অন্যের মতাদর্শ বা বিশ্বাষকে অসম্মান করার নাম মুক্তবুদ্ধির চর্চা নয় মিজানুর রহমান
খাদ্যের ভেজাল মহামারীর রূপ নিলেও এ ব্যাপারে এখনো উদাসীন সরকার। উপযোগী আইনের অভাব এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়হীনতায় বেপোরোয়া ভেজালকারীরা।
খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণে সাধারণত চারটি বিভাগ কাজ করে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট এই দফতরগুলোকে বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সহায়তা করেন।
কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল এবং নমুনা পরীক্ষার ন্যূনতম যন্ত্রপাতির অভাবে ভেজাল খাদ্যের সরবরাহকারীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর রয়েছেন ৫শ’৫৭ জন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর থাকলেও প্রশিক্ষিতদের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের ফিল্ড অফিসার আছে ৮ জন। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থাকলেও এখানে এখনো প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার।
শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপজেলা এবং জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ছাড়া বাকি বিভাগগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এখানেও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দুধের পানি পরিমাপ করার জন্য মান্ধাতা আমলের ল্যাকটোমিটার ছাড়া জেলা-উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা কোনো যন্ত্রপাতি পান না। ইন্সপেক্টররা সন্দেহমূলক ভেজাল খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য গবেষণাগারে (ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ) পাঠান। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস ধরে এখানকার পাবলিক অ্যানালাইসিসের পদও শূন্য।
এ কাজটি চালাচ্ছেন একজন সহকারী কর্মকর্তা। তাছাড়া বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯ কে ২০০৫-এ সংশোধন করা হলেও জরিমানার পরিমাণ (২শ’ থেকে ৫ হাজার) বাড়ানো এবং কয়েকটি নতুন নমুনা সংযোজন ছাড়া কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে ৫শ’৫৭ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর থকলেও যোগ্যতা হিসেবে পদায়নের ব্যাপারেও রয়েছে অভিযোগ। যোগ্যতা হিসেবে পদ না পাওয়া, প্রয়োজনীয় আইন এবং যন্ত্রপাতিসহ নানা সমস্যায় জেলা এবং উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদেরও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না অধিদফতর। স্যানিটারি ইন্সপেক্টর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি শিমুল চৌধুরী জানান, অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পদটি এখনো তৃতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদায় রয়ে গেছে।
অথচ সরকারের অন্যান্য দফতরে একই যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা প্রথম শ্রেণীর। সরকারের অন্যান্য অনেক দফতরের কর্মকর্তাদের মতো একসময় ভূমি রেজিস্ট্রার এবং স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পদটি একই পদমর্যাদার ছিল। কিন্তু পরে ভূমি রেজিস্ট্রার পদটি প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা পেলেও স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা তৃতীয় শ্রেণীতেই রয়ে গেছেন।
অধিদফতরের আওতাধীন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের দাবির বিষয়টি যৌক্তিক স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মতিউদ্দিন জানান, শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ডিপ্লোমাধারী। স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত অন্যান্য ডিপ্লোমাধারীদেরকেসহ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পদোন্নতি দেয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে।
এছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অর্থায়নে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ এ ‘ফুড সেফটি’ সেল গঠন করা হয়েছে। ফুড সেফটি সেল স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদেরকে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়নের কাজ করবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মুনির হোসেন এই সেলের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় জনবল এবং উপযোগী আইন নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই)। দেশের মাত্র কয়েকটি জেলায় বিএসটিআইয়ের অফিস রয়েছে।
অফিস থাকলেও অনেক জায়গায় পরিদর্শক নেই। তাছাড়া নিজস্ব আইনের কারণেও অনেকটা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাজ করে বিএসটিআই। বাজারে প্রচলিত যে কোনো পণ্য চাইলেই পরীক্ষা করার এখতিয়ার নেই এ প্রতিষ্ঠানের। খাদ্য পণ্যের মধ্যে শুধু তালিকায় দেয়া ৬৪ প্রকারের খাবারের নমুনা পরীক্ষা করে বিএসটিআই। ১৮ ক্যাটাগরির তালিকার কারণে রফতানিকৃত অনেক খাদ্যদ্রব্যের মান পরীক্ষা করতে পারে না তারাও।
তাছাড়া খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স এবং বিএসটিআইয়ের লোগো দেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রচুর ফাঁকফোকর।
শুধু আইনের ফাঁক থাকার কারণে বিএসটিআইয়ের লোগো এবং অনুমোদন নিয়েও যে কেউ ভেজাল পণ্য বাজারজাত করতে পারে। একটি জুস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জুস বাজারজাত করার আগে এক ব্যাচ জুসের নমুনা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলেই ওই কোম্পানিকে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন দিয়ে দেয়া হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জুস কোম্পানি যদি ম্যাঙ্গো পাল্প, চিনির বদলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল, অনুমোদনহীন ফ্লেভার, রং আর স্যাকারিন দিয়ে নতুন ব্যাচে জুস বাজারজাত করে তাহলে বিএসটিআইয়ের করার কিছুই নেই। তাছাড়া হঠাৎ করে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়ও তাহলেও লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু করার থাকে না আদালত পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটের।
কারণ জুসের অথবা যে কেন খাদ্যপণ্যের গুণগত মানের তাৎক্ষণিক পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই বিএসটিআইয়ের। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।