আমার আমি......
নিশ্চুপ নিরবতা ছিল শহরের সকালের দৃশ্য, যেটা ছড়িয়ে পড়েছিল সকালের প্রাত:ভ্রমণকারী থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় বের হওয়া যৌনতা বিক্রিকারী পর্যন্ত । তাদের কর্ম বলতে ছিল আজ শহরের ব্যস্ততম মোড়ে জমায়েত হওয়া আর চলতে ফিরতে ফিসফিস করে কথা বলা । ঘটনার শুরু ছিল, ভোরের আলোয় বের হওয়া শরীরের প্রায়শ্চিত্যকারীরা যখন আবিষ্কার করেছিল একটা লাশ । ক্ষতবিক্ষত লাশ । থ্যাতলানো দেহটি ছিল একটি শিশুর, যা দেখে মুখ ঢেকে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল অনেকে ।
কারো কারো মুখ থেকে আপনা আপনি বের হয়েছিল কঠিন বিশেদগার সেই অচেনা ঘাতকের প্রতি । শহরের পরিষ্কারকারক ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের প্রতিবাদে, পারেনি সে সরাতে একচুল শিশুটিকে সেই অবস্থান থেকে । সকালের কোমল আলোর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে শিশুটির চারপাশে মানুষের জটলা বেড়েছে আর বেড়েছে ক্রুব্ধতা কিংবা আহাজারি । না সকালের প্রাতঃভ্রমণকারীরা সেখানে থেকে যায়নি সর্বক্ষন তবে তারা এসেছিল বারবার চরিত্র বদল করে । কখনো ব্যস্ত চাকুরিজিবী, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি কিংবা সাধারন পথচারী হয়ে ।
তাদের কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল একই সুরে, শিশুটির হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং তার বিচার । তাদের চোখে কান্নাও ছিল, ছিল হতাশা । যা আস্তে আস্তে পরিনত হয়েছিল ক্ষোভে, যেটা তারা প্রশমিত করেছিল, না জেনে চলে আসা ভাগ্যবিড়ম্বিত কিছু মানুষের যানের উপর ।
অসংলগ্ন পদব্রজকারী, ছিন্নমুল কিছু টোকাই, মোড়ের দোকানদার, পোড় খাওয়া পুলিশ অফিসার আর বিভিন্ন পরিচয় বহনকারী মানুষের দল ভীড় কমতে দেয়নি কখনো । নিছক দুর্ঘটনা বলে ভাবছিল তাদের মাঝ থেকে কিছু আশাবাদি মানুষ, এর মাঝে কুটিলতা খুঁজছিল কিছু কুটিল মানুষ, আর শিশুটির দুর্ভাগা ভাগ্যের কথা চিন্তা করে হাতাশবাদিরা হাহাকার করছিল ।
কেউ কেউ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উপভোগ করছিল এই অঙ্কিত নাট্য দৃশ্য । কেউ কেউ নিস্ফল প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে সেখানেই জ্বালাময়ী কথা বলছিল, যেন ঘাতককে পেলে তার এস্পার ওস্পার একটা করেই ছাড়বে । যা তার চরিত্রের সাথে কখনোই যায়না । শিশুটির ভাগ্যে উজ্জ্বলতা আনতে যেন সেখানে ভীড় জমিয়েছিল প্রিন্ট মিডিয়া, তাদের মাঝে কেউ কেউ সরাসরি সম্প্রচার করছিল ঘটে যাওয়া প্রতিমুহুর্তের ঘটনা । শিশুটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন করতে আরো এসেছিল বিস্তর সময় পার্থক্য রেখে বিরোধী ও সরকারী দলের নেতারা ।
তারা তাদের অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করে জানিয়েছিল শিশুটির প্রতি সমবেদনা । একজন শিশুটির প্রতি একাত্ততা আনতে জানিয়েছিল সরকারের প্রতি অসহযোগীতার আহ্ববান , অন্যজন তার মৃত্যুর জন্য দায়ীকে দিতে চেয়েছিল কঠিন শাস্তি । জনতা দর্শকের ভুমিকায় বাহবা দিয়েছিল উভয়কেই তাদের বাকপটুতার কাছে বিশ্বাস জমা রেখে । তাদের বাকপটুতার সময় তারা ভুলে গিয়েছিল রক্তাক্ত শিশুটির দেহের কথা, তবে তাদের শোকাভুত হতে বেশি দেরি হয়নি যখন নেতারা বিদায় নিয়েছিল তখন ।
