আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশ্চিমের মুসলমান ভীতি বনাম ভীতিকর পশ্চিমের ডিপ পলিটিকস ১

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

কথাটা ভলতেয়ারের, যে যারা আপনাকে অবিশ্বাস্য ঘটনায় বিশ্বাস করাতে পারে, আপনাকে দিয়ে তারা নৃশংসতাও ঘটাতে পারে। সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্র, আফগানিস্তানের গুহায় লাদেন এবং মুসলিমদের হাতে টুইন টাওয়ার ধ্বংস সেরকমই এক অবিশ্বাস্য, যা অনেকেই বিশ্বাস করেছে এবং দুটি নৃশংস যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে বা নীরবে মেনে নিয়েছে।

এখন সেই নৃশংসতার গল্পগুলো ফাঁস করে দিয়েছে উইকিলিকস। যে কাজ করবার কথা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার, তা করেছে এক সামান্য ওয়েবসাইট। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আগের মতোই নতুন যুদ্ধের জন্য জনমত গঠন করে যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী চিনিয়ে যাচ্ছে ‘অসভ্য’ মুসলমানদের আর তাদের অসভ্যতার বর্তমান প্রতিনিধি হিসেবে ইরানকে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে মুসলিম জঙ্গিবাদের বিরাট জুজু তৈরি করে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জঙ্গি, ভারতের জঙ্গি, পাকিস্তানের জঙ্গি, আফগানিস্তানের জঙ্গিদের প্রধান গ্র“পগুলো আসলে সংস্লিষ্ট দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি, যে গোয়েন্দাসংস্থাগুলো আবার ৯-১১ এর পর থেকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এর মানে এই নয় যে, রাজনীতির ময়দানে এইসব গ্র“প সক্রিয় নয়। সেখানেও তারা আছে, তবে তা বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড গ্র“পগুলোর থেকেও দুর্বল। মতার মদদ ছাড়া এদের নিজের জোরে কিছু করার মুরদ নাই। সিআইএ-র আল কায়েদা, আইএসআই-এর লস্কর ই তাইয়েবা, র’এর ইন্ডিয়ান মুজাহেদীন আর আমাদের ‘তেনাদের’ জেএমবিকে ব্যবহার করা হয়েছে জঙ্গি ভীতির বাস্তবতা সৃষ্টি করার কাজে। এই চক্রের মধ্যে জড়িত হয়েছে মোসাদ।

এরা প্রত্যেকেই সিআইএ-র ভাইবেরাদর। দুইয়ে দুইয়ে যোগ করলে তাহলে দাঁড়ায়, তারাই মুসলিম জঙ্গিবাদের জুজু তৈরি করেছে সামরিকায়ন, গণতান্ত্রিক অধিকার দমন, খনিজ সম্পদ দখল, অস্ত্র ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিক্রি, মধ্যএশিয়ার সম্পদ ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন এলাকায় সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা, নিজ নিজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াশীল পথে ঠেলে সেকুলার বনাম ইসলামপন্থী নামে কৃত্রিম দ্বন্দ্ব তৈরি করা এবং যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু যেমন ব্রিটেন বা ভারত, সেখানে তাদের জাতীয় শত্র“ হিসেবে দেখিয়ে শাসকশ্রেণীর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট কার্যক্রমের বৈধতা সৃষ্টি করা। এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে মুসলিম অসহিষ্ণুতার উত্থানকে দেখানো হলেও আসলে ঢাকা দেওয়া হচ্ছে, তথাকথিত সেক্যুলার পুঁজিবাদী শক্তির ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার বাস্তবতাকে। তাই তারা যাকে দেখাচ্ছে তাতেই অন্ধ হওয়ার বদলে খোদ যারা এসবের হোতা সেদিকেই নজর দিতে হবে। একটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করলেই ডিজাইনটি ধরা পড়ে: মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল হামলায় লস্কর ই তাইয়েবা জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কিন্তু সেই প্রমাণের কেঁচোর গর্তে পাওয়া গেছে বড় এক গোখরা। লস্কর ই-তাইয়েবাকে দিয়ে হামলার আয়োজনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে বেরিয়ে এসেছে মার্কিন নাগরিক ডেভিড কোলম্যান হেডলির নাম। তিনি পরিচিত সিআইএ-এফবিআইয়ের এজেন্ট বা ইনফর্মার হিসেবে। তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে মোসাদের এজেন্ট। আমেরিকানরা তার হামলার পরিকল্পনা আগে থেকে জানতো, ভারতীয়রাও জানতো যে সমুদ্র পথে সন্ত্রাসী হামলা আসবে।

