নাজমুল ইসলাম মকবুল
পুঁজিবাজার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী : আরও তদন্ত ছাড়া ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত রিপোর্ট গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের নাম তদন্ত কমিটি তুলে ধরলেও, ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রতিবেদনের অনেক ক্ষেত্রে কমিটি তাদের ধারণা বা অনুমানের ওপর ভিত্তি কারে দোষ খুঁজে পেয়েছেন অথবা সুপারিশ করেছেন। এর ভিত্তিতে তাত্ক্ষণিকভাবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনয়ন করা যায় না। এতে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন।
কারণ, অনুমাননির্ভর কোনো তথ্যের ভিত্তিতে কারো সম্মানহানি করা হোক, এটা কাম্য নয়। ’ অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনে দুটি ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি ফৌজদারি অপরাধ শনাক্ত করেছে। এ অপরাধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করতে পারে। শেয়ারের মূল্য বিভাজনে কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন সৈয়দ সিরাজউদ্দৌলা। এছাড়া ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ারের সিরিয়াল ট্রেডিংয়ে আবু সাদাত মো. সায়েম এবং আবদুল মোবিন মোল্লার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখতে গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে সরকার। পরে ২২ ফেব্রুয়ারি এই কমিটি পুনর্গঠন করে আরও একজনকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কমিটি গত ৭ এপ্রিল তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাধর ৬০ ব্যক্তির নাম আসে। কমিটির রিপোর্ট পেয়ে গত ৭ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়ে দেন, তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েই রিপোর্ট প্রকাশ করবে সরকার। তবে গতকাল কমিটির রিপোর্ট কোনো পরিবর্তন ছাড়াই প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী।
রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ২৮৪ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা ও যাচাইবাছাই করতে সময় লেগেছে। এ কারণে যথাসময়ে রিপোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা যায়নি।
তিনি জানান, এই প্রতিবেদনের বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কমিটি একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।
তাদের সুপারিশ অনুযায়ী এরই মধ্যে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এছাড়া কমিটি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি পুর্নগঠনের সুপারিশ করেছে। সুপারিশ অনুযায়ী এর মধ্যেই এসইসিতে একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী জানান, আগামী ২/১ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যানের নাম প্রকাশ করবে সরকার। এছাড়া কম সময়ের মধ্যে সংস্থাটিতে দু’জন সদস্যও নিয়োগ দেয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী জানান, এসইসির সাবেক সদস্য মনসুর আলমকে অব্যাহতি দেয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে—এসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভুঁইয়া ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের জিএম কফিল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদককে বলা হবে। এবি ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী আরওয়াই শমসের প্লেসমেন্ট নিয়ে অনৈতিক কাজ করায় তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তদন্ত কমিটি এসইসিকে ব্যর্থ বললেও সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে এসইসি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে কমিটি যে অভিমত দিয়েছেন সরকার তা গ্রহণ করছে না।
তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই পুরো এসইসি পুর্নগঠন করা হচ্ছে।
তদন্ত রিপোর্টের পর পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসবে কিনা—এমন এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, শেয়ারবাজার এখন স্থিতিশীল রয়েছে। তবে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট তথ্য ও জ্ঞান সংগ্রহ করেই পুঁজিবাজারে আসা উচিত। পুঁজিবাজারের তদন্ত রিপোর্ট গতকালই অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়েব সাইটের ঠিকানা-www.mof.gov.bd
এদিকে তদন্ত রিপোর্টের একটি অংশে বলা হয়েছে, এবারের পুঁজিবাজারে ধস ১৯৯৬ সালের মত নয়।
সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং ভিন্ন প্রক্রিয়ায় সংঘটিত। ’৯৬-এর ধস ছিল সম্পূর্ণ সেকেন্ডারি বাজারের ঘটনা। কিন্তু এবারের মূল ঘটনা অনেকটা পর্দার অন্তরালে প্রাইমারি কর্মকাণ্ড থেকে। এর সঙ্গে এসইসির সমর্থন ও সহায়তা ছিল। ছিল বড় একটি সিন্ডিকেটের কারসাজি।
প্রসঙ্গত, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, ব্যবসায়ী ও বাইরের অনেকেরই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানা কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। বিদ্যুত্, গ্যাস সঙ্কট, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিল্পখাতে বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে।
শিল্পখাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। এমনকি ব্যাংকগুলোও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমারেখা মানেনি। ব্যাংকগুলো আমানতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারলেও অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া কালো টাকা সাদা করার শর্তহীন সুযোগ থাকায় অনেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকছেন।
বিশেষ করে পেনশনভোগী বিপুলসংখ্যক মানুষ সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বিপুলসংখ্যক বেকার যুবক বিভিন্ন উত্স থেকে টাকা ধার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। ছাত্র, যুবক, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ বাড়তি আয়ের জন্য শেয়ারবাজারমুখী হয়েছেন। স্রোতের মতো মানুষ এসেছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে। বিপুলসংখ্যক মানুষ শেয়ারবাজারে যুক্ত হলেও তাদের অনেকেরই শেয়ারবাজার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
সুত্র: আমার দেশ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।