সন্ধ্যায় যখন বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা মানুষগুলোর ভীড় কমে গিয়েছিল তখন দূর হতে যৌনতা বিক্রিকারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস কিংবা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল তাদের আয়ে ভাগিদার একজন কমে যাওয়ায় কিংবা তাদের স্বজনের হারানোর ব্যাথায় ।
তারা দিনের আলোয় আসতে পারেনি কারন তারা আলো ভয় পায় । তবে তারাও যে অভিনেতা এটা প্রমানিত করার জন্যই এসেছিল ব্যস্ততম মোড়ে ।
শহর পরিষ্কারকারক যখন শিশুটির পচা দুর্গন্ধময় লাশ নিয়ে গিয়েছিল গভীর রাতে, তখন সেখানে ছিলনা কোন শিশুটির জন্য হাহাকার করা মানুষ । শুধু দূর হতে দীর্ঘশ্বাসের মত ডেকে উঠেছিল কোন শিয়াল কিংবা সে আনন্দিত ছিল নতুন খাবার পাবার আশায় ।
শিশুটির প্রচন্ড মন খারাপ কিংবা ইশ্বরের প্রতি প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বসেছিল স্বর্গের দ্বারে ।
সে আসতে চায়নি এত তাড়াতাড়ি ইশ্বরের কাছে, তার দেখার বাকি আছে এখনো অনেক কিছু । কেন তার প্রতি এত অবিচার ? সে তো কিছুই করেনি যার জন্য এত বড় শাস্তি পেতে হল তাকে । বরঞ্চ দোষ ছিল ঐসব নেতাদের যারা তার বাবার একমাত্র উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল । যার প্রায়শ্চিত্য তার বাবা এবং তার পরিবারকে করতে হয়েছিল তার বাবার মৃত্যুর মাধ্যমে । তখন ওই সমাজের কাছে গিয়েছিল তার মা একটুকু কাজের আশায়, তাদের মুখে আহারের ব্যবস্থা করার আশায় ।
কিন্তু ওই লোভী সমাজ তার মাকে বানিয়ে দিয়েছিল দেহব্যবসায়ী, যার প্রায়শ্চিত্য সে করেছিল মাকে হারিয়ে পথশিশু হয়ে । তারপরও তার কোন ঘৃণা ছিলনা ওই সমাজের প্রতি বরং স্বপ্ন ছিল বড় কিছু হওয়ার । তবে কেন ইশ্বর স্বয়ং বাধা হয়ে আসলেন । সে তো তেমন কিছুই করেনি, শুধু বাঁচতে চেয়েছে ফুটপাথের রাতপার করে । তবে কেন ঐ দামী গাড়ি তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল, তরলে শান্তি খুজে নেওয়া মানুষটার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে কেন? শিশুটি বুঝে উঠতে পারে না কোন কিছু তার ছোট্ট থ্যাতলানো মাথায় ।
ইশ্বর কিছুক্ষন শিশুটিকে অবলোকন করে, শিশুটির তার প্রতি অভিমান দেখে খুলে দিলেন স্বর্গের দ্বার । অনুমতি দিলেন তাকে দেখতে তার প্রিয় নশ্বর দেহকে । শিশুটি উৎফুল্ল ছিল তার দেহকে দেখতে পেয়ে । তার চেয়ে বেশি উৎফুল্ল ছিল তার প্রতি মানুষের ভালবাসা দেখে । তবে এটা তার কাছে বিরক্তিকর হতে বেশি সময় নেয়নি ।
প্রথমে ইশ্বরের প্রতি প্রচন্ড অভিমান তীব্রতর হয়েছিল তারপর সেটা কমতে কমতে শুন্যই যেয়ে পৌছেছিল দিনের আলোর তীব্রতা কমার সাথে সাথেই । তাই শহর পরিষ্কারকারক যখন তার ছোট্ট দেহ পরিষ্কারকারী ভ্যানে নিয়েছিল তখন তার মুখে ছিলনা কোন কষ্টের অভিব্যক্তি কিংবা অভিসম্পাতের মুক্ত জানালা বরং সেখানে ছিল একটুকরো ক্রুর হাসি মর্তবাসীর জন্য ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।