইদানিং একদমই হচ্ছে না। এই দিকে ২ টা থেকে ক্লাস। এরপর ঠন ঠন আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখি প্রায় ১ টা বাজে। ঘড়িতে কখন এলার্ম বেজে গেছে টেরই পাইনি। থতমত করে বিছানা থেকে উঠে কোনরকম মুখহাত ধুয়েই ছুটলাম, বাস ধরতে হবে।
অল্পের জন্য বাস মিস্। আসে পাশে কোন রিক্সাও দেখছিনা। কী করা, ক্লাসটাও মনে হয় গেল। পর পর কয়েকটা খালি রিক্সা যেতে দেখে সুধালাম, ড্রাইভার যাবেন? হ্যাও না নাও না। একেবারে মনে নাম জাদা বাদশা ।
অগত্যা ভাড়া বাড়িয়ে দেব বলে একটা ড্রাইভারকে রাজি করালাম, ক্যাম্পাসে যেতে ১০ মিনিট লাগলো। দৌড়ে উঠলাম চার তলায়, ক্লাসরুমে ঢুকতেই মনিটর জানালো ক্লাস হবে না, স্যার আসেন নাই। মেজাজটাই গেলো খারাপ হয়ে, ধাপঝাপ করে এলাম কোন লাভ হলোনা। আবার এর পরের ক্লাস ৪ টায়। এখন থাক বসে।
এদিকে একটা কোর্সের রেজাল্ট দিছে। এমনিতেই এই সেমিস্টারের রেজাল্ট ভাল না। কমতে কমতে একেবারে B ছুঁই ছুঁই। না জানি এইটাতে কী পেয়েছি !! বুকে ধরফরানি নিয়ে নোটিশ বোর্ডে তাকালাম। আবারো B-।
এক্কেরে গ্যাছে। কপালে বহুত খারাপি আছে। পড়াশোনার একেবারে যা তা অবস্থা।
বিষন্ন মন নিয়ে নিচে নামলাম, কবিরের টঙ্গে যেতে হবে, ক্ষিদায় প্যাট চুঁ চুঁ করছে। ইদানিং কবিরের টং টাও কেমন জানি হয়ে গেছে।
সবই অপরিচিত, আসলে সিনিয়র হয়ে যাওয়াতে আর ক্যাম্পাসে অনিয়মিত বলে নতুন পোলাপানদের সাথে ভাল পরিচয় নাই। তাই কাউরে আর চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না।
কবিরের টং কানায় কানায় ভর্তি, বসার জায়গা নেই। অবশেষে বেঞ্চে বসা একজনকে অনুরোধ করে বললাম, ভাই চাপেন, আমাকে একটু বসতে দ্যান। বিরক্ত হয়ে সে এক কোণা ছেড়ে দিল।
কবিরকে বললাম, ভাই হাফ খিচুড়ি আর একটু ছোলা দ্যাও। ব্যাস্ত কবির একসাথে কয়জনকে দিবে। তারপর অনেক ডাকাডাকির পর কবিরের খিচুড়ি হাতে পেলাম। কবির দিন দিন প্রফেশনাল হয়ে যাচ্ছে, আগে হাফ প্লেটেও অনেক দিত। যাই হোক, খিচুড়ি খেতে খেতেই চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে।
একসাথে ৫/৭ জন আড্ডায় মশগুল, এর মধ্যেই একজন। আমি একটু পর পর তাকাচ্ছি দেখেই বিরক্ত হয়ে উঠে গেলো।
চা খাচ্ছি আর ভাবছি, বন্ধুরা সব ব্যাস্ত, কেউ পড়ালেখা নিয়ে, কেউ পার্ট টাইম চাকুরি নিয়ে, কেউ আবার গার্ল ফ্র্যন্ড নিয়ে। আমি কারো খোঁজ নেই না, কেউ আমারেও না। একা একা উদাস হয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকি আর হা হুতাশ করি।
মোবাইলটা হাতে নিই, হুদাহুদি ব্যালেন্স দেখি আর পুরাতন ইনবক্স চেক করি। তারপর অপেরা মিনি, ফেইসবুক। বার বার ফেইসবুকে ঢ্যুঁ মারা একটা নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। কামে আকামে স্ট্যাটাস দেই।
