নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
বহু বছর আগের ঘটনা। সূর্য প্রতিদিনকার মতো সকালের আলো ঢালছিল। পুর্বদিকের বাড়ির দেয়ালে উঁকি দিয়ে বিস্মিত হয়ে গেল সে। বৈশাখী উৎসবের নীল দেয়াল। পাশা পাশি আঁকা আটটি ছবির প্রথমটি হল সূর্য।
নিজের বিকৃত আদল দেখে গলা বের করে হাঁক ছাড়ল সূর্য,
ঐ ছবির পো, ইডা কি আমার "সুরত" নাকি?
জি আপনার সুরত, সুরুজ কাকা। কিন্তুক অখন আর কথা কব না। ঘুম পাতিছে।
সূরুজের ছবি হয়িছিস, আর দিনের বেলায় ঘুম? ইতো আমাক অপমান! অপমান। তা ক দিকি কোন কারিগর ইডা আঁকিসে।
কাচা লাল শাকের রং । আমি কি নয়া বউ যে লাল রঙ ছাড়া গালে কিছু মাখতি নেই? আমার আলোর ভিত্রে যে সাতটা রঙ খেলা করতিছে, তাও কি পাটুয়ার বিটা জানে না?
আমারে জিগগেস কত্তিসো কি জন্যি, কাকা? - ছবিটা কৈফিয়ত এড়াতে চায়। বলে, যে পাটুয়া আঁকিছে তারে গিয়ে জিগ্গেস করলি হয়।
হুম! তাই করতি হবি। তুই যা ঘুমা।
ছবিটাকে চরম অবজ্ঞায় ফেরত পাঠায়। সূর্য সামনে পা বাড়ায়, এই উৎসবে কত জন কত কিছু আঁকে। তবুও তার চোখে সূর্যের আধলা ছবি ভেসে থাকল। কি শরম! বউ বউ সূর্য। মাথায় লিচুর খাঁজের মত চুলের কাঁটা।
তাইলে কি সূর্য কি পুরুষ না? এ কোন মুল্লুকের পাটুয়া? - মনে মনে বলল সূর্য, তা কপালে সোহাগে ল্যাপটানো টিপই আঁকার কি দরকার ছিল? বাউলের ঘরে নতুন বউ। পাড়ায় ঢোল বাজে মাদল বাজে। এই জন্যি কি সব ভুলি এই ছবি? শুনিছি, অতি দূর জার্মানীর দেশে সুরুজকে কয় মহিলা, আর চাঁদকে পুরুষ।
ঠিক এমন সময় দেওয়ালের দ্বিতীয় ছবিটা টং টং মিহি আওয়াজ তুলল। বলল, মামা, ও মামা আমি একতারা, খেপিছ নাকি?
একতারা নাবালক, এ খেপাখেপির কি বুঝবি, বলতে চাইল সূর্য।
কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করল। না, খেপতি যাব কোন দুখে? আচ্ছা শুনতি পালাম জোয়ান বাউল বলে নিকা করিছে?
হয়ে তো করিছে বহু আগে। আপনি কি জানতি পারিছেন কি আজ? -বলল একতারা।
হ, আজ। তা কোন গিরামের মাইয়ে? নিশ্চিত হয়ে সূর্য বলল, এজন্যিই তো কই শরিষার খেতে গলা ছাড়ি গান শুনতি পাই নে ক্যান।
সূর্য কৌতুহলী হয়ে বলল, আচ্ছা, বাউলডা কি চুল-মোচ কি কাটি সাফ সুতরা হয়ি গেছে? কেমন লাগতিছিল তারে? আহহারে বড় কি উস্কা খুস্কা চুলি করিছিল ছোয়ালডা। গান কি গায় না?
