অভিন্ন লক্ষ্যে সব অপশক্তির ছায়া
ফকির ইলিয়াস
=========================================
জাতির বহুল প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম শুরু করেছে। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতের চার নেতাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি চক্র শুধু বিরোধিতাই করেনি, তারা সশস্ত্র হয়ে পাকহানাদার বাহিনীকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে ছিল।
আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী গঠন করে গণহত্যার প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়েছিল। তা মাত্র চার দশক আগের ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এ সময় কিন্তু খুব বেশি সময় নয়। চার দশক সময়ে কোন জাতির মাটি থেকে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, খুনের চিহ্ন মুছে যায় না। এসব দাগ মুছে যায় না শত শত বছরেও।
অথচ দালাল-রাজাকাররা সেটিই মনে করেছিল।
বাংলাদেশে এই যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এতে কারা অখুশি, কারা এ বিচার প্রক্রিয়া পন্ড করতে চায়- সেসব বিষয়গুলোও নজরে রাখা দরকার। আমরা দেশে-বিদেশে একটি অতি পরিচিত শ্লোগান শুনছি। 'বাংলাদেশে এখন চরম ক্রান্তিকাল চলছে। '
একটি উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গে বলি।
যায়যায়দিন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছিলেন অতি সম্প্রতি। তিনি বিভিন্ন সভায়, সমাবেশে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশে এখন চরম দুঃশাসন চলছে। 'মানবাধিকার' ক্ষুণ্ন হচ্ছে এ ধুয়া তুলে তিনি বর্তমান সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। তার মতে, বর্তমান সরকার নাকি স্বৈরাচারী সরকারের চেয়েও ভয়াবহ।
শফিক রেহমানের দুঃখের কারণ কারও অজানা থাকার কথা নয়। কারণ তিনি সেই সুবিধাবাদী সাংবাদিক, যিনি চারদলীয় জোট সরকারের কাছ থেকে নানা রকম বিশেষ সুবিধা-সুযোগ নিয়েছিলেন। এই সেই শফিক রেহমান, যিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি।
বাংলাদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিল, আমরা তাদের খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু তারা প্রগতিবাদের ধ্বজা ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আজও বিরোধিতা করে যাচ্ছে, তাদের চিনতে প্রজন্মের কষ্ট হচ্ছে তো বটেই।
বরং তারা নানাভাবে লেবাস বদল করে মূলত মৌলবাদের পারপার্স সার্ভ করে যাচ্ছে।
সংবাদপত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। এবং এটাও বুঝি নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য অনেকে কলমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এ বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়া যাক। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান।
তার পরিচয় তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মাহমুদুর রহমান কলাম লেখায় মনোযোগী হন। এরপর 'আমার দেশ'-এর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নেন।
বলা দরকার, মাহমুদুর রহমান সবই করেছেন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে।
এটা দেশবাসীর অজানা নয়, মাহমুদুর রহমান যদি নিজে সাংবাদিক-সম্পাদক হিসেবে জাহির না করতেন তাহলে তার গ্রেফতারের পর এত বেশি প্রতিবাদ হতো না। মাহমুদুর রহমান বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি নাকি 'জাতীয় স্বার্থ রক্ষা'র জন্য প্রতিবাদ করেছেন। তিনি তো জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন। নিজামী-খালেদা সরকারের সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয়সহ হাওয়া ভবনের ইজারাদাররা যে বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তখন তার 'বীরদর্পে প্রতিবাদের ভাষা' কোথায় ছিল? এসব মস্তানির প্রতিবাদ করে তিনি সেদিন পদত্যাগ করেননি কেন?
মাহমুদুর রহমান জানতেন, শুধু 'সাংবাদিক সম্পাদক' সাজতে পারলেই মিডিয়ার করুণা পাওয়া যাবে। একই মতবাদ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন আলবদর রাজাকারদের আরেক দোসর ড. আফতাব আহমাদ।
যিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের ধৃষ্টতা দেখিয়ে মতবাদ প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে তিনি খুব দুঃখজনকভাবে আততায়ীর হাতে নিহত হন। যা আমার্জনীয় হত্যাকান্ডের সুবিচারও এ রাষ্ট্রে এখনো হয়নি।
দুই
বাংলাদেশে অনিবার্য ওয়ান-ইলেভেনের নেপথ্য নায়ক কারা ছিল তা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। কিন্তু কোন কোন মহারথির কারণে ওয়ান-ইলেভেন সংঘটিত হয়েছিল, তাদের নাম বলে দিয়েছেন দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
তিনি একটি সেমিনারে বলেছেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ব্যারিস্টার আমিনুল হক এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ চারজনের রাজনৈতিক অধঃপতনের কারণেই দেশে ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল। এ চারজন কে কে, তাদের বিস্তারিত পরিচয় কী তা দেশবাসীর অজানা নয়। তারা ছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অন্যতম চার শীর্ষনেতা। তারা দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক স্খলনকে এত বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন যে, যা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে দিয়েছিল। ব্যা. আমিনুল হক এবং সাকা চৌধুরী সরাসরি জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তা নিয়ে দেশবাসী সোচ্চার ছিল।
আইনমন্ত্রী ব্যা. মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রের আইনের শাসন ভেঙে খান খান হয়ে পড়েছিল। আর যোগাযোগমন্ত্রী ব্যা. নাজমুল হুদা চরম দুর্নীতির, ভাগ-বাটোয়ারার স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন তার মন্ত্রণালয়কে।
যে হাওয়া ভবন গোটা দেশজুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছিল, এসব ক্ষমতাবান নেতা-মন্ত্রীরা ছিলেন সে ভবনের ভিতের মতো। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সে সত্যটি প্রকাশ করে জাতির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার উপস্থিতিতেই, তার সামনে এসব কথা বলেছেন রফিক-উল হক।
এই যে অনেক সত্য বেরিয়ে আসছে, সেসব কারণেই ভীত হয়ে পড়ছে দেশের ডানপন্থি মোর্চা। তাদের অতীত কর্মকা-ের ফিরিস্তি এখন দেশের বিবেকবান সুধীজনরাই প্রকাশ্যে বলছেন। ফলে তাদের ভয় বাড়ছে।
সাকা চৌধুরী প্রকাশ্যে তার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নাকি রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ। তার ভাষায় যা বুঝা যায়, এ বিচারকে দেশের অপশক্তি রাজাকারচক্র চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেবে।
অর্থাৎ বিচার করতে তারা দেবে না।
মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রপক্ষও এ বিচারকার্যকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারলে, এ প্রজন্ম মহাজোট সরকারকে ক্ষমা করবে না। তাই পরাজিত রাজাকার শক্তি আজ যেভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সরকারকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, তার মোকাবিলা করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সুসংহত থাকতে হবে। যারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপকর্ম করেছে এবং বর্তমানে যারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তাদের সবার লক্ষ্যই এক।
তারা অভিন্ন মতলব হাসিলের জন্যই বিভিন্ন প্লাটফর্মে বিভক্ত হয়ে মাঠে আছে। রাষ্ট্রের মানুষকে তাদের জেনে-চিনেই আগামীর পথে অগ্রসর হতে হবে।
নিউইয়র্ক , ২৮ জুলাই ২০১০
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ৩০ জুলাই ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি - পিট হ্যামিলটন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।