আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি ও আমার শূন্যতা [বিলম্বিত উপলব্ধি]

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

আজকাল সে আমাকে অনেক বেশি ডমিনেট করতে চায়। গতকালকে সারাটা দিন সেলফোনটা অফ রেখেছিল। সামান্য মনোমালিন্যের উদ্ভুত পরিস্থিতি এটা। মনোমালিন্যটাও ছিল সম্পূর্ণ একতরফা। বর্তমানে তাঁর আচরণ এবং বাস্তবতা আমাকে এটাই বুঝায় যে অচিরেই তার সেলফোনটা অন্তত আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

তাঁর অনুপস্থিতি এবং আসন্ন বাস্তবতার ভাবনার কারণে একটা বিশাল শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে। নিজের শূন্যতা ঢাকার জন্য আকাশের দিকে তাকাই। ভাবি আকাশের শূন্যতা আর আমার শূন্যতার তুলনা পরস্পরকে একাকার করে দিবে। কিন্তু আকাশের শূন্যতার সঙ্গে আমার শূন্যতাকে তুলনা করার কোন কোন যোগ্যতা কি আছে? আকাশতো তাঁর শূন্যতা দিয়ে পৃথিবীকে ধারণ করে, মহাশূন্যের শূন্যতাকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করে। কিন্তু আমার শূন্যতা? সেতো বড় একা।

সে সর্বদা ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, নিজের সংকীর্ণতা আর নাপাওয়ার ভাবনা নিয়ে। আকাশের এই বিশাল স্বার্থহীন শূন্যতার সাথে নিজের সংকীর্ণ শূন্যতার তুলনার এই অপচেষ্টা কেন আমার? প্রতিদিন আসা যাওয়ার পথে চৌরাস্তার মোড়ে একটি লোককে ভিক্ষা করতে দেখি। লোকটা জন্মান্ধ। মাঝে মাঝে দেখি একটা ছোট ছেলে তাঁকে ঐ স্থানটিতে রেখে যায়। সম্ভবতো নিয়েও যাও।

কোথায় থাকে লোকটা? কোনদিন জানা হয়নি। পকেটে ভাংতি পয়সা থাকলে মাঝেসাঝে দু'চারানা দেই। প্রাণ খুলে আমার জন্য দোয়া করে। কিন্তু দু'মিনিট দাড়িয়ে এই শুভাকাংখীর সংগে কথা হয়না। এবিষয়ে আমি বিচ্ছিন্ন কেউ নই।

আমার ধারণা কেউ তাঁর সঙ্গে দু'দন্ড কথা বলেনা। একটা মানুষ যে শুধু জন্মগ্রহণই করেছে। কিন্তু তাঁর কোন সাধ পায়নি। পৃথিবীর আলো, তার জন্মদাতা বা নিজের সন্তানদের দেখেনি তাঁর শূন্যতা বা একাকীত্বের সাথে কি অন্য কারো তুলনা হতে পারে? কিন্তু তা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনা। নিজের একাকীত্ব বা শূন্যতা কিংবা নাপাওয়া নিয়ে সর্বদা আক্ষেপ করি।

নিজের শূন্যতাকে আসমানতুল্য ভাবি। পোলিও কারণে দু'পা হারানো স্কুলের সেই সহপাঠীটি এখন কেমন আছে? স্কুল ছাড়ার পর তাঁর কোন খবর রাখা হয়নি। আমরা যখন খেলতাম তখন সে দূর থেকে তাকিয়ে দেখত। তাঁরও কি খেলতে ইচ্ছা করত? হতাশার যাতনা তাঁকেও কি শূন্যতার সমুদ্রে নিক্ষেপ করত? কোনদিন জানা হয়নি। স্ট্রেচারে ভর করে সে কি এখনো দূরে দাড়িয়ে শিশুদের খেলা দেখে? তখন কি নিজেকে তাঁর শূন্য মনে হয়? কোনদিন জানা হবেনা।

