ওয়াটার লু এর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপলিওনকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ এ বন্দী রাখা হয়। কথিত আছে যে, প্রতিদিন খাবারের সাথে অল্প পরিমানে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপলিওনকে খেতে দেওয়া হত। এভাবে স্লো পইজনিংয়ের মাধ্যমে ফরাসি সেনাপতি নেপলিওনকে হত্যা করে তাদের চির শত্রু ব্রিটিশরা । কিন্তু আজকে আমার বাংলাদেশিরা নিজেরা নিজেদেরকে স্লো পইজনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। প্রতিদিন বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য এর সাথে ভেজাল হিশেবে যেসব রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে এ গুলো মানব দেহে মারাত্নক বিষক্রিয়া তৈরি করে।
তাই ভেজাল মেশানো খাদ্য খাওয়ানোও এক ধরনের স্লো পইজনিং। সমগ্র বাংলাদেশ আজ ভেজাল চক্রের বেড়াজাল এ আটকে গেছে। কোন খাদ্যে ভেজাল নেই? আম পাকাতে কার্বাইড ব্যবহ্ণত হচ্ছে, মাছ ও ফলমূল সংরক্ষণে ব্যবহ্ণত হচ্ছে ফরমালিন,শাকসবজি পোকামাকড় মুক্ত রাখতে বিভিন্ন রাসায়নিক কীটনাশক, মুড়িতে ইউরিয়া ,গুঁড়ো দুধ এ মেলামিন,কনডেন্স মিল্ক এর নামে খাওয়ানো হচ্ছে ভেজিটেবল ফ্যাট,বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যে ফুড গ্রেড রঙ এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর টেক্সটাইল গ্রেড রঙ,এডিবল অয়েল এর পরিবর্তে পেট্রোল দিয়ে ভাজা হচ্ছে চানাছুর,জিলাপি ইত্যাদি।
খাদ্য ভেজাল মেশাচ্ছে বাজ্ঞালীরা আবার সেই ভেজাল মেশানো খাবার খাচ্ছে ও বাজ্ঞালীরা। নীরাদ সি চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ কথাটি এক্ষেত্রে এসে সার্থকতা লাভ করেচে।
যে ব্যবসায়ী একটি খাদ্য ভেজাল মেশাচ্ছেন আবার সেই ব্যবসায়ীই অন্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভেজাল মেশানো অন্য একটি খাদ্য কিনে খাচ্ছেন। এভাবে ভেজাল চক্র বজায় আছে। আমরা সাধারণ মানুষরা হয়ে গিয়েছি ভেজাল চক্রের বলির পাঁঠা। সাধারণ মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নিজের ঘাঁটের টাকা খরছ করে ভেজাল মেশানো খাবার খাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাজ্ঞালীর এই আত্মঘাতী প্রবনতা ঠেকানোর দায়িত্ব কে নিবে? নাকি বঙ্গদেশের বাঙ্গালীরা এ আত্মঘাতী প্রবনতা বজায় রেখে এক সময় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে (Endangered species) এ পরিনত হবে? সবাই হয়তো সমস্বর এ বলে উঠবেন এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার সীমিতপরিসরে চেষ্টা করছে ভেজাল ঠেকানোর। ইতিমধ্যে, ভেজাল সংশ্লিষ্ট ‘ভোক্তা অধিকার আইন’ সংশোধন করা হয়েছে। বিএসটিআই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। তবুও কিন্তু ভেজাল মেশানো রোধ করা যাচ্ছে না। খাদ্য ভেজাল মেশানোর এ সর্বগ্রাসী প্রবণতার দীঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে আগামী প্রজন্মের উপর।
ইতিমধ্যে,ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে । বিশেসজ্ঞরা বলছেন,খাদ্যে ভেজাল এবং পরিবেশ দূষণই এর মুল কারন।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করার জন্য শুধু সরকার এর উপর নির্ভর করে না থেকে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ কে এক্ষেএে নেতৃত্ব স্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক মিডিয়া এ বাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে।
ইতিমধ্যে কোন কোন মিডিয়া খাদ্যে ভেজাল সংশ্লিষ্ট সংবাদ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। শুধু আইন প্রণয়ন করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ অনেক ব্যবসায়ী জানেই না সে যে ভেজাল মেশাচ্ছে এর প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়ংকর। আবার অন্যদিকে ভোক্তারাও যে সব সময় সচেতন তাও কিন্তু নয়। রমজান মাসে বেশীর ভাগ হোটেলের তৈরিকৃ্ত ইফতারিতে ক্ষতিকর রং মেশানো হয়।
অনেকে জেনে শুনেই এ সকল রং মেশানো ইফতারি কিনেন। সেজন্য প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টি করা। বাজার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ও সচেতনতা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সহজবোধ্য ভাষায় খাদ্যে ভেজাল মিশানোর অপকারিতা সম্পর্কে লিফলেট ও পুস্তিকা তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা ভেজাল বিষয়ে বিশেষ ক্লাস নিতে পারেন।
মসজিদ,মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় নেতারা খাদ্যে ভেজাল বিষয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। এ অনুষ্ঠানে খাদ্যে ভেজাল বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি ভেজাল মেশাচ্ছে তাদের পরিনিতি সম্পর্কে ধর্মীয় বিধান আলোচনা করবেন। খাদ্য ভেজাল সমস্যা মাদক- দ্রব্যর মতো এক ভয়াবহ সমস্যার রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই মাদক বিরোধী কনসার্ট এর মত ভেজাল বিরোধী কনসার্ট এর আয়োজন করতে হবে। এ সকল কনসার্ট এ শিল্পী ও তারকাদের পাশাপাশি খাদ্য বিশেষজ্ঞদের ও আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
আগামী প্রজন্ম কে খাদ্যে ভেজাল বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারন আগামী প্রজন্ম একদিকে যেমন ভোক্তা অন্যদিকে আগামী দিনের উদ্যোক্তা। আমরা যদি এটা নিশ্চিত করতে পারি যে আগামী দিনের উদ্যোক্তারা খাদ্যে ভেজাল মেশাবে না, তাহলে এটাও হবে একটা বিশাল অর্জন।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করতে হলে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে। বাজার থেকে নিয়মিত খাদ্য-দ্রব্যর নমুনা সংগ্রহ করে নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন টেস্টিং ল্যাবগুলো্র মধ্য সমন্বয় সাধন করা। কারন বিএসটিআই’র পক্ষে একা এত বড় বাজার মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। বিসিএসআইআর, এটোমিক এনার্জি কমিশন এবং অন্যা্ন্য প্রতিষ্ঠান গুলোকে সংশ্লিষ্ট করে নিয়মিত খাদ্য-দ্রব্য পরীক্ষা করতে হবে।
নেপলিওনকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ এ বন্দী করে রেখে তাকে তার অজান্তে স্লো পইজনিং করা হয়েছিল। নেপলিওন চাইলেও নিজেকে এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারতেন না।
বাংলাদেশ নামক বদ্বীপ এ আমরা স্বাধীন এবং আমরা জানি আমাদেরকে খাবারের সাথে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে। আমরা চাইলে সহজেই এ অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি। এর জন্য যা প্রয়োজন সেটা হল সচেতনতা এবং সকলের আন্তরিক উদ্যোগ । একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি সুস্থ ও প্রানোচ্ছল আগামী প্রজন্ম। তাই আগামী প্রজন্মকে বাঁছানোর স্বার্থে আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।