আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্মান

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সম্মান মোহাম্মদ ইসহাক খান ভেবে দেখো, ছেলে, তুমি কত বড় সম্মান পেতে যাচ্ছ। এই দুঃসাহসী অভিযানে যাবার সৌভাগ্য সবার হয় না।

ভাবছ, হয়তো তুমি মরে যাবে। তুমি সৈনিক, ছেলে। আমি তোমাকে বৃথা আশ্বাস দেবো না। কঠোর পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি তোমাকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছি, আমি জানি তোমার শক্তি আর সাহস কতটুকু। তারপরও বলছি, তুমি নিশ্চয়ই হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারবে।

আমি তোমাদের সবাইকে, যারাই আমার কাছে এসেছিলো, তাদেরকে শিখিয়েছি, কীভাবে মৃত্যুর সামনাসামনি দাঁড়াতে হয়, একে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে হয়। আজ তুমি তাই করবে। যদি তুমি ফিরে আসতে পারো, তাহলে তোমার গলায় বিজয়মাল্য পরানো হবে। আর যদি তুমি জীবিত ফিরে না-ও আসো, তাহলেও তুমি বঞ্চিত হবে না। তোমার কফিন চারজন বীর সেনা সসম্মানে বহন করে নিয়ে যাবে, তোমাকে বন্দুক ছুঁড়ে শ্রদ্ধা জানাবে সহযোদ্ধারা, তোমাকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে সমাহিত করা হবে।

তোমার আবক্ষ মূর্তি শোভা পাবে এখানে, সবাই তোমার কবরে ফুল দেবে, মাথা নিচু করে দাঁড়াবে, এই দেশের ইতিহাসে সবসময় তোমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভেবে দেখো, এই সম্মানের জন্য হলেও তো তুমি যাবে, তাই না? সম্মান কি টাকার অংকে কিংবা ওজনের বাটখারায় মাপা যায়? যাও ছেলে, দেশের হয়ে, দেশের মানুষের হয়ে তুমি অকুতোভয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়, বিজয় নিয়ে এসো, আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর। কী ব্যাপার, ছেলে? তোমার দু'চোখে এত বিষাদ কেন? কেন তুমি হাসিমুখে যাত্রা করছ না? ছেলেটি মুখ তুলে তাকায়। আপনি কেন আমাকে পাঠাচ্ছেন, আমি ভাল করেই জানি, জেনারেল। কী বলতে চাইছ তুমি? জেনারেল দ্বিধায় পড়ে যান।

ছেলেটি কোন জড়তা ছাড়াই বলল, আমি একজন অবৈধ সন্তান। আমার পিতামাতার নাম-পরিচয় আমি জানি না। অবাঞ্ছিত বলে একদিন আমার মা আমাকে এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন, তারপর থেকে আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই বড় হয়েছি। আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কাকে বলে, আমি জানি না। আমি শুধু শিখেছি অস্ত্র চালাতে, গুলি করতে, মানুষ মারতে।

আপনারা জানেন, আমার মতো মানুষগুলো, যাদের কোন পরিচয় নেই, যারা জানে না যে তারা আসলে কে, তাদের হারাবার কিছুই নেই। তাই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বেপরোয়া জানোয়ারের মতো লড়াই করি, মারা যাই। আমাদের কোন পিছুটান নেই বলেই আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়ি না, পিছু হটতে জানি না। এই কাজ কখনো একজন সাধারণ মানুষ করবে না, কারণ তার ঘরে পিতামাতা আছে, প্রিয়তমা স্ত্রী আছে, কচি সন্তান আছে, যারা তার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না স্যার।

বন্দুক ছুঁড়ে সম্মান জানাবার কথা বলছেন? রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধার কথা বলছেন? উইথ রেস্পেক্ট স্যার, এসব মিথ্যে, ভাঁওতাবাজি। আমি দুঃখিত, এতদিন পর হলেও সত্যিটা এখন বুঝতে পারি। সত্যি কথা জানা খুব দুঃখজনক স্যার। মনে হয়, আমার সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। আমি নিতান্তই মূল্যহীন একটা জীব, তার বেশি কিছু নয়।

আমার মতো মানুষগুলোকে সম্মান জানানো হবে খাঁচার বানরকে বাদাম ছুঁড়ে দেয়ার মতো। যাই স্যার, দুঃসাহসিক অভিযানে যেতে হবে, বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন। বড় দুঃখ নিয়ে যাচ্ছি স্যার, আমার মৃত্যুর সময় কেউ আমার মাথায় আদর করে হাত রাখবে না, একটু নরম কথা বলবে না, মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘবের বৃথা চেষ্টা করবে না। আমার মৃত্যু হবে যুদ্ধক্ষেত্রে, আহত হয়ে, কাৎরাতে কাৎরাতে, পানির জন্য চিৎকার করতে করতে, অনেক অনেক রক্ত দেখতে দেখতে।

হায়। ছেলেটি জেনারেলকে স্যালুট করে, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে রাইফেল নিয়ে রওনা দেয়। পেছনে তাকায় না সে। পেছনে তাকাবার কোন প্রয়োজন নেই তার, কেউ হাত নাড়ছে না, সজল চোখে কেউ তাকিয়ে নেই, কেউ আকুল হয়ে প্রার্থনা করছে না তার সুস্থ্য দেহে ফিরে আসার। একজন জেনারেলের সামনে সকল সাধারণ সৈনিক মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, কিন্তু এখন তাঁর নিজের মাথাই বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে।

(১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.