সূর্যের কথাগুলো শুনে একতারার আগ্রহ বাড়ে। গলায় দু:খটা না ঢেকে সে বলল, না, মামা, বাউল অখন শ্যাষ। আমারে তারকাটা দিয়ি ঝুলায়ি রাখিছে মেমানের ঘরের ভিতরে। আমাক ছাড়া তার ঘুম আসতি না, অখন মাসে একটি বারও আমাক দেখতি তার মন চায় না।
বউয়ের জন্যি সব পিরিতি বান্ধা। মোচ নারিকেল তেলে করি পাক দিসে, পরিপাটি সেই রূপ। চিনতি পারিবে না। আউলা কেশদাম নীল পাগড়ীর ভিতরে ঢুকি আছে। সর্বনাশের মূলে সেই নারী!
তা তুমি কি নারীর দিকে গোস্বা করিছ নাকি, সূর্য খোঁচা দেয়।
গল্প করার বিষয় পেয়ে মাঝ গগনে জেঁকে বসে বলল, তা বউডা কোন গিরামের নারী?
অচিনতরু। বহু ক্রোশ দূর কামাখ্যার অঞ্চল। সবুজ বৃক্ষে ফলের গন্ধ মৌ মৌ করে। পাখি উড়ি যায় খালের উপর দিয়ে। বাউল আমারে নিয়ে গেছিল আগুন মাসে, বৈতালী গান গাতি।
আসমানে মেঘ ভাসতিসিলো। সেই মেঘে মেঘে বাউল দেওয়ানা হয়িছিল রূপবতী নারীর দর্শনে।
সূর্য একতারার দু:খ বুঝে হেসে বলল, একতারা, এইডে মানুষির নিয়তি, যৌবনে সব মানবই বাউল । পর্বতে জঙ্গলে একাকী গান গাতি থাকে। একদিন সংসার আসি বাঁধি ফেলে তারে।
সন্তান পরিজন এই নিয়মে বাউলত্বের সাঙ্গ হয়।
***
একতারা পুরুষ না, নারীও না। সে সঙ্গীতের যন্ত্র। বাউল তাকে ভাল বাসতো। এটা তার স্মৃতির গহনে।
একদিন এই বাঁশের, গরুর পর্দায়, তারের শিরায় কবিগানের আসর শুরু হতো, হাজার দর্শকের বুকে তার সুর বিঁধে যেত। মন মানে না। কুপির অন্ধকারে মিঠা বোল শুনতে পায়, হি হি হি কণ্ঠ খেলে গভীর নিশীথ অব্দি। পিরিত পিরিত খেলার অর্থ বোঝে না। ছয়টি মাস সঙ্গীত ভুলে গেছে গাতক।
দাওয়ার বাতাসে সুর নাই, ঘুঘু বসে না, চালের খড় খসে পড়ে, রূপবতী জোছনা ঢেলে ব্যর্থ মনে চলে যায় চাঁদ। বৈশাখে-বর্ষায়, গ্রীষ্মে-বাদলে কাৎ হয়ে ঝুলে থাকে একতারা।
মাঝে মাঝে দরজা খোলা রেখে দেয়, দেখে, সুতী কাপড়ে বধূ। স্বামীর উদাম পিঠে হাত পাখার বাতাস করছে, কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে সুখের যন্ত্রনা উপভোগ করছে বাউল।
সূর্যও ব্যস্ত থাকে, গভীর নিশিথে পেঁচা ডাকে।
ঝিঝির শব্দে ঢেকে যায় একতারার দীর্ঘশ্বাস।
***
তারপর বহুদিন পর এক দিবাগত রাত। বাউল ও তার বউয়ের মধ্যে ভীষণ কলহের সূচনা হয়। বাউল "হাউশ" করে চিতল মাছ কিনে এনেছিল হাট থেকে। বিরাট তার পেটি।
সেই মাছ রাঁধতে বিলম্ব হয় বধূর। আর তাতে পচন ধরে বাতাস আউলায়।
