আকাশ ভরা গাঙচিল
[ গ্রামীণ পটভূমিতে আমার লেখা প্রথম ভালবাসার গল্প 'বিলম্বিত প্রত্যাবর্তন' পোস্ট করলাম। তিন পর্বের এ গল্পে গ্রাম বাংলার বাস্তব কিছু ঘটনার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেছি আমার অপরিপক্ক হাতের স্পর্শে। প্রথম পর্বটা একটু বড় হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। সবার প্রতি শুভ কামনা রইল। ]
বিলম্বিত প্রত্যাবর্তন পর্ব ১
পঞ্চার্শোধ ইব্রাহিম খলিল সাহেবরে ছয় সন্তান।
স্ত্রী নিলুফা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বছর দুই আগে। মৃত্যুর ঠিক তিন দিন আগে ক্যান্সারের কথা জানতে পেরেছিলেন খলিল সাহেব। নিলুফা চুপ চাপ সব সহ্য করে গেছেন। কাইকেই বুঝতে দেন নাই। সংসারের শত সমস্যার মাঝে নিজের অসুখের কথা কাইকে বলার সাহন পাননি।
ক্যান্সারে পুরো শরীর যখন নেতিয়ে গেছে নিলুফারের তখন ডাক্তার, হাসপাতাল করতে করতে দু দিনে ৭০/৮০ হাজার টাকা শেষ হয়ে গেছে খলিল সাহেবের। ইউনিয়ন পরিষদের সামান্য এক কেরানীর এতো বড় সংসারে ৭০/৮০ হাজার টাকার পরিমান যে কত তা খলিল সাহেব ঠিকই বুঝতে পারেন।
সারাজীবন সৎ মানুষটির মতো জীবন কাটিয়েছেন। সমাজের দশজন গণ্যমান্য ব্যাক্তির কাছে মাথা নত করে সবার সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করেছেন। সমাজে ভাল মানুষ হিসেবে সুনাম থাকলেও মানুষের ঠোঁট কাটা কথা প্রায়ই শুনতে হয় খলিল সাহেবকে।
ছেলে সন্তান ছেলে সন্তান করে যখন পাঁচ মেয়ের পর ছেলে সন্তানের মুখ দেখলেন তখন তার জীবনের সমস্ত অতৃপ্তি নিমিষে উধাও হয়ে যায়। ছেলে তার অনেক বড় মানুষ হবে জাতিয় বাঙ্গালি পিতা মতাদের চরম আকাঙ্ক্ষা ধুলিস্মাৎ হতে সময় লাগে না। খলিল সাহেবের ক্ষেত্রেও তাই হল। অল্প বয়সেই ছেলে সিগারেট
খাওয়া ধরল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের আড্ডায় দিন রাত বসে থাকে।
লেখাপড়া নেই। মা বাবার প্রতি কোনো সম্মানবোধ নেই। বড় বোনদের দু চোক্ষে দেখতে পারে না। মায়ের মৃত্যুর পর ঠিক মতো বাড়িতেও আসে না।
খলিল সাহেব বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
বড় দুই মেয়ে হাসি আর হাসনা তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছে। খলিল সাহেবের যা সুখ তা এ দুই মেয়েকে নিয়ে। লাবনী, লতা আর রিতু খলিল সাহেবের ছোট তিন মেয়ে। লাবনী আর লতার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো বিয়ের কোনো সম্বন্ধ আসছে না। আসবে কিভাবে, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কিই বা সম্বল আছে যৌতুক দেয়ার মতো? সম্বন্ধ নিয়ে যারা এসেছিল তারা হয়তো কেউ রিক্সাচালক নতুবা কেউ চা সিগারেটের দোকানদার।
রাগে আর লজ্জায় নির্বাক খলিল সাহেব খুব সম্মানের সাথে তাদের বিদায় করেছেন কিন্তু প্রতিনিয়ত হীনমন্যতা তাকে আরও ছোট করে দিচ্ছে। একলাফে থলিল সাহেব যেন অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আমার টাকা পয়সা নেই বলে কি সম্মানও নেই? সততারও কি কোনো মূল্য নেই এ সমাজে? এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে নির্ঘুম রাত বারান্দায় পায়চারি করে কাঠিয়ে দেন খলিল সাহেব।
খলিল সাহেবের ছোট মেয়ে রিতু, সুন্দরী না হলেও মন্দ নয়। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী রিতুর সাথে তাদের ক্লাসেরই ধনন্জয় শর্মার বেশ ভাব।
ক্লাসের অন্য সবাই তাদের প্রেমিক জুটি হিসেবে জানলেও রিতু আর ধনন্জয় নিতান্তই বন্ধু। ক্লাস লেকচার নিয়ে আলোচনা করতে তারা প্রায়ই কলেজ বিল্ডিং এর পেছনের ভাঙ্গা পরিত্যক্ত অফিস ঘরের বারান্দায় বসে। এখানে সচরাচর কেউ আসে না সাপের ভয়ে। ধনন্জয়ের হাতে সর্প দেবী মনসার তাবিজ বাঁধা। সে রিতুকেও একটা তাবিজ দিতে চেয়েছে কিন্তু রিতু রাজি হয়নি।
বাড়িতে কেউ দেখে ফেললে আর খলিল সাহেবের কানে যদি এ কথা যায় তবে রিতুর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবেন না খলিল সাহেব। রিতু সে কথা ধনন্জয়কে বলেনি। তাবিজ পরতে তার ভাল লাগে না এ কথা বলে এড়িয়ে গেছে।
ভাঙ্গা পরিত্যক্ত অফিস ঘরের বারান্দাটা রিতুর খুব পছন্দের। শেষ বিকেলের রক্তিম আলোটা যখন পাশের ছোট ডোবায় এসে পড়ে তখন সেখানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উদাস হয়ে যায় রিতু।
খুব প্রিয় কিছুর অভাব বোধ করে সে।
যদিও সবদিন এখানে আসা হয় না। যেদিন ক্লাস বিকেলে থাকে সেদিন ক্লাস শেষে তারা গিয়ে বসে ঐ ভাঙ্গা বারান্দায়। সেদিনও রিতু চুপ করে পড়ন্ত ঐ সূর্যের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধনন্জয়ের ডাকে সাড়া না দিলে ধনন্জয় রিতুর হাত ধরে টান দেয়।
কেঁপে ওঠে রিতু। রিতুর দু চোখে জল। এক দৃশ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনন্জয়ের চোখের দিকে। ধনন্জয় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রিতুর দিকে। রিতুর দু হাত তার বুকের কাছে টেনে নেয়।
রিতু ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঝাপিয়ে পড়ে ধনন্জয়ের বুকে। এক অকৃত্রিম ভালবাসার মায়ায় তারা জড়িয়ে পড়ে। সমাজ, ধর্ম, প্রকৃতি সবকিছু ছাড়িয়ে ভালবাসা কথা বলে ওঠে মানব মানবীর দেহের ভাষায়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।