অন্যকে নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমার? আমি চিন্তিত আমার শূন্যতা নিয়ে, আমার নাপাওয়া নিয়ে। ছেলেটার সঙ্গে একসাথে খেলেছি, একসাথে স্কুলে গিয়েছি। কত আনন্দ, উচ্ছলতার স্মৃতি গড়ে ওঠেছিল আমাদের। অথচ একটু বড় হওয়ার পর তাঁর শরীরের অস্বাভাবিকতার কারণে যারা একসময়ে তার খেলার সাথী ছিলাম তারাই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাতে মেতে থাকতাম। বিদ্রুপের হাত হতে বাঁচার জন্য এক সময়ে তার স্কুল আগমন বন্ধ হয়।

পরে একদিন জানলাম তাঁর পরিবার তাঁকে তাঁরই সমগোত্রের কারো কাছে রেখে এসেছে। পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়ে, নিজের মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়ে কি মনে হয়েছিল তার? নিজেকে কি খুব একা বা শূন্য মনে হয়েছিল? জানিনা আমি। তবে এটুকু বুঝি পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য এখন হয়তো সে দলবেধে কোন বাজারের এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জোর করে দু'চার টাকা আদায় করছে। আর চারপাশের ভদ্রজনেরা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছে।

আচ্ছা, কোনদিন চলার পথে তাঁর সাথে দেখা হলে আমি কি তাঁর কোন খবর নিব? না, নিশ্চিতভাবেই নিব না। অহেতুক বিড়ম্বনার মাঝে পড়ার কোন মানে নেই। বহুদিন বিছানায় থেকে গত বছরের ঠিক এই সময়টাতে দাদা মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে উপস্থিত স্বজনদের কাছে বারবার জানতে চাচ্ছিলেন আমি আসছি কিনা। স্বজনরা আশ্বাস দিয়ে বলছিল পথে আছে, একটু পরেই চলে আসবে।

এই আশ্বাসের বাণী বুকে নিয়েই তিনি চলে গেলেন। আমাকে দেখা হয়নি। মরার সময় আমার এই অনুপস্থিতি কি তাকে শূন্য করেছিল? জানিনা আমি। আর এতোকিছু নিয়ে ভাববার মতো সময় কই আমার! অনেক দরকারী কাজ বাদ দিয়ে কষ্ট করে একটু সময় বের করে তাকে মাটিচাপা দিতে যাওয়ার ত্যাগটাই বা কম কি! অথচ আমার জন্য কি অফুরন্ত সময়ই না ছিল এই বেচারার। যতোদিন শরীরটা চলার উপযোগী ছিল ততোদিন পর্যন্ত ভাঙ্গা অসুস্থ দেহটা নিয়ে ঈদের ঠিক আগে আমাদের বাসায় হাজির হতেন।

গ্রামে তাঁর সাথে ঈদ করার জন্য আমাকে এক রকম জোর করেই ধরে নিয়ে যেতেন। বাস থেকে নামার পর স্টেশন থেকে বাড়ি পৌছানো পর্যন্ত যার সঙ্গে দেখা হতে তাকেই আমাকে দেখিয়ে বলতেন 'আমার নাতি'। হায়রে অপদার্থ নাতি! আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর খবর আসে। প্রথামাফিক জানাযায় যাই, মাটিচাপা দেই। এরপর আর কোন খবর রাখা হয়না।

কখনও জানা হয়না ক্যামন করে প্রিয় মানুষটির শূন্যতা নিয়ে তার স্বজনেরা বেঁচে থাকে। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার নাপাওয়ার ভাবনা নিয়ে। নিজের একাকীত্ব ও শূন্যতার কাছে দ্বিতীয় কারো আবদার আমাকে আর স্পর্শ করে না। আমার শূন্যতা আমাকে একা করে। আমার শূন্যতা আমাকে স্বার্থপর করে।

আমার শূন্যতা আমাকে বিশ্বজনীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আমার শূন্যতা আমাকে সংকীর্ণ করে। অথচ এই সংকীর্ণতা নিয়ে কি গর্ব আমার! নিজেকে আকাশের সাথে তুলনা করি! দেবালয় হয়তো এখন সত্যিই অসুরলোকে নেমে এসেছে। -------------------------------------------------------------------------------- Related Post (Click This Link)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।