একতারা শুনতে পায় কর্কষ বাদানুবাদ! অট্টহাসি ছলকে পড়ে একতারার কণ্ঠে। ইচ্ছা হয় একাকী তারের পায়ে বাতাসের ঘুঙুর পরে নৃত্য করে। অভিশাপ দেয়।
কিছুক্ষণ পর একটি নারী দেহ ছোটঘরের বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। একতারা দেখল দু:খিনী রমনী, ভাঙা তার মুখ। কাজল টানা চোখে শ্রাবনের বৃষ্টি। একী চেহারা রমনীর! নুয়ে দেখে কিছুক্ষণ আগের আট্টহাসির জন্য অনুতপ্ত হল সে। সঙ্গীতযন্ত্র সে, মানুষের মন ভাল করা তার ধর্ম।
রমনী ফুঁপায়,
ঘর ছাড়ি, কুল ছাড়ি, ধর্ম ধরি সোয়ামীর ভাতে
সামান্য ভ্রমে পতি দংশিলা সর্পের বিষ দাঁতে
দুর দেশে তার পিতা মাতা, তার ভাই। একতারার বুক ভাবে।
তুমি কাইন্দো না বউ, আমিও এতিম নিমের একতারা। আমারও কেউ নাই ত্রিভূবনে।
ঠিক এমন সময় বাউল ছোট ঘরে ঢোকে।
দুর গ্রামে সে বিদায় দিয়ে চলে যেতে চায় আজ। একলা বুকের দহন মিটাবে। রাঙা বউকে দেখে তার থমকায়, তারপর ঝটকায় একতারাটা নিয়ে বের হতে উদ্যত হয়।
একতারার বিদ্রোহ হয়। সে টান টান দৃঢ় হয়।
গান যাতে না বাজে।
যে পুরুষ নারীর জ্বালা বোঝে না তার বুকে কিসের কবি গান । জোড়া বাহু বিদ্রোহ করে। মনে মনে বলে, নিমের কারিগরের বাটালের দোহাই, মানুষের গান যদি তবে আমি গাতি পারে, তবে সুরি বাজি, ন হলি এই তার যেন ছিড়ি যায় টংকারে।
বাউল একতারার কণ্ঠ শুনতে পায়।
বাক্যগুলো সম্মোহিত করে ফেলে তাকে। তারের মায়ায় সঙ্গে সঙ্গে বাঁধে গান
"ওরে ও দুরন্ত দেশের পরানের নারী,
পাটায় পিষিয়া পানের সুপারি
পাঙ্খায় শীতল করি গরমের দিন
আলতা রঙ্গিন ওষ্ঠে হয়িছি বিলিন
যতনে রন্ধন করি জাউয়ের আরতি
জ্বলিছে পালঙ্কে তার পূর্নিমা বাতি
সামান্য কারণে পিরিত হলি ক্ষয়
অমানুষ বিনা কবি কিছু আর নয়
"
ঘরের ভিতর একতারা গলা ছেড়ে সুর কাঁপায়। বাউল মাথার পাগড়ি ছুড়ে হাত ধরে টানে তোলে মধুর সঙ্গিনীকে।
সামান্য কলহের স্মৃতি অতীত হয় । আঁখে মেলে বধু।
আঁচল কোমরে বেঁধে গান ধরে, নৃত্য করে। এক হাতে একতারা, অন্য হাতে সংসারের চাবি, দুই মিলে মিশে এ ভাবে জগৎ সুসজ্জিত হয়।
তারপর অনেক অনেক বছর ঘুরে গেছে। কাহিনীটা পালায় উঠে আসে। আজকের এই ট্রেনজিস্টর টিভির যুগেও বাউলের সুখের কাহিনীটা মুখে মুখে ফেরে গঞ্জে-গ্রামে-হাটে-ঘাটে।
---
ড্রাফট ২.০ / লেখার কিছু না পেয়ে সামহোয়ারইনের ব্যানারের ছবিটা কে নিয়ে জোর করে একটা কাহিনী বানানো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।