আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুটি যেভাবে নদী চিনেছিলো

শাফি সমুদ্র

খাবার টেবিলে বসে বসে শিশুটি সবসময়ই সূর্যের সাথে ঝগড়া করে। ডাইনিং টেবিলে সে যখন খেতে বসে তার খাবারের থালার উপর একটুকরো রোদ এসে পড়ে। আর তখনই সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। সূর্যের সাত পুরুষ ধরে ডাকাডাকি করে। যখন থেকে একা একা খাবার টেবিলে বসে খেতে শিখেছে তখন থেকেই এরকম ঝগড়া তার নিত্য সঙ্গী।

সে ভাবে এই রোদের টুকরা বুঝি তার প্লেটে ভাগ বসিয়েছে, অমনি রোদ্দুর ধরার চেষ্টা করে মুঠোর ভিতরে। কিন্তু রোদ আর ধরতে পারে না। এই নিয়ে বাবার সাথেও কথা চালাচালি হয় তার। বাবাকে বলে - ‘তুমি কেন খাবার সময় এই রোদ্দুরকে ডেকে নিয়ে আসো?’ বাবা তো হেসে ওঠে, আর অই হাসিটাই তার কাল হয়ে ওঠে ছেলের কাছে। প্রতিদিন বাবা এবং ছেলের ঝগড়া দিয়ে দিনের শুরু, তারপর দু’জন দু’দিকে।

বাবা অফিসে আর ছেলেটি একা একা সারাদিন এ ঘর ও ঘর করে বেড়ায়। বাবার আঁকা ছবির সাথেও সারাবেলা ঝগড়া করে, হিংসে করে। বাবা অফিসের কাজে সবসময়ই ব্যস্ত থাকে। এই একাকীত্ব তার কাছে কখনো অসহায় মনে হয় না। কারণ ঘরের চেয়ার-টেবিলের সাথে তার পুতুল পুতুল খেলা, বিড়ালের বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বের নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হয়, মেঝেতে বসে বসে পুকুর তৈরী করে, তাতে মাছের চাষ করে লাল পুঁটি, নীল পুঁটি।

সিঁড়ি বেয়ে যখন ছেলেটি নিচে নেমে আসে বেড়াল ছানা দু’টিও সাথে সাথে নিচে নেমে আসে। ওদেরকে বাবার ঘরটি দেখিয়ে দেয় আর বলে- ‘বাবার সাথে বন্ধুত্ব করো। বাবা তোমাদেরকে দুধ-ভাত খাওয়াবে। ’ দুপুর হয়ে এলে ছেলেটি খাবার টেবিলে ফিরে আসে। সাজিয়ে রাখা খাবার থেকে নিজের খাবারটুকু নিয়ে নেয় আর বেড়াল ছানার জন্য আরেকটা পাত্রে রেখে দেয়।

শিশুটি নিজেই তার নিজের অভিবাবক। নিজেই নিজেকে আদর করে। নিজেই নিজেকে শাসণ করে। ওর যখন রাগ হয় তখনই আবার নিজেকে খুব আদর করে মানিয়ে নেয়। আবার যখন দুষ্টুমির মাত্রাটা বেড়ে যায় তখন বাবার মতো করে নিজেকে শাসন করে।

তারপর নিজেকে বলে - ‘খেয়েছো! এবার লক্ষ্মি ছেলের মতো ঘুমিয়ে যাও। ’ সে বিছানায় গিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে যায়। আর বেড়াল ছানা দু’টো তার পায়ের কাছে এসে আলতো ভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। জন্মের সময়েই তার মা মারা গেছে, মাকে দেখিনি কখনো। মায়ের কী রূপ তার উপলব্ধিতে কখনো আসে নি।

কেননা সে আজ পর্যন্ত কোন নারীর স্পর্শ পায়নি। মায়েরা কিভাবে সন্তানদেরকে আদর করে সে তা জানে না। শুধু এইটুকু জানে, মানুষ এমনি এমনি সৃষ্টি হয় আর বাবারা বুঝি তাদের সন্তানদেরকে এভাবে বড়ো করে। এর বেশি সে কখনো তার বাবার কাছে জানতে চাই নি। পৃথিবী সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন মনে করেনা সে।

শুধু এইটুকু বোঝে নিজেই সে নিজের ভালো বন্ধু। বাবার আঁকা একটি ছবির সাথে প্রায়ই সে কথা বলে। নিজে নিজেকে খুঁজে পায় ঐ ছবিতে। নিজেকে মেলে ধরে ছোট্ট এই পৃথিবীময়। বাবা যখন ঘরে ফেরে তখন রাত হয়ে যায়, কখনো গভীর রাত।

ঘরে তালাবদ্ধ শিশুটি হয়তো ততক্ষনে ঘুমিয়ে যায়। বাবার আঁকা ছবিটা সবসময়ই মাথার কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একদিন সকালে বাবাকে ডেকে বলে- ‘বাবা জানো আমি তোমার আঁকা ছবিদের সাথে একদিন কোথায় যেনো বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক মানুষ। অনেক মানুষেরা ঘুরছে-ফিরছে, আনন্দ করছে কিন্তু আমি একা একা সেখানে আনন্দ করছিলাম।