কিন্তু সবাই মনে হয় ঘটনাটা ঘটতে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই হেডলির সঙ্গে ভারতের হিন্দু জঙ্গিদেরও যোগাযোগ ছিল। তৃতীয়ত, হেডলি এর পরের হামলার ল্যবস্তু হিসেবে এলইটিকে দিয়ে ডেনমার্কের সেই নবীর কার্টুন প্রকাশকারী পত্রিকার দপ্তর উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তিনি সফল হলে বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষের জোয়ার সুনামি হয়ে দেখা দিত, তৈরি হতো প্রতিটি দেশে আরো কঠোর সিকিউরিটি এন্তেজাম, মুসলিম বিদ্বেষ এবং ইরানে হামলার প্রাসঙ্গিকতা। ৯-১১-র হামলার সঙ্গে আল কায়েদার সংস্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি আমেরিকা দিতে পারেনি।

বিশ্বব্যাপী অজস্র বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকদের বিশ্বাস এটা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইনসাইডারদেরই কাজ। এর পে অজস্র প্রমাণও তারা হাজির করেছে। আমার যুক্তিতে অফিসিয়াল গল্পে বিশ্বাস করাটা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছু না। এখানে বেনেফিট অব ডাউট যুদ্ধবাজ বুশ প্রশাসন পাবে না, পেতে পারে সরকারি গল্পের গুমর উন্মোচনকারীরা। এর সঙ্গে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে হামলাকে মিলিয়ে পাঠ করলে, সবখানেই হেডলির মতো ইনসাইডারদের হাত পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক তদন্তগুলোয় প্রমাণ হয়েছে যে, ভারতের গুজরাতে মুসলিম নিধনের সূত্রপাতকারী গোধরা এক্সপ্রেসের আগুন, মালেগাঁও, আজমীর, আহমেদাবাদসহ গত কয়েক বছরের আলোচিত সন্ত্রাসবাদী নাশকতাগুলোয় ভারতীয় হিন্দু জঙ্গিবাদী সংগঠন অভিনব ভারত, আরএসএস প্রভৃতির হাত ছিল। এসব ঘটনা উদ্ঘাটনকারী পুলিশ কর্মকর্তা হেমন্ত কারকারে মুম্বাইয়ে তাজ হোটেল অপারেশনে রহস্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। শক্ত অভিযোগ উঠেছে যে, তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে। গত আগস্টে (২০০৯) ভারতীয় সাপ্তাহিক তেহেলকায় কংগ্রেস এমপি দিগি¦জয় সিং বলেন, ভারতে ঐ সময়ের পরপর বোমা বিষ্ফোরণগুলির পেছনে রয়েছে বিজেপি। তিনি এমনকি ভারতীয় পার্লামেন্টে তথ্যপ্রমাণও হাজির করার কথা বলেন।

তাঁকে তা করতে হয়নি। তার আগেই মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়–, গুজরাত ও বিহারসহ গত কয়েক বছরে আলোচিত বেশ কয়েকটি বোমা বিষ্ফোরণের সঙ্গে বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের সরাসরি সংযোগ আবিষ্কৃত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ স্কোয়াড নাশকতায় জড়ানোর অভিযোগে আটক করেছে সন্ন্যাসিনী সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরসহ এক সামরিক কর্মকর্তাকে। তাদের জবানি থেকে যা বেরিয়ে আসে তা এক কথায় ভয়াবহ। গত সেপ্টেম্বরে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের বোমা বিষ্ফোরণের সঙ্গে ঐ নেটওয়ার্কের জড়িত থাকবার আলামতও মিলেছে।

ভারতজোড়া সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে চালু আছে প্রশিণ শিবির। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, হিন্দু জনজাগরণ মঞ্চ, পানভেলের সান্তনা আশ্রম এবং ১৯৩৫ সালে জিন্দু উগ্রবাদী বি.এস. মুঞ্জে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটির ভোনশালা মিলিটারি স্কুল। এসব অভিযোগ ও আলামত ভারতে সন্ত্রাসবাদের নতুন মুখচ্ছবি সাজিয়ে তুলছে। বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে একে বলা হচ্ছে, ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’।