ক্লাসের সময় হইছে কখন খেয়ালই করি নাই।
৪;১০ এ যেয়ে দেখি স্যার এখনো আসেন নাই তবে রুমে বসার কোন খালি সিট নাই। অবস্থা বেগতিক দেখে একেবারে পিছনে গিয়ে একটা হাই টেবিলে ব্যাগ রেখে আরেকটা টেবিলকে চেয়ার বানিয়ে কোনমতে বসলাম। স্যার এলেন, ১০ মিনিট ধরে নাম ডাকলেন। তারপরই শুরু হল বকবকানি। কি যে পড়ায় কিচ্ছু ভাল্লাগে না।
ধুর্, লিটারেচার একটা ফালতু জিনিষ। কেন যে ছাত্ররা এইটা পড়ে।
ক্লাস শেষ, বিকেল বেলা ক্যাম্পাসে কোন রিক্সা নাই। হাটা ধরলাম এক কিলো বরাবর। ভাল্লাগতাছে না, ভয়ানক বাথরুম চাপছে।
কানে হেডফোন দিলাম, সঞ্জিব দা গাইছেন, "অই কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না, থমকে থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না"। ধ্যাত্, মন খারাপের গান। সঞ্জিব দার গানও ইদানিং বিরক্ত লাগে।
তড়িঘড়ি করে মেসে ফিরে বাথরুমের দিকে গেলাম। বাথরুম খালি নাই, এদিকে আমার যায় যায় অবস্থা, মেসে থাকার এই একটা অসুবিধা।
বাথরুম, গোসল শেষে ভাত খাব, পেপারটাও পড়া হয় নাই। কিন্তু পেপারের কোন হদিস পেলাম না। কেউ একজন তার রূমে রেখে তালা দিয়ে বাইরে গেছে। দুপুর বেলার ভাত প্রায় সন্ধ্যায় খাচ্ছি, সবকিছু ঠান্ডা।
সন্ধ্যাটা একা একাই বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিলাম।
এইসময় কেউ বাসায় থাকে না। সবারই টিউশনি/ কোচিং অথবা অন্যান্ন কাজে ব্যাস্ততা থাকে। আর আমি লুথার মত বসে চার তলার বারান্দা থেকে নীচে দিয়ে কে যায় কে আসে তাইই শুধু দেখি।
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার পর রাতে আই পি এল দেখতে বসছি। কে কে আরের খেলা।
ভেবেছিলাম সাকিবরে হয়ত খেলাবে কিন্তু আজো বসিয়ে রাখলো। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো।
রাতে বাবার ফোন, জানালেন কাল টাকা পাঠাতে পারবেন না। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারেন নাই। এদিকে মাসের শেষে আমারও পকেট খালি।
কী যে হবে!!!!
তারপর আর কি, ল্যাপটপ নিয়ে অযথা ফেইসবুকে গুতাগুতি, যেন আর কোথাও যাওয়ার নাই।
রাত ১;৫০, ঘুম আসছে না। আবারো ল্যাপটপ বসলাম, একটা মুভি দেখতে হবে। মুভি শুরু করতেই ঘুম মাথাচারা দিয়ে উঠল। নাহ্, এবার ঘুমাতেই হবে।
শুয়ে পড়লাম, কিন্তু মশারি খাটানোর অভ্যাস ও ব্যাবস্থা নাই, তাই মশাদের হাত থেকে নিস্তারও নাই। এই প্যান প্যাঁনানিতে রাত প্রায় ভোর।
আবারো সকালে উঠতে হবে, এলার্ম দেওয়াই আছে। !!!!!!!
উপরের অংশটা কল্পিত, নিচেরটুকু বাস্তব। কল্পনা সবসময়ই মধুর আর বাস্তব বড় কঠিন।
!!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।