অস্থির
নির্বিচারে ওএসডি, পদোন্নতিতে দলীয়করণ-আঞ্চলিকীকরণ আর ব্যাপকহারে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে বিগত বছরজুড়ে জনপ্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন শত শত কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি এবং প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার ফলে কার্যত ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে প্রশাসন। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাকর্মী, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল গত বছরের পুরোটা সময়। পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহু সদস্যসহ শাসক দলের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। অপেক্ষাকৃত অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও জুনিয়র কর্মকর্তারা শীর্ষপদে অবস্থান করায় প্রশাসনজুড়েই এখন বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে মনে করেন প্রশাসনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিশিষ্টজনরা।
প্রশাসনের দলীয়করণ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ আমার দেশকে বলেন, মেধাবী, দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা কেউ ওএসডি, কেউবা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ, অদক্ষ ও জুনিয়র কর্মকর্তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় এখন প্রশাসন চালাচ্ছেন। এতে করে প্রশাসনজুড়েই একটি স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। প্রশাসনকে মেধার ভিত্তিতে গড়ে না তুললে দেশে সুশান কোনো অবস্থায়ই আশা করা যায় না। বর্তমানে যে প্রশাসন রয়েছে তা দিয়ে দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো সরকারের কাছ থেকেই আমরা একটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন পাইনি। অথচ বর্তমান সরকার তার আগের সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে নিজেরা দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিল। তিনি বলেন, প্রশাসনকে সবচেয়ে কলুষিত করে ফেলেছেন সরকারের জনপ্রতিনিধিরা। একজন সংসদ সদস্যের কাজ হচ্ছে সংসদে আইন পাস করা। অথচ তারা এখন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে প্রশাসনের ওপর খবরদারি করতেই বেশি পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারই প্রভাব পড়েছে।
নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী সরকার প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না করে বরং দলীয়করণের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। আমার দেশকে তিনি বলেন, দেশের প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা দেখলে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সরকার চাইছে প্রশাসনে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করতে। যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনাই পদোন্নতির মাপকাঠি হওয়ায় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারাও এখন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করতে পছন্দ করেন।
এটা বড়ই দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয়। আগের সরকার যখন কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করত, বর্তমান সরকারি দলকে তার তীব্র সমালোচনা করতে দেখেছি। নির্বাচনের সময় যখন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন, তখন আমরা বেশ আশাবাদী হয়েছিলাম। এখন প্রশাসন নিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ডে হতাশই হতে হয়। আগের তুলনায় প্রশাসনে রাজনীতিকরণ আরও বেড়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা বলতে আর কিছুই থাকবে না। প্রশাসনিক সংস্কার এখন অতিজরুরি হয়ে পড়েছে।
দৃশ্যপট সচিবালয় : দেশের প্রশাসনের মূলকেন্দ্র সচিবালয়ের অভ্যন্তরের দৃশ্য দেখলে যে কেউ এটাকে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস হিসেবেই বিবেচনা করবেন। সচিবালয়ের ভবনগুলোর দেয়ালে দেয়ালে আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান সংবলিত পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার শোভা পাচ্ছে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন সংগঠন দলীয় ব্যানারে সভা-সমাবেশ করে।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে সচিবালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে ‘জয় বাংলা-জয়বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে মন্ত্রীদের গ্রহণ করেন। সচিবালয়ের ওইদিনের দৃশ্য দেখে অনেক মন্ত্রীই বিস্ময় প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ওইদিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার হচ্ছে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নিরপেক্ষ ও মেধাবী জনপ্রশাসন প্রয়োজন। আজ যারা জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আমাদের বরণ করে নিয়েছে, এরাই হয়তো ভবিষ্যতে আবার বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে বিএনপি অথবা অন্য দলের সরকারকে বরণ করে নেবে।
কোনো অবস্থায়ই প্রশাসনকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করতে দেয়া হবে না। ’ মন্ত্রীর এ ঘোষণার দুই বছর পরে এসে সচিবালয়ে রাজনৈতিক পোস্টার আর ফেস্টুনের সংখ্যা বেড়েছে। সচিবালয়ের এক প্রবীণ কর্মচারী আমার দেশকে বলেন, চাকরি জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে দলীয় স্লোগান আর পোস্টার-ফেস্টুন এই প্রথম দেখলাম।
৮৫১ কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত : বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৮ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
দলীয় বিবেচনায় এদের পদোন্নতি দিতে গিয়ে সব ধরনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ৮৫১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর একযোগে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৫০৩ জনকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে ৫৫৩ জনকে বঞ্চিত করা হয়। প্রশাসনের জন্য এ ঘটনাকে ‘সুনামি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ওই সময় বঞ্চিতদের মধ্য থেকে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত বছরের ৬ জুলাই সচিব পদে ৮ জনকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে ৩০ জনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গত ১০ আগস্ট সচিব পদে ৯ জনকে পদোন্নতি দেয়ার সময় বাদ দেয়া হয়েছে ১০ জনকে।
২১ নভেম্বর ২৬৬ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার সময় প্রায় দুইশ’ কর্মকর্তাকে তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। গত মাসে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে ২১৫ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এতে বঞ্চিত হন ১৪৭ কর্মকর্তা।
ওএসডি অস্ত্রে কুপোকাত ৪৮৫ কর্মকর্তা : বর্তমান মহাজোট সরকার গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসনে মেধাবী হিসেবে পরিচিত ৪৫৮ জন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি করেছে। এর মধ্যে সচিব পদে ৯ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৩৪ জন এবং যুগ্ম সচিব পদে রয়েছেন ১৮৩ জন।
এদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারের শুরু থেকেই ওএসডি অবস্থায় রয়েছেন। এ সময়ে সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় সাড়ে তিনশ’জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে। ওএসডি হওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের ওএসডি করে মাসের পর মাস কর্মহীন অবস্থায় ফেলে রাখার ফলে রাষ্ট্র ও প্রশাসন উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওএসডি হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি হতাশা চলে আসে। চাকরি করেও অনেকে নিজেকে ছোট ভাবতে থাকেন।
ওএসডির শিকার সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, আত্মীয়স্বজনসহ পরিচিতদের কাছে গেলে নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়। ওএসডি হওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা জীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। রেকর্ড নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনে প্রবেশ করেছেন। প্রশাসনে মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এসব কর্মকর্তাও এখন ওএসডি হয়ে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন।
প্রশাসনে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ : প্রশাসনের ওপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করে শাসক দলের নেতাকর্মীদের টেন্ডার বাক্স ছিনতাই, সরকারি উন্নয়ন কাজ নিয়ে ভাগবাটোয়ারা, সরকারি বরাদ্দ থেকে চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, বালু-জলমহাল ও বাজার ইজারা বাগিয়ে নেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম ছিল বছরজুড়ে আলোচনার শীর্ষে।
দেশের অনেক স্থানেই ডিসি, এসপি, ইউএনওদের ওপর সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার সময় ডিসি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের কথা না শোনায় তার ওপর বর্বর হামলা হয়। এ ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। সরকার অবশ্য কয়েকদিন পরে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে উল্টো পাবনার সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলি করে। প্রশাসনের ওপর সরকারি দল এবং তাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপ, দেশব্যাপী টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, হল দখল, সরকারি জায়গাজমি দখলসহ নানা অপকর্মের ব্যাপারে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘দেশ আজ বাজিগরদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
বাজিগরদের হাত থেকে দেশ, দেশের মানুষ ও প্রশাসন কেউই নিরাপদে নেই
দলীয়করণে ভঙ্গুর জনপ্রশাসন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।