তা যদি হয় তাহলে সরকারি চোখে ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান হুমকি হিসেবে যে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের ভয় সৃষ্টি হয়েছিল, তার ধার অনেকটাই য়ে যায়। পাশাপাশি মুসলিম জঙ্গিবাদ চালানের দায়ে অহরহ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে যেভাবে নিন্দামন্দ করা হতো, তার গুরুত্বও কমে যায়। কারণ, ‘হিন্দু জঙ্গিবাদ’ বলে যাকে দেখা যাচ্ছে, তা তো খোদ ভারতীয় সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরই বেড়ে উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে যেমন ‘জঙ্গিবাদ’ কমবেশি সরকারি প্রশ্রয় পেয়েছিল, ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় পরিস্থিতির প্রধান পার্থক্য এখানেই যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে তা মূলধারার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

কিন্তু ভারতে তা মুলধারার রাজনীতি তথা ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং ৭-৮ টি রাজ্যের সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিজেপি শাসিত রাজ্যের স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে তাদের ভাবাদর্শ চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লিসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভাবাদর্শ বিরোধী পাঠ্যতালিকা বাদ দেওয়ানোর চেষ্টা হচ্ছে এবং তা সফলতাও পেয়েছে কিছুটা। আক্রান্ত হচ্ছেন শিল্পী ও অধ্যাপকেরা। এর বাইরে: আফগানিস্তানের পুতুল শাসক হামিদ কারজাই সম্প্রতি তার প্রভুদের সঙ্গে গোস্যা করে ফাঁস করেছেন যে, আফগানিস্তানের বেশিরভাগ বিষ্ফোরণই ভাড়াটে পশ্চিমা সিকিউরিটি এজেন্সিগুলোর কাজ।

মোটিফ না বোঝার কোনো কারণ নেই। ইরাকে প্রথম দিকে যে গাড়িবোমা বিষ্ফোরণ হতো, তার অনেকগুলিই ছিল আমেরিকা থেকে চুরি যাওয়া গাড়ি। এসব ঘটনা আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির অজুহাত হিসেবে দারুণ কাজে লেগেছে। ১৯৯৯ সালে কলকাতা বিমানবন্দরে ছয়জন হুজুরকে আটক করা হয়, তারা বাংলাদেশে আসছিল। পরে তারা স্বীকার করে যে, তারা ইসরায়েলি নাগরিক, বাংলাদেশে জঙ্গি আউটফিট বুঝতে তাবলীগের ছদ্মবেশে এখানে আসতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন তোলা দরকার যে, গ্রেনেড হামলার গ্রেনেড বা সারাদেশে ৫০০ বোমার অর্থ কারা দিয়েছিল? এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে। যার বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছিল মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার কোনাকুনচির মধ্যে। আমি দাগিয়ে রেখেছি পুরো চিত্রটা বুঝবার জন্য। কানাডিয় গবেষক নাওমি কেইন তাঁর ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম এ ডিপ পলিটিকস নামের একটি ধারণা সামনে এনেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন যে, রাজনীতির উপরিস্তরে অনেক কিছুরই জš§ বিভিন্ন শক্তিশালী সংস্থার লুকানো কার্যক্রমে।

গোয়েন্দা সংস্থা, প্রভাবশালী বিজনেস সার্কেল, মিডিয়া ম্যাগনেট, লবিস্টসহ নানান ক্ষমতাশালী গ্র“প সরকার, জনগণ, মিডিয়াকে বিশেষ পথে চালিত করে। রাজনীতির গতি ও সরকারের অনেক কর্মসূচি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। এটাকে তিনি ষড়যন্ত্র বলতে রাজি নন, বলতে চান ডিপ পলিটিকস। ফলে আমার বলা গুপ্ত যোগাযোগগুলোকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে নাকচ করার ঘোর বিরোধী আমি। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বরং সেগুলোই যেগুলোর পক্ষে পাবলিকলি যাচাইযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারা যায় না।

ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র, আল কায়েদার টুইন টাওয়ার ধ্বংস তেমনই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী এক মুসলিম ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে ইসলাম ও মুসলমানদের আক্রমণের নিশানা করেছে। এর সঙ্গে তুলনীয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইহুদী ষড়যন্ত্র ও ইহুদিদের কুকর্মের কথা বলে ইহুদী নিধনের জমিন তৈরির আয়োজন। এদের কাছে সেসময়ের ইহুদী আর আজকের মুসলমান কেবল আধিপত্য বিস্তারের বলিমাত্র। (আগামি পর্বে সমাপ্ত)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.