সবাই যেন কেমন সবাইর সাথে কথা বলছে, খেলা করছে। আর আমি তোমার এই ছবিগুলোর সাথে শুধু কথা বলছিলাম। আমাকে খুব আদর করছিলো। ’ তখন ছেলেটির বাবা নিশ্চুপ হয়ে তার গল্প শুনছিলো এমনটি বলা যায় না। অফিসের কাজ নিয়েই হয়তো ব্যস্ত রয়েছে।

তবুও ছেলেটি বাবাকে গল্প বলেই যাচ্ছে একের পর এক। গল্পগুলো বলতে বলতে ছেলেটি ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে সে কখনো মাকে ডাকতে পারিনি তাই বাবাকেই হাতড়ে ফেরে সব সময়। মায়ের ছবি কখনো সে দ্যাখেনি, এমন কি স্বপ্নেও না। তার জগতে বাবা, বিড়াল এবং ঘরের আসবাব ছাড়া আর কিছুই নেই।

বাইরের বৃক্ষদের সাথেও তার পরিচয় ঘটেনি। অন্যকোন প্রাণী সম্পর্কেও তেমন জানা-শোনা নেই। দেয়ালেই তার সব ভাষা আটকে আছে বলে দেয়ালই তার সব থেকে কাছের বন্ধু। তার বুকে সব সময় খোদাই করে তার নাম লেখে, আর দেয়ালও কেমন কাছে টেনে নেয় মায়ের মতো। বাবা একদিন বলেছিলেন তাকে নিয়ে যাবে নদীর কাছে।

কিন্তু নদী কি? সে জানে না। নদী নামটার সাথে পরিচয় ঘটলো ঐ একদিনই। নদীর নাম মুখে আনলেই বাবা অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। শিশুটির সাথে কোনদিনই আর নদীর কথা বলা হয়নি। বাবাকে প্রায়ই বলে- ‘বাবা নদী দেখতে কেমন? আমাদের মতো করে কথা বলতে পারে? নাকি তোমার মতো সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকে?’ তার মাথার ভিতরে অনেকদিন ধরে এই নদী নামটা ঘুরে ঘুরে আসছিলো।

বাবা যখন অফিসে চলে যায় তখন বেড়ালকে সে নদীর গল্প শোনায়। বেড়াল ছানা দু’টো খুব ধীর মনোযোগে তার গল্প শোনে। নদীর হাত আছে, পা আছে, তোদের মতো মিউ মিউ করে শব্দ করে। এরকম নানান কথা বলতে থাকে। বলতে বলতে বিকেল হয়ে আসে।

যেদিন দুপুরে ঘুম পড়েনা সেদিন বিকেলে ওর খুব একা একা লাগে। মনে হয় সবাই ঘুমিয়ে গেছে আর সে একা শুধু জেগে আছে। সিঁড়ি দিয়ে শিশুটি নিচে নেমে আসে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আজ তার বাবা ঘরের দরোজা তালা দিয়ে যায়নি। হয়তো ভুলে গেছে।

দরোজা খোলা দেখে সে অবাক হলো। এই দরোজা দিয়ে তার বাবা রোজ অফিসে যায়। এর আগে সে বাইরের জগতটাকে এভাবে কখনো দেখেনি। নিজে নিজে দরোজাটা খুললো। বাইরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে অন্যরকম একটি পৃথিবী যা একেবারেই অচেনা-অজানা।

হঠাৎ নদীর কথা তার মনে পড়ে গেলো । ভাবলো- এই পথে বাবা অফিসে যায় এই পথেই বুঝি নদীর কাছে যাওয়া যায়। শিশুটি হাঁটতে লাগলো, গাছ দেখছে, পাখি দেখছে, পাখি দেখে খুব আনন্দ পায় সে। কেননা পাখি আগে কখনো দেখিনি। পাখির ওড়াউড়ি দেখে সেও তার নিজের দু’হাত মেলে ধরে উড়বার চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন রকমের ফুল দেখছে। ছুঁয়ে দেখছে। দেখতে দেখতে সে নদীর কাছে চলে আসে। ছেলেটি নদী কখনো দেখিনি। শুধু এইটুকু বোঝে যে ওটা পানি।

কিন্তু জানেনা যে পানির উপর হাঁটা যায় না। ছেলেটি পানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাঁটু পানি পর্যন্ত নেমে পানিতে জলকেলি করছে। আরো বেশি আনন্দে আতœহারা হয়ে উঠেছে। নদীতে স্রোতের বেগ কেমন যেনো হঠাত বেড়ে গেলো।

সে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তবুও কী এক আনন্দে মেতে আছে সে। তখনো শিশুটি বোঝেনি এই নদী তাকে নিয়ে তার বুকের গভীরে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.